
*
অনেক কষ্টে শোয়া থেকে ওঠেন সাহেলা বেগম। বাতের ব্যথাটা বেড়েছে, মাইগ্রেনের ব্যথাও। কাল রাত থেকে আবার প্রেসারটা লো হয়েছে। দুপুর থেকে শুয়ে আছেন। উঠে দাঁড়ানোর মত শক্তিও নেই শরীরে। মেয়েকে বলেছিলেন রান্না-বান্নাটা একটু দেখতে, রাতেতো খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। তখন থেকে ডেকেই যাচ্ছেন, ‘রুবা, রুবা, রুবা.......’ মেয়ের কোন খবর নাই। দাঁতে দাঁত চেপে হেঁটে আসেন বাসার আরেক মাথায় মেয়ের ঘরে। আইপডে গান শুনছে রুবা, হাতে একটা গল্পের বই। রাগে চিৎকার করেন সাহেলা। ‘ওই, কোন সময় থেইকা ডাকতাছি! কানের মধ্যে একটা মুন্ডু লাগায় রাখছস।’
ভুরু কুঁচকে তাকায় রুবা, ‘কেন কি হইছে?’
‘ভাত বসাইছিলি?’
‘হুম।’
‘ডাইল?’
‘আম্মা, ভাত, ডল, তরকারি সবকিছুই করা হইছে। তোমার শরীর খারাপ তুমি শুয়ে থাক যাও। এতকিছু তোমার চিন্তা করতে হবে না।’ রুবার গলায় বিরক্তি। মেয়েকে কিছু করার কথা বলতেও ভয় লাগে। সারাদিন অফিস করে আসে, ক্লান্ত থাকে। মেজাজ-মর্জির ঠিক ঠিকানা পাওয়া যায় না। একেবারে না পারতে মেয়েকে কোন কাজের কথা বলেন না। কিন্তু মেয়ের এই চেহারাও সহ্য করতে পারেন না। নিজের অক্ষমতাই স্পষ্ট হয়ে উঠে। ঝাঝিয়ে উঠেন, ‘এত মেজাজ করার কি হইছে? পারলে কি আর তোরে বলি। প্রত্যেকদিনই তো তৈয়ার কইরা খাওয়াই। একদিন নিজে কইরা দেখ কেমন লাগে।’
রুবা কিছু বলে না। আস্তে উঠে রান্নাঘরে চলে যায়। কি জানি সব খুটখাট করে।
সাহেলা বেগম মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবেন এই মেয়েটা আমার? এত দূরের, এত দুর্ভেদ্য! তিনি কিছুতেই মেয়ের মনের তল খুঁজে পান না।
ওরা বড় হয়ে গেছে, ওদের একটা আলাদা জগৎ হয়েছে। সেখানে তিনি প্রবেশ করতে পারেন না। সামনে দাঁড়িয়ে সবই দেখেন কিন্তু স্বচ্ছ একটা দেয়ালের ওপাশে যেতে পারেন না। দু’ভাই-বোনে মাঝে মাঝে বসে কুটকুট করে কত কথা বলে, হাসাহাসি করে। তিনি গিয়ে জিজ্ঞেস করেন কি হল। ওরা মাথা নাড়ে, না কিছু না। মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেট কতকিছু আবিস্কার হয়েছে এখন। তিনি এসব কিছুই বোে ঝন না। ছেলে-মেয়ে আর তাদের বাবার কথা অবাক হয়ে শোনেন। বোকার মত একটা কিছু বলে ফেললে সবাই হেসে গড়ায়। রুবা নয়তো রবিন মাথা নেড়ে বলে, ‘আম্মা, এইরকম না। তুমি বুঝবা না।’
তিনি বুঝবেন না। তিনি বুঝেন না। বোঝালেও না। শুধু দূর থেকে দেখেন তাঁর নাড়ির ধনেরা কত অচেনা হয়ে গেছে। বিশেষ করে মেয়েটা। এত চাপা স্বভাব! কখনো কোন কথা বলবে না, কোন সুবিধা-অসুবিধার কথা জানাবে না, কোথায় কি ঘটছে, কি করছে কিছুই বলবে না। সব নিজের মধ্যে চেপে রেখে দিবে। মেয়েকে বোঝেন না, তাই ভয় পান। ভয় পান মেয়ে কোন ভুল করবে, কষ্ট পাবে এই ভেবে। কিন্তু নিজের এই ভয়টা প্রকাশ করতে পারেন না, উল্টে রাগারাগি করেন। মেয়ে আরো দূরে সরে যায়।
***
মাথা ঝিম ধরে আছে। রুবার বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ঝিমান সাহেলা বেগম আর আবছা আবছা মাথায় হাজারটা চিন্তা খেলা করে যায়। কিছুক্ষণ পরে সম্বিত ফেরে রুবার ডাক শুনে। ‘চল আম্মা, ভাত বাড়ছি। খাইতে চল।’
খেতে বসেন সাহেলা। টেবিলের চারদিকে চারজন বসেছে। রাতের খাবারের সময়টাতেই শুধু ঘরের সবাই একসাথে হয়, কথা হয়, সারাদিনে কে কি করল বলাবলি। রুবা নিজেই বলল, ‘আম্মার তো একটা ডাক্তার দেখানো দরকার। এইরকম অসুস্থ হয়ে থাকলে কেমন লাগে?’
