প্রোডাকশন হাউসঃ জিবলী
ডিরেক্টরঃ হায়ায়ো মিয়াজাকি
একটা দৃশ্যর কথা চিন্তা করুন। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের হাতছানি শুরু হল মাত্র। হাতের কাজ শেষ করে সব কিছু গুছিয়ে নিচ্ছেন, বাড়ি ফিরবেন বলে। হটাত করেই ঈশান কোণে অদ্ভুত এক আলো দেখতে পেলেন। খানিকটা কৌতুহল নিয়েই আলোর উৎসের কাছাকাছি হতেই দেখতে পেলেন আকাশ থেকে নেমে আসছে ছোট একটা মেয়ে। তার গলায় জ্বলজ্বল করছে উজ্জ্বল এক মণীহার, যেটা মেয়েটাকে ধীরে ধীরে ভাসিয়ে নামাচ্ছে। দস্যুদল আর সেনাবাহিনী - সবাইই তাড়া করে ফিরছে মেয়েটিকে। কারণ মেয়েটির কাছে আছে আকাশে ভেসে বেড়ানো স্বপ্নের এক জগতের চাবিকাঠি; যে জগত অসীম ধনসম্পদের হাতছানি দেয় নিরন্তর।
ঠিক এমনই এক দৃশ্যপটকে ঘিরে শুরু হয় "Laputa: Castle in the sky" এর কাহিনী। ছোট্ট মেয়েটি শীলা, এবং তাকে উদ্ধার করা ছেলেটি পাযু। সেনাবাহিনী এবং জলদস্যু - দু'দলের ধাওয়া পালটা ধাওয়া, লাপুতার খোঁজ এবং শীলা পাযুর অভিযানের গল্প মিয়াজাকির এ মুভিটি।
লাপুতার জগত স্পর্শ করেছে অনেক কিছুই - যাদু থেকে উন্নত বিজ্ঞান; খুন কিংবা দস্যুতা; ছিল জোনাথন সুইফট থেকে লুইস স্টিভেনসন কিংবা হিন্দু পুরান থেকে শুরু করে বাইবেলের শ্রুতির রেফারেন্সও। রামায়ণের ইন্দ্রর তীর কিংবা ব্রিটিশ মাইনিং এর শহর; অথবা ইউরোপীয় ঘরানার দুর্গের ডিজাইন - মিয়াজাকি মুভিতে একগাদা রেফারেন্স ব্যাবহার করেছেন নিপুণ দক্ষতায়।
ম্যাজিক মুভির একটা বিরাট ফ্যাক্টর হলেও শুরুর অর্ধেক অংশ তা থেকে কম বেশি মুক্ত ছিল। এবং এ অংশে মুভিটা বেশি আকর্ষণীয়ও ছিল; অসাধারণ কিছুর জন্য না; বরং ছিমছাম সাধারণত্বে; স্বভাবী কিছু চরিত্রের গুণে। ছোটবেলায় বাবা মা হারানো খনিতে কাজ করা পাযু এমন এক এলাকায় থাকে যেখানকার লোকজন নিজেদের স্বার্থেই কম্যুনিটিকে সবার আগে জায়গা দেয়; বিরাট কষ্ট আর পরিশ্রমের মাঝেও তারা সুখী। ঘটনাক্রমে পাযু জড়িয়ে পরে এমন এক ঘটনায়; যা তার বহুদিনের দেখা স্বপ্নের রাস্তাতেই তাকে দাঁড় করিয়ে দেয়।
বৃহত্তর গন্ডীতে লাপুতা আমাদের জীবনেরই গল্প; শীতা এবং পাযুকে আমরা পাই শত লোভ, স্বার্থপরতা আর ক্ষমতার দড়ি টানাটানির মাঝেও নিজেদের নিষ্পাপ সত্তা ধরে রাখতে; অন্যদিকে মুস্কা এবং সেনাবাহিনী যেন মনের অন্ধকার জগতের প্রতিচ্ছবি। এর মাঝে সবচেয়ে বাস্তব চরিত্র বোধহয় দস্যুদল; বিশেষ করে তাদের লিডার ডোরা। এরা সম্পদ লুটে নেবার জন্য ঘুরে বেড়ায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়; কিন্তু আবার দুটো বাচ্চাকে দলে আশ্রয় দেয় পরম মমতায়।
পুরো মুভিতে গল্প যথেষ্ট সরল; এবং টার্গেট অডিয়েন্সের কথা মাথায় রাখলে খুব চমৎকারভাবেই সেই মুভির চিত্রায়ন হয়েছে। জিবলীর নিজস্ব আর্টস্টাইল এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য এই মুভিতেও ছিল বরাবরের মতনই। সাদামাটা মাইনিং শহর থেকে সবুজে পূর্ণ স্বপ্নের নগরে স্থানান্তর মুভিটি সামলেছে দক্ষতার সাথেই। মুভিটা শেষ করে ম্যালে গিয়ে আমি রীতিমত চমকে উঠেছিলাম সালের ঘরে ১৯৮৬ লেখা দেখে। আমাকে বেশ কয়েকবার ঠিকভাবে দেখে নিশ্চিত করতে হয়েছে যে আমি ভুল দেখছি না; এতটাই চমৎকার ছিল এনিমেশন। মিউজিকও যথেষ্ট ভাল ছিল; ইমোশনাল জায়গাগুলোতে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকগুলো যথার্থই ছিল। এছাড়া শেষ গানটা তো খুবই প্রিয় হয়ে গেছে এর মধ্যেই !
তবে দু'ঘন্টার এ মুভিটা যে গল্প বলা শুরু করেছিল; সেটাতেই সত্য থাকার চেষ্টা করেছে; যে কারণে অনেক বড় প্রশ্নেরই আসলে উত্তর মেলে নি মুভিটায়। লাপুতা কেন জনমানবশুন্য ছিল কিংবা শীলার অতীতে কি ঘটেছিল এবং মুস্কাই বা কি করে পৃথিবীতে ছিল, কতদিন ধরে ছিল; সে লাপুতা সমন্ধে এতো কিছু জানলো কি করে - এসবের কিছুই জানা যায় নি মুভিটায়। এছাড়া শীলা একগাদা স্পেল জানলেও সেগুলোর কোনটাই ব্যাবহারের চেষ্টা করে নি পুরো মুভি জুড়েই। লাপুতা কি করে পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করবে কিংবা অতীতেই বা কি করে করেছিল - এ ধরণের কোন সুত্রও মুভিটা আমাদের দেয় না।
শেষ কথা; হাতে ঘন্টা দুয়েক সময় আর সুন্দর ছিমছাম গল্প, মনোমুগ্ধকর আর্ট আর চমৎকার পেসিং এর একটা মুভি দেখার ইচ্ছে থাকলে জিবলীর যে কোন মুভিই সবসময়েই ভাল একটা চয়েস। লাপুতাও তার ব্যাতিক্রম কিছু না।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৪২