শিক্ষার প্রতিবন্ধকতা ও উওরোণ
--------------------------------------
নোপোলিয়ন বোনাপার্ট যথার্থই বলেছিলেন যে,''তোমরা আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিব''।শিক্ষা ছাড়া কোন কালে কোন জাতি উন্নতির চরম শিখরে উঠতে পারে না একথা সর্বজনবিদিত।শিক্ষা প্রত্যেকটি মানুষের জন্মগত মৌলিক অধিকার।নাগরিকের শিক্ষা গ্রহনে সুযোগ তৈরি ও শিক্ষা গ্রহনের মধ্যে দিয়ে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা প্রত্যেক রাষ্ট্রের ঐকান্তিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।রাষ্ট্র কখনোই এ দায়িত্ব এড়াতে পারে না।বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামুলক করা হয়েছে যা,উন্নত চেতনা সম্পূর্ণ নাগরিক তৈরিতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপের একটি বিশেষ অংশ।আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান উন্নয়নে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানাই।এতে করে শিক্ষার যে মান তা উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।তবে আমরা যদি শহর ও গ্রামীণ পর্যায়ের শিক্ষার মধ্যে তুলনা করি তবে বিস্তর ফারাক লক্ষ্যণীয় হবে।কেননা বর্তমান সময়ে এসেও শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোর চাইতে গ্রামীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলো অনেক পিছিয়ে রয়েছে।যদিও ফলাফল বিচারে দু একটি প্রতিষ্ঠান যে ভালো করছে না, তা কিন্তু নয়! কিন্তু সেটা বৃহৎ সংখ্যার তুলনায় খুবই নগন্য।এছাড়াও গ্রামীন পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ।অবকাঠামোগত অসুবিধা,প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরনের অপ্রতুলতা,শিক্ষক সংকট সহ নানামুখী সংকট তো রয়েছেই।অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবার পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক থাকলেও মানসম্মত যোগ্য শিক্ষক খুজে পাওয়া প্রায় দুরহ ব্যাপার।এ ব্যপারে আসলে সরকারের কার্যকরি ভুমিকা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যাচ্ছে।আমরা প্রত্যেক্ষ করছি প্রতি বছরই শিক্ষক সংকট দূরীকরনে সরকারের শিক্ষক নিয়োগ থেকে থেকে শুরু করে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহন করছে।কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন কথা বলে।শিক্ষক অল্প হলেও ঠিকই পাচ্ছি ,কিন্তু মানসম্মত শিক্ষক পাচ্ছি না।যা জাতির জন্য অদূর ভবিষ্যতে অশণী সংকেত।আমাদের প্রশ্ন কেন এই সমস্যা? আসলে একজন শিক্ষককে পাঠদানে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে চাই উপযুক্ত প্রশিক্ষণ।যদিও নিয়মিত প্রশিক্ষণ যে হচ্ছে না ,তা কিন্তু নয়! তবে সেখানেও একটি প্রশ্নের তীর বিদ্ধ।আসলেই কি প্রশিক্ষনের নামে শিক্ষককে যথাযথ কারিকুলামে প্রশিক্ষিত করা হয়?হয়না।কয়েকজন শিক্ষক কে বেশ ব্যাথিত সুরেই বলতে শুনেছি,ওখানে প্রশিক্ষন কেন্দ্রে শিখনের চাইতে নাকি বনভোজনের বিষয়টাই অধিক গুরুত্ব পায়।সরকারকে এই বিষয়ে গুরুত্বের সহিত যথাযথ দৃষ্টি দেয়ার আহ্ববান জানাই।আমরা যদি যথার্থ মানসম্পূর্ণ শিক্ষক তৈরি করতে না পারি তবে এই অকর্মণ্যদের থেকে আমা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি শিখবে?এটা তো গেলো একটা দিক ।এরকম হাজারো দিক রয়েছে।উদ্র্ধতন কর্তৃপক্ষ যতোই দাবি করুক না কেন যে,তারা অনেক সফল,হ্যাঁ সেই সফলতা শহর কেন্দ্রীক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে হতে পারে!কিন্তু গ্রামীন?গ্রামীন পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো মূলধারায় আসতে পারেনি।