জাহানারা বেগম তার বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বই পড়ছেন। বিছানার পেছন থেকে হুট করে এক যুবক উদয় হয়ে বলে উঠল,
-সেই আবার শরৎচন্দ্র পড়ছো। এই এক বই আর কত বার পড়বে তুমি!?
জাহানারা বেগম চমকে উঠলেন। পিছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলেন শিহাব দাড়িয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ থমকে চেয়ে রইলেন তার দিকে। এরপর বললেন,
-তুমি এ অবেলায় এলে। এতক্ষনে আসার সময় হলো?
-হ্যাঁ এতক্ষনে আসার সময় হলো। তার আগে বলো এই এক বই আর
কত কাল ধরে পড়বে।
-কেন পড়ি তুমি জানো না?
-শরৎচন্দ্র তোমার পছন্দ।
-তা পছন্দ। তবে তার কোন গল্প টা আমি প্রায়ই পড়ি সেটাও তো জানো।
-না জানিনা।
-জানো না?!
-না জানি না। বলো…
-বলবনা। জানবেনা কেন!
-“পরিণীতা”
-এইতো বেশ জানো। তবে না জানার ভান করো কেনো? বুড়ো বয়সে ঢং!
-আমি বুড়ো?
জাহানারা বেগম বেশ কিছুক্ষন শিহাবের দিকে চেয়ে রইলেন। আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন,
-তা নও। কিন্তু…
-কিন্তু কি?
-কিছু না। ভালোলাগছে না।
-কি হলো আবার!?
-এই যে তুমি ২৯ বছরের টগবগে যুবক আর আমি…
-আর তুমি কি?
-দেখতে পাচ্ছো না?
শিহাব জাহানারার চুলে হাত বুলালেন। হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
-চুল পেকেছে আরও দুটো তোমার। বেশ বুড়ি হচ্ছো।
-হ্যাঁ বুড়ি। কী সুন্দর আমাকে ৫২ বছরের বুড়ির বেশে দেখছো আর নিজে…
-হুম্ম….আমার কিন্তু একটা চুলও পাকা নেই।এই দ্যাখো... দ্যাখো দ্যাখো।
-দেখার কী আছে। ২৯ এ তোমার কেনই বা চুল পাকতে যাবে। ভাললাগে এই বুড়ির সাথে এসে প্রেম করতে?
-বুড়িটা জাহানারা। আমার সেই জাহান! আমার তো বেশ লাগে!
-হুম্ম, এজন্যে এসে আমার নতুন পাকা চুল খুঁজে খুঁজে বের করছো।
-করলে যে তুমি বেশ ক্ষেপে যাও। তাতে যে আমার তোমায় আরও বেশ লাগে! হা হা হা...
-যাও তোহ্.. পড়তে দাও আমায়।
-সেই তো এক বই। পড়তে হবে না ছাড়ো। আর আমি তো এখন এসে পরলাম। আমার জন্যই তো পড়ো নাকি।
-হ্যাঁ... তোমার জন্যই পড়ি। তোমায় খুব মনে পড়লেই পড়তে ইচ্ছে করে।
-তোমার এই ইচ্ছে টা বড় অদ্ভুত সেটা জানোতো?
-অদ্ভুত?
-তা নয়তো কি? এই কাহিনির সাথে তোমার-আমার প্রেমের এমন কী মিল আছে?! শুধু এতটুকুই তো যে গল্পের ললিতা-শেখরের মতো তুমি আমিও কাছাকাছি থাকতাম। দুজন-দুজনার প্রেমে হাবুডুবু খেতাম। আর একটু মিল বলতে ললিতা বড় হয়েছে তার মামার কাছে আর তুমি তোমার চাচার কাছে। আর কি মিল আছে কোন? নেই।
-হুবহু পুরোটা মিলতে হবে নাকি?
-সবচেয়ে বড় কথা, তোমায় বিয়ে করেছি আমার বাপের জীবদ্দশায়। হ্যাঁ বাবাকে জানাতে একটু-আধটু ভয় যে প্রথমে পাইনি তা নয়। তবে বলেছিতো? বিয়ে করে ঘরে এনে তুলেছি তো তোমায় বলো। ঐ আহাম্মক শেখরের মতো না যে বাপ মরার পর ললিতাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
-তা মন্দ বলোনি। তবুও... আমার ভাললাগে পড়তে।
জাহানারা আবারও তাকিয়ে রইলেন শিহাবের দিকে। শিহাব এবার জিজ্ঞেস করলো,
-কি দেখছ?
-দেখছি আর ভাবছি...
-কি সেটা?
-ভাবছি তুমি বুড়ো হলে কেমন হতে। কিন্তু কি আশ্চর্য! তোমায় আমি ২৯ এর বাইরে দেখিই না! চেষ্টা করলেও পারিনা। খুব নিজের বয়স আটকে রেখেছো!
-হা হা হা...
-হাসছো!?? কেন শুনলে না সেদিন আমার কথা বলতো। একটু যদি শুনতে তাহলে আর এভাবে আমায় একা একা বুড়ি হতে হতো না। একা একা থাকতে হতো না। দুজন এক সঙ্গে থাকতাম আজও...এখনও...এই মুহূর্তে...
-আছি তো।
-এভাবে থাকা? একে এক সাথে থাকা বলে!?সেদিন যদি অবেলায় অমন করে বাড়ি থেকে না বেরোতে তাহলে...তাহলে আর......
-আর এক্সিড্যান্ট টা হতো না। আর আজ তুমি আমায় দেখতে ৬১’র এক বৃদ্ধ বেশে। মাথায় তোমার চেয়ে আরও বেশি পাকা চুলে। তাই তো?
-তার দুদিন পর আমাদের রিনির ১ম জন্মদিন ছিল শিহাব।
-মৃত্যু কে বাঁধা দিতে পারে এমন সাধ্য কার আছে বলো, বিধাতা ছাড়া? থাকি না...আমায় রাখলে না হয় এই ২৯ এরই বেশে... তোমার মাঝে। চিন্তা করো না। আবার মিলবো দুজন। সত্যি বলছি...
-সেই তো রয়ে...
হঠাৎ দরজায় কড়া নেড়ে দাঁড়ালো রিনি। যার বিধায় জাহানারা বেগম আর কথাটি শেষ করতে পারলেন না। রিনি জিজ্ঞেস করলো,
-কার সাথে কথা বলছিলে মা?
জাহানারা বেগম ক্ষণিক অপ্রস্তুরতা কাটিয়ে বললেন,
-কই নাতো। কার সাথে আর কথা বলবো!? বই পড়ছিলাম রে মা।
-অহ...। মনে হলো যেন কারোর সাথে... আচ্ছা মা শোনো আমার ফিরতে ফিরতে অনেক দেড়ি হয়ে যেতে পারে। তুমি অপেক্ষা না করে খেয়ে ঘুমিয়ে নিয়ো কেমন। আসছি এখন।
রিনি চলে গেলো। এরপর আশেপাশে আর কোথাও শিহাবকে দেখতে পেলেন না জাহানারা বেগম। তারপর মলিন এক হাসি হেসে বিছানায় হেলান দিয়ে আবারো শরৎচন্দ্রের বই এর পাতা খুলে বসলেন।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৩৭