somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

??? কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে গান ও বাদ্যযন্ত্র ???

১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১১:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গান গাওয়া বা শোনা জায়েজ কি না, যদি জায়েজ হয় তাহলে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা যাবে কি না– এইসব তাত্ত্বিক প্রশ্নের সমাধান এখন পর্যন্ত অন্তত বাংলাদেশে হয়নি। ফলে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজ করার ক্ষেত্রে ইসলামপন্থীদের মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্ব কাজ করে। এই দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে না পারায় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাদের পদচারণাও খুব সীমিত। কিঞ্চিৎ যেসব চর্চা রয়েছে, তাও নিজস্ব গণ্ডি পেরিয়ে মূলধারায় এসে মিশতে পারেনি। শাইখুল ইসলাম ড. ইউসুফ আল কারযাভী ‘ফিকহুল গিনা ওয়াল মাওসিকা ফি দাওয়িল কোরআন ওয়াস সুন্নাহ’ শিরোনামে ২০০১ সালে একটি বই লিখেন, যার বাংলা অর্থ হলো ‘কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে গান ও বাদ্যযন্ত্র’। আমরা আশা করছি বইটির ধারাবাহিক অনুবাদ পাবলিশ করতে পারবো। এর মাধ্যমে অন্তত গানের জগতে ইসলামপন্থীরা হয়ত স্ববিরোধমুক্ত হয়ে কাজ করার তাত্ত্বিক ভিত্তি খুঁজে পাবে। আজ ছাপা হলো প্রথম অধ্যায়ের প্রথম অংশ।



বাড়াবাড়ি ও শিথিলতার প্রান্তিকতা
মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের সাথে ঘনিষ্ট ব্যাপারগুলোর মধ্যে বিনোদন ও শিল্পকলা সম্ভবত সবচেয়ে উপেক্ষিত বিষয়গুলোর একটি। যদিও বাস্তবে এটি আমরা মনে রাখি না।

ফলে লোকেরা এ বিষয়ে হয় অত্যধিক বাড়াবাড়ি করে, নয়তো খুব বেশি শিথিলতা প্রদর্শন করে। কারণ, এগুলো যতটা না মানুষের জ্ঞান ও বিবেচনাবোধের সাথে সম্পর্কিত, তারচেয়েও বেশি আবেগ-অনুভূতির সাথে সম্পৃক্ত। এ কারণে এগুলোর মাধ্যমে একদিকে যেমন বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন হয়, তেমনি অন্যদিকে কঠোরতা ও বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধেও এগুলোকে কাজে লাগানো যায়।

অনেকে মুসলিম সমাজের এমন একটি চিত্র তুলে ধরেন, যাতে মনে হয়– এখানে কেবল ইবাদত বন্দেগী এবং কাজ আর কাজ নিয়েই পড়ে থাকতে হয়। আনন্দ-বিনোদন, হাসি-উল্লাস, গানের কোনো স্থানই যেন এখানে নেই! এই সমাজে অট্টহাসি বা মুচকি হাসি­, প্রফুল্ল মন বা হাসিখুশি চেহারা– এসবের কোনোটাই যেন জায়েজ নয়!

মুসলিম সমাজের এমন এক অদ্ভুত চিত্র গড়ে ওঠার পেছনে সম্ভবত কিছু ধার্মিক মানুষের আচরণই দায়ী। এসব ধর্মভীরু মানুষকে খেয়াল করলে দেখবেন– তারা সবসময় গোঁমড়ামুখো হয়ে থাকে। তাদের কপাল থাকে কোঁচকানো। তারা সবসময় দাঁত কিরমিরিয়ে থাকে। কঠোর স্বভাব, হতাশা, কিংবা কোনো ব্যক্তিগত মানসিক সমস্যার কারণে হয়তো তাদের চেহারার এমন দশা হয়ে থাকে। কিন্তু এসব অসৌজন্যমূলক আচরণকে তারা সাধারণত দ্বীনের নামে চালিয়ে দেয়। অথচ দ্বীনের ‘দোষ’ কেবল এতটুকুই যে, দ্বীনকে তারা ভুল বুঝে বসে আছে। এর কারণ হলো, তারা বিচ্ছিন্নভাবে এখান ওখান থেকে নস তথা কোরআনের আয়াত ও হাদীসগুলোকে গ্রহণ করে।

