ছবির মডেলঃকাইকর।
সাতসকালে সূর্যের গরম গরম রোদে নরম নরম ভাব নিয়ে গুটি গুটি পায়ে হাটা শুরু করি ছুটির উদ্দেশ্যে। আমার একটা সূর্যের মতো বড় লম্বা ছুটি চাই। যেন মনের ইচ্ছে মত জাগতে পারি ও ডুবতে পারি। জোর করবার কেউ যেন না থাকে। একটা ছুটি চাই।
বছর পাঁচেক আগে চার চাকার সাদা গাড়িতে উঠে এসেছিলাম নগরীতে। বিচিত্রমাখা শহর। লাল-নীল শহরের অলিতে গলিতে হাজার রঙের বাহার।নগরীর ছেঁড়া শার্ট ও প্যান্ট ওয়ালা দিনের পাগল রাতের রাজা। নগরীর ডানাকাটা অসহায় পাখিগুলো রাত হলে বুক ফুলিয়ে ডানা মেলে উড়ে। এক চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবার বিধান নাই।শহরের বিধানগুলো দিনের ছায়ায় রাত হয়ে যায়!
ওহ.......আমার পরিচয়টা দেওয়াই হল না। আমি মাধবীলতা। সর্বজয়া মাধবীলতা। বাবার স্বপ্ন, গ্রামের স্বপ্ন ও আমার স্বপ্ন এক করে বছর পাঁচেক আগে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছিলাম।
নগরীতে প্রথম পা রাখবার দিনে, বড় উচু দালানের ছাদের কার্নিশে বসে থাকা কিছু পাখি লজ্জায় বিশাল সাইজের আকাশে ফুরুত করে উড়াল দেয়! আমার নতুন পা দেখে নগরের নগর পাগল কাদে আর চরল পাগল হাসে। তবে, সেদিন আমি চরলপাগলের হাসি বুঝিনি। বুঝিনি হঠাৎ করে খোলা আকাশে উড়াল দেওয়া পাখির মন।
ভর্তি পরীক্ষার দিন পরিচয় হয় কাইকরের সাথে। সহজ-সরল গাল ফোলা কাইকরের উদাস চাহনি দেখলে স্বয়ং দেবী পূর্ণিমা ও প্রেমে পড়ে যাবে। আমি তো ছিলাম কেবলই মানুষ। একমনে কাইকরকে বিশ্বাস করে নীলক্ষেত টু খিলখেত পায়ে হাঁটার অভ্যাস করে নিলাম। ঈশ্বরকে নিচুস্বরে উঁচু গলায়, ধন্যবাদ দেই কাইকরের মত একটা ছেলেকে পাইয়ে দেবার জন্যে। খুব সহজ-সরল ও ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। অমন ছেলে এক জীবনে আমার কপালে জুটবে ভাবতেও সাহস হয়নি কখনো। সে আমাকে অচেনা শহরের অজানা কিছু দেখিয়েছে হাতে হাত রেখে। পরিক্ষা শেষ হবার অনেকদিন হয়ে যাওয়াই গ্রামের বাড়ীতে চলে যেতে হয়। কাইকর যাওয়ার বেলা সে কি কান্না। তাকে দেখে মনে হয়েছে, এক জীবনে সে বুঝী আমাকে হারিয়ে ফেলেছে। এটাই শেষ দেখা আমাদের।
বাবার স্বপ্ন ও গ্রামের স্বপ্ন জয় করেই সুযোগ পেয়েছিলাম ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। সকলের বুক ভরা আশীর্বাদ নিয়েই আবার পা রেখেছিলাম জাদুর শহরে। নিজের স্বপ্নের ক্যাম্পাসে সাথে ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে খুব ভালো ছিলাম, সুখে ছিলাম।
আমি ও কাইকর ছিলাম সাহিত্যপ্রেমী। ঢাকা ইউনিভার্সিটির কার্জন হলে বইপোকাদের আড্ডাখানায় বসেছিলাম আমি। হঠাৎ করে আমার মুঠোফোনের টুংটাং শব্দ। কাইকরের ফোন।সে আমায় আদরমাখা অনুরোধ গলায় দাওয়াত দিল এক কাপ কফি খাবার। রাতে নাকি সাদা শাপলা ফুলের মতো দেখতে চাঁদের জোসনা গায়ে মেখে তার বাড়ীর ছাদের একপাশে আমার সাথে বসে কফিতে বড় সাইজের চুমুক দিবে। আমি শুনে ভরা মজলিশে থেকেও ফিক করে হেসে দেই। আমি তার আদুরে অনুরোধ রাখবার জন্য রাজি হই।
নীল শাড়ীর সাথে তার কিনে দেওয়া শাহবাগ থেকে নীল টিপ ও চুড়ি পড়েছিলাম হাতে ও কপালে। রাতের নিয়ন আলোর নিচ দিয়ে রিকশা করে তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হই। কিছু রাস্তার চরল পাগল আমাকে দেখে হাসে। নিয়ন আলোর নিচে থাকা কুকুরগুলো প্রহসনের দৃষ্টিতে তাকাই আমার দিকে। গাছের মগডালে বসে থাকা একটা কাক আমায় চোখ মারে। আমি লজ্জা পেয়ে তাড়াহুড়ো করে ভাড়া মিটিয়ে কাইকরের বাড়ীর মধ্যে ঢুকি...............।
সেই যে ঢুকলাম আজও বের হতে পারি নাই ! আমার সহজ সরল ভালোবাসাকে কাইকর কফি বানিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে নগরীর চরল পাগলদের কাছে। যারা শহরের উঁচু উঁচু দালানে বসে নরম শরীরের বিকিকিনি করে।
কাইকর আমাকে বিক্রি করে ক'টাকা পেয়েছিল খুব জানতে ইচ্ছে হয়! খুব জানতে ইচ্ছে হয় অমন নিষ্পাপ জলজ্যান্ত কত ভালবাসা সে বিক্রি করেছে? খুব জানতে ইচ্ছে হয়, সে কেমন আছে?
তাই আজ ছুটি চাই ।লম্বা ছুটি। যদিও নরম শরীর কুঁচকাবার আগে চরল পাগলরা আমাকে চার দেয়ালের মাঝখান থেকে মুক্তি দিবে না। তবুও ছুটি চাই। একটা ছুটি, লম্বা ছুটি।
যেখানে থাকবে না দরকষাকষির ভালোবাসা ।থাকবে না নিষ্পাপ ভালোবাসার বিকিকিনি।
আরেকটিবার চেনা শহরের চেনা মানুষগুলো আবারোও চেনার জন্য ছুটি চাই। একটা লম্বা ছুটি...........
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:৪১