‘সমস্যাতো একটা না, কোনটার জন্য দেখাবি?’ রুবার আব্বা জিজ্ঞাসা করেন। ‘তোমার কোনটা বেশি জরুরি?’ মেয়ের প্রশ্ন শুনে একটু ভাবেন সাহেলা। এখন ডাক্তার দেখানো মানে এতগুলো টাকা খরচ হওয়া। মাসের মাঝখানে এই খরচটা করে কুলাবে তো? কিন্তু শরীরের যে অবস্থা, চলাফেরা করাইতো মুশকিল হয়ে গেছে। তিনি মাথাব্যথার কথাই প্রথমে বলেন। সাথে সাথে মেয়ের বাবা রায় দিয়ে দেন, ‘তাইলে রুবা, কালকে সন্ধ্যায় তুই তোর আম্মাকে নিয়ে যাইস ফার্মগেটে, ডাক্তার জুয়েলের কাছে।’
‘কখন, আমার অফিস আছে না?’
‘একটু আগে বের হবি।’
‘তাইলে আম্মা, তুমি ফার্মগেট চলে আইস, আমি ওদিক থেকে চলে আসবো।’
সাহেলা বেগমের বিপদে পড়া চেহারা হয়। ‘ফার্মগেটে যেই ভিড়। আমি পারবো না একলা একলা রাস্তা পার হইতে।’
‘তুই একটু আগে বাইর হইয়া বাসায় আইসা নিয়া যাইস। তোর আম্মা একা যাইতে পারবে না।’ রুবার বাবা বলেন। রুবা কিছুক্ষণ গাই-গুই করলেও শেষ পর্যন্ত রাজি হয়।
পরদিন ঠিকই আগে আগে চলে আসে রুবা অফিস থেকে। মাকে নিয়ে আবার বের হয়। ফার্মগেটে পৌঁছে গাড়ির ভিড় ঠেলে রাস্তা পার হতে বিপদে পড়ে যান সাহেলা। একটা সিগনাল পড়তেই মেয়ে অভ্যস্ত পায়ে তরতর করে এগিয়ে যায়। কিন্তু তিনি দাঁড়িয়ে মেয়েকে ডাকতে থাকেন। রুবা আবার ফেরে, মুখে ‘আহা, ছেলেমানুষ’ ধরনের একটা হাসি। ফিরে এসে এক হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে এগোয় রুবা, বিপরীত থেকে আসতে থাকা গাড়িগুলোকে হাতের ইশারায় থামতে বলে। রাস্তা পার হয়েও ছেড়ে দেয় না, বাকি পথটুকু ধরে ধরে নিয়ে যায়। ‘এই রুবা, যখন ছোট্টটা ছিল, এইভাবে ধরে ধরে রাস্তায় হাঁটতে হতো। রাস্তায় বেরুলেই ভয়ে সারাক্ষণ গা ঘেষে থাকতো। রিকশায় বসে সাহেলা একহাত সামনে দিয়ে হুডটা ধরে মেে কে আগলে রাখতেন।’ অথচ এখন মেয়েই কেমন আগলে নিয়ে যাচ্ছে তাঁকে।
ডাক্তারের চেম্বারে লম্বা সিরিয়াল। রুবা উশখুশ করছে। মেয়েটা রোগী, ডাক্তার, হাসপাতাল একদম সহ্য করতে পারেনা। ‘আম্মা, তুমি কেন সকালবেলা ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখলা না?’ এই নিয়ে তিনবার বলল রুবা কথাটা। সাহেলা কিছু বলেন না। সারাদিনে তাঁর মাথায় এটা কাজই করে নাই। সময় কাটাতে মেয়েকে বলেন, ‘আচ্ছা, মোবাইলে কেমনে কি করে একটু শিখায়া দে তো ততক্ষণে।’ যোগাযোগ রাখার জন্য তাঁকে একটা মোবাইল দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেন না। রুবা মোবাইল বের করে শেখায়। ‘এই সবুজটা দিয়ে ফোন যাবে, আর লালটা দিয়ে লাইন কাটবে। আর দেখো এইটা হচ্ছে মেনু, এখান থেকে ফোনবুকে যাবা। তারপর অক্ষর ধরে ধরে নাম বের করবা।’ কিন্তু একটু এগিয়ে পিছনের সব ভুলে যান সাহেলা। চোখ ঝিলমিল করে। তিনি বলেন, ‘মাগো, আমি পারতাম না এতসব। থাক, রাইখা দে। আমার ফোন ধরতে পারলেই হইল।’ রুবা হাসে, ‘তাহলে তো আবার ওইরকম ঠকাবে দেখবা।’ একদিন মোবাইলে কে যেন ফোন করে বলেছিল আপনি একটা প্রতিযোগিতায় জিতে পঞ্চাশ হাজার টাকা পেয়েছেন। সারাদিন তো সাহেলা সেই টাকা দিয়ে কি করবেন তার কত পরিকল্পনা করেছেন। সন্ধ্যায় সবাই বাসায় ফিরতে খুব উত্তেজিত হয়ে জানালেন। কিন্তু ছেলে, মেয়ে, তাদের বাবা এমন হাসতে লাগল তাঁকে নিয়ে। ‘আম্মা, এগুলা সব ভুয়া। টাকা ট্রান্সফারের জন্য তুমি তোমার একাউন্ট নাম্বার দিবা, তোমার একাউন্টে যত টাকা আছে তারা সব নিয়ে নিবে।’ এত হতাশ হয়েছিলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটু একটু লজ্জা পান সাহেলা, আবার ভালও লাগে। মেয়েটাকে অনেক আপন মনে হচ্ছে এখন।
*****
রুবার বিয়ে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত সাহেলা। এত পড়ালেখা করল, ভাল চাকরি করছে অথচ ভাল একটা ছেলে পাওয়া যায় না। আর মেয়েরও যেন কি। কিছুই তার পছন্দ হয় না। কেন যে হয় না, সাহেলা তার কোন কূল কিনারা করতে পারেন না। তাঁর মেয়েতো আল্লাহর রহমতে দেখতে খারাপ না, পড়ালেখা, কাজকর্ম সবদিক থেকেই অনেক এগুনো। তারপরও.........একটা অজানা আশঙ্কা হয় তাঁর মনে। কেউ তুকতাক করে নাইতো! কোন যাদু-টোনা! মানুষকে তো বিশ্বাস নাই। তিনি কত হুজুর-কবিরাজ করলেন, তাবিজ, পানিপড়া তাও দিলেন এনে মেয়েকে। পছন্দ না করলেও মায়ের জন্য মেয়ে সবই করেছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। কিছুদিন আগে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে একটা ছেলের ব্যাপারে কথা বলছেন। দেখাও করতে গেছেন মেয়েকে নিয়ে। চেহারা, কথায় তাঁদের দুজনের তো খুবই পছন্দ হয়েছে। কিন্তু রুবার পছন্দ হয় না। ছেলে নাকি কি ইঙ্গিত করে কথা বলছে। কিছুতেই বলবে না কি, কিন্তু কিছুতে রাজিও হবে না। তাই নিয়ে আজ মেয়ের সাথে ঝগড়া। রেগে-মেগে সাহেলা বলেছেন, ‘আমি কি তোর খারাপ চাই? ভাল বুইঝাই তো বলছি।’
রুবা ঠান্ডা গলায় উত্তর দিয়েছে, ‘আমি বলছি ওই লোক ভাল না, আমার পছন্দ হয় নাই। তুমি কেন আমাকে জোর করতেছো? একটা অসভ্য টাইপের লোক!’