এভাবে শুধু নিজের উপর কাঠিন্য আরোপ করে তারা যদি তৃপ্ত থাকতো, তাহলে কারো কিছু বলার ছিল না। কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এই কঠোরতার বোঝা তারা সমাজের সবার উপর চাপিয়ে দিতে চায়। তাদের পছন্দনীয় চিন্তাধারা সবাইকে গেলাতে চায়। এর ফলে জটিলতাই বাড়ে শুধু। এই জটিলতা সামগ্রিকভাবে মানুষের জীবনকে গ্রাস করে নেয়­– হোক তা যাযাবর কিংবা সভ্য, গ্রামীণ কিংবা শহুরে, উত্তর মেরু কিংবা দক্ষিণ মেরু, প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যের জীবন।

এদের ঠিক বিপরীত ধরনের কিছু মানুষও রয়েছে, যারা নিজের কুপ্রবৃত্তির খায়েশ মেটাতে লাগামহীন জীবনযাপন করে। তারা তাদের পুরো জীবনটাকেই খেল-তামাশায় পরিণত করেছে। বৈধ-অবৈধ, আবশ্যিক-অবাঞ্ছিত, হালাল-হারামের মাঝে যত পার্থক্য রয়েছে, সবগুলোকে তারা ঘুচিয়ে দিয়েছে।

লক্ষ করলে দেখা যায়, বিনোদন ও শিল্পের নাম দিয়ে এরা চায় সবকিছু শিথিল হোক, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ুক এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব ধরনের অশ্লীলতার প্রসার ঘটুক। কোনো বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, তা নাম-ধাম কিংবা বাহ্যিক পরিচয় নয়, বরং বিষয়বস্তু এবং উদ্দেশ্যের উপরই নির্ভর করে। এই মূলনীতি তারা ভুলে বসে আছে।

অতএব, প্রথম গ্রুপের বাড়াবাড়ি এবং শেষোক্ত গ্রুপের ছাড়াছাড়ি হতে মুক্ত থাকতে হবে। তদুপরি সহীহ হিসেবে প্রমাণিত সুস্পষ্ট নস (কোরআনের আয়াত ও হাদীস), শরীয়াহর মূল উদ্দেশ্য এবং ফিকাহর সুপ্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুনের আলোকে বিষয়টিকে বিবেচনা করতে হবে।

এ বিষয়ে এখানে খুব বেশি আলোচনার সুযোগ নেই। সংক্ষেপে কিছু বলবো। তবে আমার অন্যান্য বইয়ে বিস্তারিত লিখেছি। এ প্রসঙ্গে ‘ইসলামে হালাল-হারামের বিধান’ এবং ‘সমসাময়িক ফতোয়া’ ১ম ও ২য় খণ্ডের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া ‘মুসলিম সমাজের কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য’ বইয়ের ‘সঙ্গীত ও শিল্পকলা’ অধ্যায়ে এ বিষয়ে বলেছি। পরে অধ্যায়টিকে কিছুটা পরিবর্ধিত করে ‘ইসলাম ও শিল্পকলা’ শিরোনামে আলাদা পুস্তিকাও বের করেছি।



শিল্পকলার ব্যাপারে মূলনীতি
এ সম্পর্কে নিচে একটা সারমর্ম তুলে ধরা হলো, যেখানে এর মূলনীতি ও প্রকৃত বাস্তবতা ফুটে উঠেছে।

মানবসত্তার সাথে ইসলামের সম্পর্কের স্বরূপ

ইসলাম একটি বাস্তবধর্মী দ্বীন তথা জীবনব্যবস্থা। মানুষের শরীর, মন, আকল, অনুভূতি– এই সবকিছুর সাথেই ইসলামের সম্পর্ক রয়েছে। ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণভাবে মানবসত্তার এই সবগুলো দিকের খোরাক মেটানোর কথা বলে, যা ‘রহমানের বান্দাদের’ বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

وَالَّذِينَ إِذَا أَنفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَٰلِكَ قَوَامًا

আর তারা যখন ব্যয় করে, তখন যেমন অপব্যয় করে না, তেমনি কার্পণ্যও করে না। বরং তাদের অবস্থান এ দুইয়ের মাঝামাঝি। (সূরা ফোরকান: ৬৭)

এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটি স্রেফ ধনসম্পদ খরচের বেলায়ই সীমাবদ্ধ নয়। বরং যে কোনো কাজের ক্ষেত্রেই এটি একটি সাধারণ মৌলিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য। এটাই হলো একটি মধ্যপন্থী জাতির মূল কথা।