যার বাস্তব প্রত্যেক্ষ করছি ,আমরা প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে।শহরের শিক্ষার পরিবেশ থেকে গ্রামীন পর্যায়ে শিক্ষার পরিবেশে সংকট অনেক।আর চরাঞ্চলে শিক্ষার উপযুক্ত কোন পরিবেশই নেই।সেখানে শুধু কাগজে কলমে শিক্ষক রয়েছে। বাস্তবে প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ক্লাসে দেখা পাওয়া ভার।কেননা তারা সবাই নিজেদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারে শহর কেন্দ্রীক।ঐ চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের কোন ভাবনা নেই।তারা চরের কিছু নবম দশম নতুবা সদ্য এস এস সি পাশকৃত বেকারদের মাসিক কিছু অর্থের বিনিময়ে নিজেরাই নিয়োগকর্তা সেজে বসে থাকেন।মাসে অথবা সপ্তাহে দু একদিন প্রতিষ্ঠানে যান পরিদর্শণ করতে।এছাড়া উপ-বৃত্তির টাকা বিতরনে নানা অনিয়ম বা অভিযোগ তো রয়েছেই।উপ-বৃত্তির টাকা তুলতে নাকি জনপ্রতি ১০টাকা স্বাক্ষর ফি দিতে হয়।এমন নিয়ম সরকার নির্ধারিত কি না আমাদের জানা নেই।এই হলো শহর,গ্রামীন,চরাঞ্চল শিক্ষা ব্যাবস্থা।যদিও এটাকে আমরা সরাসরি শিক্ষা সংকট হিসেবে আখ্যায়িত করতে নারাজ।কেননা শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার।তবে এসব সমস্যাকে সরাসরি শিক্ষা সংকট না বলে আমরা বলতে পারি শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি জটিল প্রতিবন্ধকতা।যা দূরীকরণ অত্যন্ত জরুরী।কেননা একজন শিক্ষার্থীর যদি প্রাথমিক অবস্থা থেকে তার অন্তরে সু-শিক্ষার বীজ রোপীত না হয় তাহলে তা মাধ্যমিক বা উচ্চ পর্যায়ে রোপন প্রায় অসম্ভব।আর এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পালন করতে পারেন একমাত্র শিক্ষক।তবে শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দোষারোপ করলেই যথার্থ হবে না।কেননা গ্রামীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে নেই শিক্ষার্থী অনুপাতে পর্যাপ্ত শিক্ষক,আধুনিক অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরন।প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের একটি অভিযোগ প্রায়ই শুনতে পাই যে,তাদের ছেলেমেয়েরা প্রয়োজনীয় আধুনিক শিক্ষা উপকরন থেকে বরাবরই বঞ্চিত।অভিযোগটি প্রায় সত্য।
কেননা আমরা দেখেছি একটি শহরের স্কুল শিক্ষার্থীরা পড়াশুনার পাশাপাশি অন্যান্য শিক্ষা উপকরন যেমন, কম্পিউটার,পিয়ানো,ইন্টারনেট,মাল্টিমিডিয়া ক্লাস ব্যবস্থা,খেলাধুলার আধুনিক সরঞ্ছাম ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারে।তারা মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে বসে ক্লাস করে।একজন শহরের শিক্ষার্থী যখন স্কুলে বসে পিয়ানো বাজায় তখন একজন গ্রামীণ শিক্ষার্থী খাতা কলেমের জন্য বাবা মায়ের কাছে কান্না করে।যখন তারা ফ্যাণ কিংবা এসিরুমে বসে ক্লাস করে তখন একজন গ্রামের শিক্ষার্থীকে খোলা আকাশের নিচে পাঠ শুনতে হয়।কোথাও কোথাও আবার বসার মতো ব্রেঞ্চও নেই।বর্তমানে সরকার যথেষ্ঠ আন্তরিকতার সহিত প্রত্যেকটি স্কুলে কম্পিউটার শিখনের ব্যবস্থা করেছে।কিন্তু ঐ কম্পিউটার শিক্ষার্থীদের কোন উপকারে না এসে বরং ঐ প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের মিডিয়া প্লেয়ার বা গান শোনার যন্ত্র হিসেবে ব্যাবহূত হচ্ছে।শেখা তো দূরের কথা কম্পিউটার ছুয়ে দেখারও অধিকার নেই শিক্ষার্থীদের।এখানেও কর্তৃপক্ষের মনিটরিং এর বড় অভাব।এসব সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনিটরিং ব্যবস্থা আরো জোরদার করতে হবে।এসব নানামুখী অভিযোগ নিয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে গেলে তারা শুধু হাফ ছেড়ে একটি কথাই বলেন যে,তাদের যথেষ্ট লোকবলের অভাব।আমরা জানিনা কবে এই লোকবলের অভাব পূরন হবে।এটাতো গেলো একটা স্বাভাবিক দিক।গ্রামীন শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়ার পেছনে
সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে অশিক্ষার হার,অসচেতনতা,ও দারিদ্রতা।গ্রামীন পর্যায়ের অধিকাংশ অভিবাবকেরা অশিক্ষিত ও অসচেতন।এছাড়া দারিদ্রতা তো তাদের নিত্য সঙ্গী।অসচেতনতার কারনে এখনো গ্রামের অনেক ছেলে মেয়ে স্কুল মুখাপেক্ষী নয়।অভিবাবকদেরও এতে কোন মাথা ব্যাথা নেই।তাদের চিন্তা একটাই কোন রকম দু চার লাইন শিখিয়ে ছেলে হলে উপার্জন, আর মেয়ে হলে বিয়ে দেয়াই তাদের প্রধান কর্তব্য বলে মনে করেন।এ বাস্তব চিত্র এখনো বিদ্যামান।আর বাল্য বিয়ের একমাত্র কারন হিসেবে আমরা দারিদ্রতাকেই প্রত্যেক্ষ করেছি।যদিও সরকার গ্রামীন স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়া রোধের ক্ষেত্রে উপ-বৃত্তি চালু রেখেছে তথাপি সেটা ঐ এলাকার দারিদ্রতার প্রেক্ষাপটে খুবই নগন্য।প্রাথমিক পর্যায়ের অনেক শিক্ষকই মনে করেন যে, বর্তমানে যে সৃজনশীল পাঠ্যক্রম তা তাদের গ্রামীন ছেলেমেয়েদের উপযোগী নয়।কেননা একজন শহরের শিক্ষার্থী স্কুলে যাওয়ার আগেই তার পরিবার থেকে অক্ষরঙ্গান লাভ করে।কিন্তু গ্রামীন পরিবেশ ভিন্ন।এখানে অভিবাবকেরা অশিক্ষিত হওয়ায় ছেলে মেয়েদের ৬-৭ বছর বয়সে বিদ্যালয়ে এসে অক্ষরঙ্গান নিতে হয়।কিন্তু সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে ২য় শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীকে শব্দার্থ বা বাক্যগঠন করতে হয়।যেখানে শিক্ষার্থীরা অক্ষরঙ্গানই জানে না ,সেখানে তারা কিভাবে শব্দের অর্থ বা বাক্য গঠনের মতো জটিল কাজটি করতে পারবে।বর্তমান সময়ে এসে আমরা আরো একটি বিষয় লক্ষ্যে করছি।অসুস্থ্য রাজনীতির বলি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলো।এই সমস্যা এখন শহর ছাড়িয়ে গ্রামেও প্রকপ আকার ধারন করেছে।যার ফলশ্রুতিতে প্রাথমিক ক্ষেত্রে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।উদাহরন হিসেবে আমরা বলতে পারি বগুড়া জেলার সোনাতলা উপজেলাধীন আড়িয়াচকনন্দন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা(বর্তমানে এডহক কমিটি দ্বারা কার্যক্রম চলছে)।শুধুমাত্র অসুস্থ্য রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি হয়ে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।তাদের দুরাবস্থার কথা শোনার মতো কেউ নেই।এর ফলে স্কুল পরিচালনা কমিটি কোন কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারছে না।তাই আমরা বলতে চাই অন্তত গ্রামীন প্রাথমিক স্কুলগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে যেন অসুস্থ্য রাজনীতির চর্চা বন্ধে সরকার যথেষ্ঠ আন্তরিকতার পরিচয় দেয়।নতুবা অদূর ভবিষ্যতে এর ফলাফল জাতি গঠনে মারাত্নক বিরুপ প্রভাব ফেলবে।এছাড়া গ্রামীন পরিবেশ উপযোগী পাঠ্যপুস্তক ও উপকরন প্রদান,মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার,বছরের শুরু ও শেষে প্রচারনার ব্যবস্থা,স্কুল পরিচালনা কমিটির কার্যকরি ভূমিকা পালনের মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায় হতে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়া রোধে মনিটরিং সহ অবকাঠামোগত সুবিধা প্রদান,শিক্ষকদে যথাযথ কারিকুলামে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষক তৈরি,দরিদ্র এলাকা বিবেচনায় উপ-বৃত্তির পাশাপশি অন্যান্য শিক্ষা প্রনোদনা প্রদান করতে হবে।তবেই গ্রামীন শিক্ষা অগ্রযাত্রার পথে যে জটিল প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা উওরন সম্ভব বলে আমরা মনে করি।এসব বাধা উত্তরনে শিক্ষকদেরও যথেষ্ট আন্তরিকতার পরিচয় দিতে হবে।