সাহেলা আরো রেগে যান, ‘সভ্য-অসভ্য তোর কাছে শিখতে হবে।’
‘হ্যাঁ, আম্মা। তোমার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ দেখছি আমি। আমি জানি।’
সাঁ করে মাথায় রাগ চড়ে গেল সাহেলা বেগমের। ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলেন ধাড়ি মেয়ের গালে। ‘এমন একটা ভঙ্গি করতেছোস আমি তোর সৎ মা। তোর পেটে আমি হইছি না আমার পেটে তুই হইছোস? তুই আমার চেয়ে বেশি জানস।’ মেয়ে কিছু বলে না। বসে বসে ফুসতে থাকে। আর সাহেলা রাগে গজগজ করতেই থাকেন, ‘কত কষ্ট করছি তোর জন্মের সময়। ভাদ্র মাসের বৃষ্টি, সারারাত তোকে পেটে নিয়া মাটিতে শুইয়া ছিলাম। সারারাত যন্ত্রণার পরে সকালবেলা তোর জন্ম হইছে। তুই আমার আত্মার আত্মা, নাড়ি ছেঁড়া ধন। জন্ম থেইকা তুই আমারে জ্বালাইতেছোস। আল্লাহ করুক, যত কষ্ট তুই আমারে দিছোস তারচেয়ে বেশি কষ্ট তোর পোলাপান তোরে দিবো।’
*******
সারারাত ছটফট করলেন সাহেলা। রাগের মাথায় মেয়েটাকে কত বড় কথা বলে ফেলেছেন। সারাক্ষণ আল্লাহর কাছে চাইলেন, ‘আল্লাহ, তুমি আমার কথা ফিরায়ে নেও। আমার মেয়েটা যেন ভাল থাকে সবসময়।’
এত জেদ মেয়ের, এত অভিমান! কিভাবে এই মেয়ে সংসার করবে সাহেলা ভেবে পান না। মেয়েকে নিয়ে যে তাঁর কত চিন্তা হয়।
শুক্রবার বলে সকালে সবাই বাসায়। রুবা সেই থমথমে মুখেই বসে আছে। সাহেলা বেগম একটু পর পর ঘুরে ফিরে আসেন রুবার সামনে দিয়ে। অকারণেই কিছু একটা কথা বলেন। কিন্তু মেয়েটা মুখ কঠিন করে আছে। একটু তাকায় না, কথা বলে না, হাসে না। তাঁর ভীষণ অস্থির লাগে। কিন্তু কিছু বলতেও পারেন না। শরীর ভাল না বলে রান্না শেষ করতে দেরি হয়। রবিন আর তার বাবা নামাজে চলে যায়। সাহেলা রুবাকে ডাকেন বাকি রান্নাটা একটু দেখতে। রুবা আসে, কাজ করে। সাহেলা নিজের মনেই কথা বলে যান, ‘কেন এত রাগ করিস? আমিতো তোর মা, আমার কত অশান্তি হয় বুঝস? আমি কি তোর কোন খারাপ চাই! আমি না হয় রাগের মাথায় বলছিই, তুই মুখে মুখে কথা বলবি? আমার কষ্ট হয় না?’
‘কষ্ট তোমার একার হয়, আমার হয় না? তুমি কেমনে বলতে পারলা তুমি আমার সৎ মা? কেমনে বলতে পারলা আমি যেন কষ্টে থাকি?’ গলা বুজে আসে রুবার। চোখে পানি টলটল। সাহেলাও কেঁদে ফেলেন। উঠে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন। কিছু বলতে চান, কিন্তু পারেন না। মায়ের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে রুবা। সাহেলা আলতো হাতে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দেন, ‘তুই আমার আত্মার আত্মা, নাড়ি ছেঁড়া ধন। আমি কি তোর কোন ক্ষতি চাইতে পারি?’ অস্ফুটে বারবার এই কথাটাই বলতে থাকেন।
............... .................. .......................
আমার মামনিকে, জন্ম থেকে যাঁকে আমি জ্বালাচ্ছি। সময়, নাকি বয়স, নাকি আমার নিজের কারণেই অনেক অনেক দূরে সরে গেছি তাঁর কাছ থেকে। খুব ইচ্ছা হলেও আমার অনেক কষ্টের মূহুর্তগুলোয় তাঁর কাছে যেতে পারি না। একটু বুকে মাথা রেখে কাঁদতে পারি না। আমার বোকা-সোকা মামনি হয়তো কখনো এই লেখাটা পড়বেন না। কিন্তু তাঁকে আমি জানাতে চাই তাঁর কাছে যেতে আমার ভীষণ ইচ্ছা হয়, একটু জড়িয়ে ধরতে, বুকে মুখ গুঁজে থাকতে..........
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০১১ রাত ১১:১৫