খেলাধুলা যদি শরীরের খোরাক মেটায়, ইবাদত যদি আত্মার খোরাক মেটায়, জ্ঞান যদি আকলের খোরাক মেটায়, তাহলে শিল্পকলা নিশ্চয়ই আবেগ-অনুভূতির খোরাক মেটায়।

উল্লেখ্য, যেসব বিনোদন মানুষকে অধঃপতিত করে না, বরং উন্নত করে– শিল্পকলা বলতে আমরা সেসবকেই বিবেচনা করছি।

সৃষ্টিজগতের কল্যাণ ও সৌন্দর্যের ধারণার উপর কোরআনের গুরুত্বারোপ:

শিল্পকলার মূল কথা যদি হয় সৌন্দর্যকে হৃদয়ঙ্গম ও উপভোগ করা, তাহলে বলা যায় স্বয়ং কোরআনই আমাদেরকে এ ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করেছে। কোরআনের একাধিক আয়াতে এর গুরুত্বও তুলে ধরা হয়েছে।

আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে লুকায়িত ‘সৌন্দর্যের’ উপর কোরআন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছে। পাশাপাশি এসব সৃষ্টির মাঝে যেসব ‘কল্যাণ’ বা ‘উপকার’ রয়েছে, তার উপরও জোর দিয়েছে।

আল কোরআন এভাবে সৃষ্টিজগত থেকে উপকার গ্রহণের পাশাপাশি আমাদেরকে এর সৌন্দর্য উপভোগ করতেও বলে দিয়েছে। যেমন, চতুষ্পদ পশুর উপকারিতা প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

وَالْأَنْعَامَ خَلَقَهَا لَكُمْ فِيهَا دِفْءٌ وَمَنَافِعُ وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ

তিনি চতুষ্পদ প্রাণী সৃষ্টি করেছেন, তোমাদের জন্য ওতে শীত বস্ত্রের উপকরণসহ আরো অনেক ধরনের উপকার রয়েছে, এছাড়া তাদের কিছু তো তোমরা আহারও করে থাকো। (সূরা নাহল: ৫)

এই আয়াতটিতে উপকারিতার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। ঠিক পরের আয়াতটিতে আল্লাহ বলেছেন,

وَلَكُمْ فِيهَا جَمَالٌ حِينَ تُرِيحُونَ وَحِينَ تَسْرَحُونَ

তোমরা যখন গোধূলী লগ্নে ওদেরকে ঘরে ফিরিয়ে আনো এবং প্রভাতে চারণভূমিতে নিয়ে যাও, তখন এর মাঝে তোমাদের জন্য রয়েছে সৌন্দর্য। (সূরা নাহল: ৬)

এই আয়াতটিতে সৌন্দর্য উপভোগ করার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। আয়াতটি আমাদেরকে স্রষ্টার এমন এক অসাধারণ শিল্পকর্মের দিকে মনোযোগ দিতে বলে, যা কোনো সৃষ্ট জীবের পক্ষে আঁকা সম্ভব নয়, মহামহিম স্রষ্টার পক্ষেই শুধু তা সম্ভব। একই সূরায় একটু পরে আল্লাহ তায়ালা আবার বলেছেন,

وَالْخَيْلَ وَالْبِغَالَ وَالْحَمِيرَ لِتَرْكَبُوهَا وَزِينَةً

তিনি ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা আরোহণ করতে পারো, এছাড়াও এতে সৌন্দর্য এবং নান্দনিকতাও রয়েছে। (সূরা নাহল: ৮)

আয়াতটিতে উল্লেখিত আরোহণ করার ব্যাপারটি একটি প্রয়োজনীয় বস্তুগত উপকারিতা। অন্যদিকে সৌন্দর্য হলো শিল্পকলার নান্দনিকতা উপভোগ করার ব্যাপার। বস্তুত, এ দুয়ের সম্মিলনেই প্রতিটি মানবিক প্রয়োজনীয়তা পরিপূর্ণতা লাভ করে।

সমুদ্রকে আল্লাহ আমাদের জন্য কীভাবে উপযোগী হিসেবে তৈরি করেছেন, একই সূরায় কয়েক আয়াত পরে তিনি সেটি আমাদেরকে বলেছেন:

وَهُوَ الَّذِي سَخَّرَ الْبَحْرَ لِتَأْكُلُوا مِنْهُ لَحْمًا طَرِيًّا وَتَسْتَخْرِجُوا مِنْهُ حِلْيَةً تَلْبَسُونَهَا

