অবিভক্ত বাংলার কৃষক সমাজ যখন অশিক্ষা, দারিদ্র্য, জরাগ্রস্থতা ও কুসংস্কারে নিমজ্জিত, জমিদার মহাজনদের অব্যাহত শোষণে জর্জরিত দিশেহারা, সে ঘোর অন্ধকার যুগে ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়ক বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম স্থপতি, স্বাধীন বাংলার স্বাপ্নিক, হিন্দু মুসলমান মিলনের অগ্রদূত, মুসলিম জাগরণের নেতা, লাহোর প্রস্তাবের উপস্থাপক, শোষিত লাঞ্চিত কৃষক প্রজার মুক্তিদাতা শের-ই-বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জল জোতিষ্করূপে আবির্ভূত হন।
তাঁর রাজনৈতিক সাফল্যের মূলে ছিল হিমালয় সদৃশ্য সুউচ্চ ব্যক্তিত্ব ও অন্যদিকে আবেগ, উচ্ছাস, সরলতা, উদারতা ও সহিঞ্চুতা। এই মহান নেতা আবুল কাসেম ফজলুল হক ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর বৃহত্তর বরিশালের ঝালকাঠী জেলার রাজাপুর থানার সাতুরিয়া গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৌঃ মোহাম্মদ ওয়াজেদ, মাতার নাম বেগম সৈয়দুন্নেসা খাতুন। আবুল কাশেম ফজলুল হকের পিতামহ কাজী আকরাম আলী এবং মাতামহ জিন্নাতুন নেসা। আর তিনি বিপুল বিত্তশালী শিক্ষিত পিতার একমাত্র সন্তান। পারিবারিক ভাবে ঐশ্বর্যের ক্রোড়ে লালিত-পালিত হলেও লেখাপড়ার প্রতি তাঁর অশেষ অনুরাগ ছিল। শৈশবেই তাঁর বাড়িতে চাখারে আরবি, ফার্সি, উর্দু শিক্ষার সূচনা হয়।
চাখার থেকে বরিশাল। বরিশাল জেলা স্কুল থেকে মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির বৃত্তি ও পারিতোষিক সহ প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৮৮৯ সালে। তীক্ষè প্রতিভাধর ও মেধাবী শিক্ষার্থী হওয়ায় পিতা তাকে কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। তখন অশ্বিনী কুমার দত্ত তাঁর পিতার নামে ১৮৮৯ সালে বরিশালে বিএম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ভর্তি না করিয়ে তার পিতা কোলকাতায় ভর্তি করিয়ে থাকার সুব্যবস্থা করেন। গণিত, পদার্থ ও রসায়ন বিষয়ে অনার্স পাশ করেন। বাঙ্গালি মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম তিনটি বিষয় নিয়ে অনার্স পাশ করেন। তুখোড় এ মেধাবী ছাত্রটি ১৮৯৫ সালে অংকে এম.এ.পাশ করেন। আশ্চর্যের বিষয় এই মেধাবী ছাত্রটি অশ্বিনী কুমার দত্তের পিতার নামে গড়া ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপক পদে চাকুরি নেন। বিজ্ঞান বিভাগের এই ছাত্রটি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ জ্ঞান লাভ করেন। ইংরেজি ভাষায় অনর্গল শুদ্ধ বক্তৃতা দিতে পারতেন। তাঁর কন্ঠস্বরে বাংলা ও ইংরেজি ভাষা ছিল অলংকার সমৃদ্ধ। বেশিদিন তিনি বিএম কলেজে অধ্যাপনা করেননি। ১৮৯৭ সালে ইউনিভার্সিটি ল কলেজ থেকে বি.এল. ডিগ্রী লাভের মধ্যদিয়ে শিক্ষা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ঐ বছরই তিনি কোলকাতার স্বনামখ্যাত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সহকর্মী রূপে কোলকাতা হাইকোর্টে যোগদেন।
শুরু হলো তাঁর কর্মজীবন। বড় কঠিন এই কর্মজীবন। শুরুতেই পিতার মৃত্যুর কারণে নিজেদের জমিদারী ও তালুক পরিচালনার জন্য তিনি কোলকাতা ছেড়ে নিজ গ্রাম, নিজ শহর বরিশাল এসে বারে যোগদান করেন। তিনি স্ব চোখে দেখলেন জমিদারের প্রজা পীড়ন ও মহাজনদের শোষণ। এক দিকে অভিজাত শ্রেণি অন্য দিকে কৃষক শ্রমিক শ্রেণি বিশেষ করে কৃষক শ্রেণিকে বিদেশী শাসন ও শোষণ এবং দেশীয় জমিদারদের অবর্ণনীয় অত্যাচার সহ্য করতে হতো। জমির ফসলের সিংহ ভাগ তুলে দিতে হতো জমিদারদের গোলায়। সময়মত খাজনা পরিশোধ না করে বিরোধীতা করলে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হতো। এমনকি তাদেরকে নিজ বাড়ির ভিটা মাটি থেকে উৎখাত করা হতো। তাদের স্ত্রীদেরও শ্লীলতাহানি করতো। তাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারতো না। ইংরেজ সরকার পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে এদেশ শাসন করত।
ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসানের পর অবিভক্ত বাংলা তথা ভারত ইংল্যান্ডের রাণীর শাসনাধীনে চলে যায় এবং এদেশে রাষ্ট্রভাষা ইংরেজি চালু হয়। সুলতান ও মোঘল আমলে রাজ্য ভাষা ছিল ফার্সি। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিহত করার পরে দেশ শাসনের প্রকৃত ক্ষমতা ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যাওয়ায় সে সুযোগে এ দেশে এ ভূখন্ডে একদল জমিদারের সৃষ্টি হয়। এই জমিদাররা কৃষকদের খাজনা বৃদ্ধি বিভিন্ন কর আদায় এমনকি ভূমি থেকে তাদের উৎখাত করতেও পারত। কৃষক সমাজ ভূমির উপর তাদের অধিকার হারিয়ে ফেলে এবং তারা এক সময়ে ভূমিদাসে পরিনত হয়।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা তথা ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক ঐতিহাসিক পটভূমিতে ফজলুল হকের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়।
তাঁর জীবনের দ্বিতীয় পর্বের সূচনা হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মধ্যদিয়ে।
ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহর সাথে বঙ্গভঙ্গের সমর্থনগত তৎপরতার ক্ষেত্রে যে অপূর্ব প্রতিভা ও কর্মদক্ষতার পরিচয় দেন তারই ফলশ্রুতিতে তাঁরই সুপারিশে ফজলুল হককে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকুরি দেন। ঢাকা ও ময়মনসিংহে কিছুদিন চাকুরি করার পর অল্পদিনের মধ্যে নিজ কর্মদক্ষতায় জামালপুরের এসডিও হন। এ সময়ে তিনি সাধারণ বেশে কৃষকদের দুঃখ দুর্দশা নিজ চোখে দেখেছেন। তাই একবার তিনি গাইবান্ধার এক জনসমাবেশে বলেছিলেন-
“সুদুর পাড়া গাঁয়ে খালি লুঙ্গি পরে
আমি কৃষকদের সাথে ধানক্ষেতের আলের উপর
বসে তাদের ডাবা হুকায় তামাক খেতে
খেতে তাদের সব অভাব অভিযোগ শুনতাম।
কৃষক গৃহিনী প্রদত্ত পান্তা ভাত কাঁচামরিচ দিয়ে
যে পরম তৃপ্তির সাথে দিনের পর দিন খেয়েছি
তার স্বাদ আজও আমি ভুলতে পারিনি। কৃষক
প্রজার দুঃখ দুর্দশার কথা আমাকে বই পড়ে
জানতে হয়নি। আমি স্বচক্ষে দেখেছি কোথায় তাদের
অভাব, কোথায় তাদের বেদনা, কৃষক প্রজার দুঃখ
দুর করা আমার আজীবনের স্বপ্ন”।
এক সময়ে ফজলুল হক সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি আর ইংরেজদের গোলামী করবেন না। যার প্রেক্ষিতে কোলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা ও রাজনীতি করার উদ্দেশ্যে স্যার আশুতোষ মুর্খাজীর নির্দেশে ফজলুল হক ১৯১৯ সালে ঢাকা ত্যাগ করেন। তবে তারও আগে ১৯১১ সালে তিনি রাজনীতিতে যোগদেন। ফজলুল হক ছিলেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহর মানসপুত্র। তাঁর সর্বাত্মক তত্ত্বাবধানেই পরবর্তীতে সারা উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে মহীরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয় দলের তিনি নেতা ছিলেন। তার পর তিনি ১৯১৪ সালে কৃষক-প্রজা সমিতি গঠন করেন।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম কৃতিত্ব হলো বাংলার অবহেলিত শোষিত নির্যাতিত কৃষক শ্রমিকদের শিক্ষিত করা। তাঁর রাজনীতির দর্শন ছিল অবহেলিত মুসলিম সম্প্রদায়কে শিক্ষার দিকে অগ্রসর করে নেয়া। ফজলুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। তাঁর অবিরাম চেষ্টা না থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব কাগজে কলমে বন্দী থাকতো এবং কোনদিন আলোর মুখ দেখতো না।
তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়ে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে ১৯২৪ সালে কোলকাতায় সর্ব প্রথম মুসলমানদেন জন্য একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন কিছু জমি খরিদ করে। নামকরণ করেন ইসলামিয়া কলেজ। শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে তিনি আদেশ জারী করেন যে, কোন স্কুলে সরকারি সাহায্য পেতে হলে একজন মুসলমান শিক্ষক ও একজন মৌলভী নিয়োগ করতে হবে। কারণ তখন স্কুল সমূহে হিন্দুদেরই প্রভাব ছিল। তখন মুসলমানরা ইংরেজ শাসন ও ইংরেজ লেখাপড়া থেকে দূরে অবস্থান করছিল। যার লক্ষ্যে ফজলুল হক স্কুল, কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেল কলেজে মুসলমান ছাত্রদের আসন নির্দিষ্ট করে দেন। তারা ভর্তি না হলেও সিট খালি থাকবে। তিনি আরও একধাপ এগিয়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে সমান বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য নামের পরিবর্তে ক্রমিক নম্বর প্রবর্তন করেন। তাঁর প্রচেস্টায় ইলিয়ট হোস্টেল ও টেইলর হোস্টেল, মেডিকেল কলেজ হোস্টেল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেল ও মুসলিম ইনষ্টিটিউট নির্মিত হয়। এ জন্যেই প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি শিক্ষা দপ্তরের ভার নিজ হাতে রাখেন। বরিশাল বিএম কলেজে অধ্যাপনার সময় তিনি ‘বালক’ নামে ছোটদের একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। যা সে সময়ে আলোড়ন সৃস্টি করেছিল। পরবর্তীতে তিনি কোলকাতা থেকে “নবযুগ” নামে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। যা সম্পাদনা করতেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি এবং হাশেম আলী খান পত্রিকার সঠিক উন্নয়নে নজর রাখতেন।
১৯৩৫ সালে সর্বসম্মতিক্রমে কোলকাতা পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ সালে তার দল কৃষক প্রজা পার্টি জয়লাভ করলে তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। মহিলাদের জন্য পৃথক কলেজ না থাকায় বাংলার গভর্ণর লর্ড ব্রাবোর্নের স্ত্রী লেডি ব্রাবোর্নের নামে ১৯৩৯ সালে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ঢাকা ইডেন গার্লস কলেজ ভবন নির্মাণ করেন। বেগম রোকেয়া কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল কলেজটিতে আর্থিক সংকট দেখা দিলে ফজলুল হক স্কুলটিকে সরকারি করণ করেন।
রাজশাহীর চাপাইনবাবগঞ্জ আদিনা ফজলুল হক কলেজ, বরিশালে চাখার ফজলুল হক কলেজ, ঢাকা সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ, সেন্ট্রাল ল’কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য ফজলুল হক মুসলিম হোস্টেল নির্মাণ করেন।
১৯৩৭ সালের ১৫ অক্টোবর লাখনৌ শহরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সম্মেলনে তাঁর অপূর্ব ভাষণ শুনে লাখনৌবাসী তাঁকে শের-ই-বাংলা উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাব উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা সৃষ্টি করেন। তাঁর নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। তিনি তামাম বাংলা নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
এই জনদরদী ও মুক্ত মনের মানুষটি জমিদারী প্রথা উচ্ছেদে ঋণ সালিশী বোর্ড ও প্রজা সমিতি গঠন এবং প্রজাস্বত্ব আইনের মতো সময় উপযোগী ব্যবস্থার প্রবর্তন করে এ ভূখন্ডের লক্ষ লক্ষ নিরীহ গরীব প্রজা, কৃষককে সুদখোর মহাজনদের অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে উদ্ধার করেন। ১৯৪০ সালে মহাজনী আইন পাশ করেন। এ আইনে সুদের উচ্চহার নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। চক্র বৃদ্ধি সুদ বন্ধ করা হয়। কৃষকদের মধ্যে উন্নত বীজ সরবরাহ করে শস্যের গুণগত মান উন্নয়ন ও পাট চাষীদের ন্যায্য মূল্য প্রদানের নিশ্চয়তা প্রদান করেন। পশু সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে উন্নত মানের পশু আমদানী, পশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। ভরাট নদী পুনঃখনন এবং পুকুর সংরক্ষণ করে সেচ ব্যবস্থা উন্নত করেন। সমবায় আইন ও বিধি প্রণীত আজও অক্ষুণ্ণ আছে। তিনি এ উপমহাদেশে সমবায় আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত। হাজার হাজার সমবায় সমিতি গঠিত হয় এবং তা কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে আলোড়নের সৃষ্টি করে। তিনিই প্রথম নারী কর্মচারী ও শ্রমিকদের কল্যাণে ১৯৩৯ সালে ম্যাটারনিটি বেনিফিট এ্যাক্ট বা মাতৃমঙ্গল আইন প্রণয়ন করেন। নারী কর্মজীবীরা সন্তান প্রসবের পূর্বে ১ মাস ও পরে ১ মাস বেতন ভাতাদিসহ ছুটি ভোগে অধিকার লাভ করে। এ ছাড়াও তিনি ১৯৩৮ সালে শিশু শ্রমিকদের কল্যাণে ও শিশু শ্রম বন্দের জন্য শিশু নিয়োগ আইন প্রণয়ন করে ছিলেন। আশ্রয়হীন নারী ও শিশুদের আশ্রয়ের ব্যবস্থাসহ অনেক এতিমখানা তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এক সময়ে বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বর্ধমান হাউজকে বাংলা একাডেমী এবং বাংলা নব বর্ষকে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করেন। তাঁর উদ্যোগে পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে বাংলাভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ ঘোষণা করা হয়। বাংলার আপামর জনগণের নায়ক সম্পর্কে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছিলেন-
“ফজলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত বাঙালি।
সেই সঙ্গে তার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সাচ্চা মুসলমান।”
হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ১৯৫৪ সালে ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন জয়লাভ করলে শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। সেই যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার মধ্যে ছিল গণতন্ত্রের কথা, গণমানুষের কথা। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন জনদরদী ও অসাম্প্রদায়িক। তিনি হিন্দু মুসলমান মিলনের অগ্রদূত। সারা জীবন হিন্দু মুসলমান মিলনের জন্য তিনি চেষ্টা করেছেন। হিন্দু মুসলমানদের সম্প্রীতি রক্ষার জন্য ১৯১৬ সালে লাখনৌ প্যাক্ট এবং ১৯২৩ সালে বেঙ্গল প্যাক্ট প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
শের-ই-বাংলা ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ। একজন শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক, একজন সেরা সংস্কারক, একজন সেরা আইনজীবী। সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ। ১৯১৩ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত আইন সভায় সদস্য ছিলেন। সূদীর্ঘ ৪৬ বছর রাজনীতি করার পর তিনি স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু সমাজসেবা থেকে তিনি কখনো বিদায় নেননি। করোনারী থ্রোমবসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় তাঁর হাটখোলা শামীবাগের বাসা থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন ১৯৫৭ সালে। দু কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শুক্রবার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে চিকিৎসারত অবস্থায় ৮৯ বছর ৬ মাস বয়সে ইন্তেকাল করেন।
ঢাকা হাইকোর্টে মাজারের কাছে ও বাংলা একাডেমির সংলগ্ন স্থানে শের-ই-বাংলা ফজলুল হক চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। এটি এখন তিন নেতার মাজার নামে খ্যাত। এখানে প্রতিদিন পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত হয় ফজর বাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১:২৫