তিনিই সমুদ্রকে ব্যবহার উপযোগী করেছেন, যাতে তোমরা সেখান থেকে তাজা মাছ খেতে পারো এবং একই সাথে সেখান থেকে মণি-মুক্তা আহরণ করে গয়না হিসেবে পরিধানও করতে পারো। (সূরা নাহল: ১৪)

এই আয়াত অনুযায়ী, সমুদ্রের উপযোগিতা স্রেফ শরীরের জন্য উপকারী তাজা মাছ খাওয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। এর পাশাপাশি অলঙ্কারের কথাও বলা হয়েছে। অলঙ্কার ব্যবহারের উদ্দেশ্যই তো সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলা। যা পরিধান করলে চোখ ও অন্তর জুড়িয়ে আসে।

এই দৃষ্টিভঙ্গিটি আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বার বার বলেছেন। বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ, খেজুর, আঙুর, জলপাই ও আনার গাছ এবং এসব গাছের ফলের উদাহরণ দিতে গিয়েও এই দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

كُلُوا مِن ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَآتُوا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ

এগুলো যখন ফলবান হয় তখন তোমরা এসব ফল খাও, আর ফসল তোলার দিনে (যে বঞ্চিত) তার হক ঠিকঠাক মতো আদায় করো। আর অপচয় করো না। তিনি নিশ্চয় অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না। (সূরা আনআম: ১৪১)

একই সূরার অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন ফসল, খেজুর ও আঙুর উদ্যানের কথা উল্লেখ করার পর বলেছেন,

انظُرُوا إِلَىٰ ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَيَنْعِهِ إِنَّ فِي ذَٰلِكُمْ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ

যখন তা ফলবান হয় এবং ফলগুলো পাকতে শুরু করে, তখন তোমরা এই সৃষ্টি নৈপুণ্য দেখো। ঈমানদারদের জন্য নিশ্চয় এতে বহু নিদর্শন রয়েছে। (সূরা আনআম: ৯৯)

ফল খাওয়ার মাধ্যমে যেমন মানুষের দৈহিক চাহিদা পূরণ হয়, তেমনি পরিপক্ক ফলের সৃষ্টি নৈপুণ্য উপভোগ করাও এক ধরনের মনের খোরাক। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বুঝা যায়, স্রেফ উদরপূর্তিই মানুষের একমাত্র কাজ নয়।

একইভাবে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেন,

يَا بَنِي آدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِندَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ * قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّـهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ

হে আদম সন্তানেরা! প্রত্যেক ইবাদতের সময় তোমরা সুন্দর সাজে সজ্জিত হও। তোমরা খাও এবং পান করো, কিন্তু অপচয় করো না। কারণ, আল্লাহ অপচয়কারীদের মোটেও ভালোবাসেন না। হে রাসূল! আপনি জিজ্ঞেস করুন– আল্লাহর অলংকার, যা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য তৈরি করেছেন এবং পবিত্র রিজিককে কারা হারাম করে বসলো? (সূরা আরাফ: ৩১-৩২)

সাজসজ্জা মানুষের মনের খোরাক, আর খাওয়া-দাওয়া হলো দেহের খোরাক। দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ প্রদত্ত সৌন্দর্যের উপকরণ ও রিজিক হারাম গণ্য করাকে উপরে উল্লেখিত দ্বিতীয় আয়াতে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ‘আল্লাহর অলংকার’ (যিনাতুল্লাহ) বলতে সৌন্দর্যের এমন উপকরণকে বুঝানো হয়েছে, যা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য তৈরি করেছেন। ‘পবিত্র রিজিকের’ ক্ষেত্রেও একই কথা। এছাড়া আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। সেটি হলো, ‘অলংকার’ শব্দটি ‘আল্লাহ’ শব্দের সাথে সম্পৃক্ত করে সাজসজ্জাকে মর্যাদা দেয়া হয়েছে।

উপর্যুক্ত আয়াত দুটির একটু আগে একই সূরায় পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

يَا بَنِي آدَمَ قَدْ أَنزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُوَارِي سَوْآتِكُمْ وَرِيشًا وَلِبَاسُ التَّقْوَىٰ ذَٰلِكَ خَيْرٌ

হে আদমের সন্তানেরা! আমি তোমাদেরকে পোশাক-পরিচ্ছদ প্রদান করেছি, যেন তোমরা তোমাদের লজ্জাস্থানগুলো ঢেকে রাখতে পারো এবং নিজেদের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে পারো। তবে তাকওয়ার পোশাকই উত্তম। (সূরা আরাফ: ২৬)

আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করে আমাদেরকে যে পোশাক-পরিচ্ছদ দিয়েছেন, আলোচ্য আয়াতে একে কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়েছে। অথবা বলা যায়, আয়াতটিতে পোশাকের কিছু উদ্দেশ্য ঠিক করে দেয়া হয়েছে। আয়াতে ব্যবহৃত ‘যেন তোমরা লজ্জাস্থানগুলো ঢেকে রাখতে পারো’ বাক্যাংশ দ্বারা ‘সতর ঢাকার’ উদ্দেশ্য বুঝানো হয়েছে। আর ‘নিজেদের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে পারো’ বাক্যাংশ থেকে ‘সাজসজ্জার প্রয়োজনীয়তা’ বুঝা যায়। ‘তাকওয়ার পোশাক’[1] এই বাক্যাংশের ব্যবহার থেকে বুঝা যায়, গরম ও ঠাণ্ডা থেকে ‘বেঁচে থাকা’ পোশাকের আরেকটি উদ্দেশ্য।

প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তিরই মানবিকতা, জীবন ও প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের গভীর উপলব্ধি থাকতে হবে:

কোরআন অধ্যয়নকারী মাত্রই জেনে থাকবেন– আকাশ, জমিন, পশুপাখি, মানুষ, এক কথায় মহাবিশ্বের সমস্ত কিছুর মাঝে যে সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে, কোরআন সে সম্পর্কে মুমিনের হৃদয়-মনে উপলব্ধি জাগ্রত করাতে চায়। যেমন আকাশের সৌন্দর্য সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

أَفَلَمْ يَنظُرُوا إِلَى السَّمَاءِ فَوْقَهُمْ كَيْفَ بَنَيْنَاهَا وَزَيَّنَّاهَا وَمَا لَهَا مِن فُرُوجٍ

তারা কি তাদের ওপরের আকাশটার দিকে একটু তাকিয়েও দেখে না যে, কীভাবে আমি একে তৈরি করেছি এবং সুশোভিত করেছি? এর কোথাও তো কোনো ফাটলও নেই। (সূরা ক্বাফ: ৬)

وَلَقَدْ جَعَلْنَا فِي السَّمَاءِ بُرُوجًا وَزَيَّنَّاهَا لِلنَّاظِرِينَ

আর আমি আকাশে তৈরি করে রেখেছি গম্বুজ এবং যারা দেখতে চায়, তাদের জন্য আকাশকে অপূর্ব সাজে সজ্জিত করেছি। (সূরা হিজর: ১৬)

তারপর পৃথিবী ও উদ্ভিদরাজি সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন,

وَالْأَرْضَ مَدَدْنَاهَا وَأَلْقَيْنَا فِيهَا رَوَاسِيَ وَأَنبَتْنَا فِيهَا مِن كُلِّ زَوْجٍ بَهِيجٍ

আর আমি জমিনকে বিছিয়ে দিয়েছি এবং এর মধ্যে স্থাপন করেছি অনড় পাহাড়সমূহ, আবার সেই জমিন থেকেই উদ্গত করেছি নয়নাভিরাম উদ্ভিদরাজি। (সূরা ক্বাফ: ৭)

أَنزَلَ لَكُم مِّنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَنبَتْنَا بِهِ حَدَائِقَ ذَاتَ بَهْجَةٍ

আর তিনি আকাশ থেকে তোমাদের জন্য পানি বর্ষণ করেন এবং তা দিয়ে মনোরম উদ্যান তৈরি করেন। (সূরা নামল: ৬০)

প্রাণীর সৌন্দর্য সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার বক্তব্য একটু আগেই চতুষ্পদ প্রাণীর কথা প্রসংগে উল্লেখ করেছি। সেটি হলো,

وَلَكُمْ فِيهَا جَمَالٌ حِينَ تُرِيحُونَ وَحِينَ تَسْرَحُونَ

তোমরা যখন গোধূলী লগ্নে ওদেরকে ঘরে ফিরিয়ে আনো এবং প্রভাতে চারণভূমিতে নিয়ে যাও, তখন এর মাঝে তোমাদের জন্য রয়েছে সৌন্দর্য। (সূরা নাহল: ৬)

তারপর মানুষের সৌন্দর্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

وَصَوَّرَكُمْ فَأَحْسَنَ صُوَرَكُمْ

অতঃপর তিনি তোমাদের আকৃতি দিয়েছেন এবং আকৃতিকে করেছেন সৌন্দর্যমণ্ডিত। (সূরা তাগাবুন: ৩)

الَّذِي خَلَقَكَ فَسَوَّاكَ فَعَدَلَكَ* فِي أَيِّ صُورَةٍ مَّا شَاءَ رَكَّبَكَ

যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং পরিপূর্ণতা দিয়েছেন ও সুসামঞ্জস্য রূপে গড়ে তুলেছেন। তিনি যেমন চেয়েছেন, ঠিক সেভাবেই তোমাকে গঠন করেছেন। (সূরা ইনফিতার: ৭-৮)

একজন মুমিন এই সুবিশাল মহাবিশ্বের যেদিকেই তাকাবে, সেদিকেই আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি নৈপুণ্য দেখতে পাবে। সৃষ্টির সৌন্দর্যের ভেতর দিয়ে সে আল্লাহর সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারবে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

صُنْعَ اللَّـهِ الَّذِي أَتْقَنَ كُلَّ شَيْءٍ

এটি আল্লাহরই সৃষ্টি নৈপুণ্য, যিনি প্রতিটি জিনিসকে সুনিপুণভাবে তৈরি করেছেন। (সূরা নামল: ৮৮)

الَّذِي أَحْسَنَ كُلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ

যিনি তার প্রত্যেক সৃষ্টিকেই সর্বোত্তম রূপে তৈরি করেছেন। (সূরা সাজদাহ: ৭)

একজন মুমিন তার চারপাশের অস্তিত্বশীল সবকিছুর মধ্যকার সৌন্দর্যকে এ কারণেই ভালোবাসে, যেহেতু তা মহান আল্লাহ তায়ালার সৌন্দর্যেরই নিদর্শন।

একজন মুমিন এ কারণেই সৌন্দর্যকে ভালোবাসে, যেহেতু ‘আল-জামীল’ (চির সুন্দর) নামটি আল্লাহর সুন্দরতম নামসমূহ এবং সুমহান গুণাবলীসমূহের মধ্যে অন্যতম।

মুমিন ব্যক্তির সৌন্দর্যকে ভালোবাসার আরেকটি কারণ হলো স্বয়ং তার প্রভু। যেহেতু তিনি স্বয়ং সুন্দর এবং সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন।

নিশ্চয় আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন:

নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দরতম এবং তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন– এই শিক্ষাই মহানবী (সা) তাঁর সাহাবীদেরকে দিয়েছেন। অথচ অনেকে মনে করে সৌন্দর্যের প্রতি অনুরাগ থাকা বুঝি ঈমানের বিপরীত কিছু; কিংবা সৌন্দর্য চর্চাকারী ব্যক্তি আল্লাহ ও মানুষের কাছে অহংকারী হিসেবে সাব্যস্ত হন। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।

এ সম্পর্কে ইবনে মাস্উদ (রা) বর্ণনা করেছেন: রাসূল (সা) বলেছেন, “যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” তখন এক ব্যক্তি বললো, প্রত্যেকেই তো চায় তার পোশাক-পরিচ্ছদ ও জুতো জোড়া সুন্দর দেখাক (অন্য অর্থে, এই সৌন্দর্য কামনা কি অহংকারের আওতায় পড়বে?– অনুবাদক)। প্রত্যুত্তরে আল্লাহর রাসূল (সা) বললেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দরতম এবং তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন। কিন্তু অহংকার হলো সত্যকে অস্বীকার করা এবং মানুষকে ছোট করে দেখা।”[2]

নিচের লিংক থেকে ডঃ ইউসুফ আল কারযাভির লেখা বই ইসলাম ও শিল্পকলা এর pdf ভার্সন ডাউনলোড করে পড়তে পারেন।
https://cscsebook.files.wordpress.com/2015/07/islam-and-art.pdf
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১১:৩০
৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সত্যি বলছি, চাইবো না

লিখেছেন নওরিন হোসেন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:০৮



সত্যি বলছি, এভাবে আর চাইবো না।
ধূসর মরুর বুকের তপ্ত বালির শপথ ,
বালির গভীরে অবহেলায় লুকানো মৃত পথিকের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কি 'কিংস পার্টি' গঠনের চেষ্টা করছেন ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:১০


শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক সংগঠন টি রাজনৈতিক দল গঠন করবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছেই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্থান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্থান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×