কয়েক মাস আগের কোন একটা দিনে ভার্সিটির কাছের এক কেক শপে যাওয়া হয়েছিলো।
খুব সম্ভবত ভীষণ ভাবে কেক খাওয়ার ইচ্ছে ধরেছিল সেদিন
ভেনিলা ফ্লেভার! আফসোস এর বিষয় এইছিলো যে
ভেনিলা কোন কেকই ছিলোনা সেদিন।
তবুও এসেই যখন পরেছি তখন
একেবারেই কেক না খেয়ে ফিরে যেতে মন সায় দিলোনা।
তাই সেকেন্ড অপশন, ব্ল্যাক ফরেস্টই বেঁছে নিলাম কেক ক্রেভিং মিটানোর জন্য।
খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো সেদিন,
ঝুম বৃষ্টি যাকে বলে।
কেক শপটা অতো বড়ও না আবার খুব ছোটও না।
বসে আছি, পাশে পুরোটাই গ্লাস দিয়ে ঘেরাও করা
কেক খাওয়ার সাথে সাথে বৃষ্টি দেখছি আর সেই সাথে রাস্তায় বৃষ্টির কারণে সৃষ্টি হওয়া
মানুষের ভোগান্তিও।
যদিও সবাই যে সেটাকে 'ভোগান্তি' বলেই মনে করেছে বললে ভুল বলা হবে!
কারন সেটা ভুল প্রমাণিত হলো যখন দেখলাম
এই এলোমেলো হাওয়া আছড়ে পরা ঝুম বৃষ্টির মধ্যে
ঢাকার বেহাল রাস্তায়, মনের আনন্দে ভিজে ভিজে হেটে যাচ্ছে
এক জোড়া কপোত-কপোতি।
সত্যিই, কিছু কিছু মানুষ
যেকোনো মুহূর্তে
ঠিক কী পরিমাণে যে রোমান্টিক হওয়ার ক্ষমতা রাখতে পারে
সেটা কিছুটা হলেও আন্দাজ করে নিতে পেরেছিলাম সেদিন।
সাধারনত, এরকম দৃশ্য গল্প-কবিতায় পড়ার সময় কল্পনায় দেখেছি
আজ বাস্তবে এরকম মিল পেয়ে বেশ মজাই লাগলো।
এতক্ষণ ধরে আমার পুরো সময়টা এই কয়েকটা বিষয়ের মাঝেই সীমাবধ্য ছিলো-
কেক, বৃষ্টি, রাস্তায় মানুষের ভোগান্তি দেখা,
বাসায় ফিরে যাওয়ার চিন্তা,
আর এই পাগল-মতন ঝুম বৃষ্টি শেষ হওয়ার অপেক্ষা।
এই সব গুলো বিষয় হুট করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো যখন
এক লোক এসে আমার সামনের টেবিলটাতে বসলেন।
না, এটা প্রেম গোত্রীয় কিছু নয়!
লোকটি আমার বাবার বয়সী।
পুরোপুরি না হলেও অনেকটাই আমার বাবার মতনই দেখতে।
আমার বাবার মতনই ফর্সা, উচ্চতা, মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি!
কী অদ্ভুত মিল দেখুন!
লোকটা আবার আমার বাবার মতনই একটা শার্ট পড়ে আছেন
সাদা শার্টে চিকন স্ট্রাইপ করা!
আমার কখনো কোন পুরুষ মানুষের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকার বদভ্যাস ছিলনা।
তবে আজ প্রায় দুবছর হল এটা হয়েছে।
আমার বাবার মতন কাওকে দেখলেই কেনো যেন
তাকে দেখার লোভটাকে সামলাতে পারিনা
হয়তো বাবাকে শেষ দেখা দেখতে পারিনি বলেই এমনটা হয়।
আজই কিন্তু প্রথম না!
এর আগেও কয়েকবার বাবার আদল খুজে পেয়েছি।
একবার যমুনা ফিউচার পার্কে বাবার মতন দেখতে এক লোককে পাশ কাটিয়ে হেটে যেতে দেখে
বার বার পিছন ফিরে তাকাচ্ছিলাম।
লোকটির হাটার সাথে আমার বাবার হাটার এক অদ্ভুত মিল খুজে পেয়েছিলাম।
এমন লাগলো যেন আমার বাবাই হেটে যাচ্ছে!
অনেক দিন বাবাকে হাঁটতে দেখিনা কীনা।
তাই হয়তো বার বার পিছন ফিরে তাকাচ্ছিলাম।
আমার সাথে যারা ছিল তারা কেউই ব্যাপারটা টের পায়নি,
কখনই পায়না।
বুঝতে দেই না কারণ, বুঝুক তা চাইনা।
এরকম কম বেশি বাড়ির বাইরে বেরোলেই ঘটে থাকে আমার সাথে
জানিনা সব পিতৃ-হারা সন্তানের সাথেই কী এমন টা হয় নাকি শুধু একা আমার সাথেই!
আদল, বাবার আদল, আমার বাবার আদল!
মিলে গেলেই অনুভুতিটা যে ঠিক কী রকম সেটা বলে বোঝানো সম্ভব না।
যাইহোক সেই বৃষ্টির দিনের কথায় ফিরে আসি
লোকটি বসে কালো রঙের একটা হ্যান্ড ব্যাগ থেকে
একটা মেয়ের, আমার ভার্সিটিরই এডমিশন ফর্ম বের করলেন।
অনুমান করে নিলাম হয়তো লোকটি তার মেয়ের ভর্তির কাজেই এসেছেন এখানে।
যা হওয়ার ছিল তাই হলো, চলে গেলাম ফ্ল্যাশ ব্যাকে!
আমার ভার্সিটির ভর্তি হওয়ার দিনটাতে।
বাবার সাথেই এসেছিলাম সেদিন।
সব কিছু এক এক করে মনে পড়ে যাচ্ছিলো!
খেয়াল করলাম চোখ দিয়ে অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়ছে!
থামানোর চেষ্টা করেও কোন লাভ হচ্ছেনা,
আমি লোকটিকে দেখছি আর আবার চোখ সরিয়ে নিচ্ছি।
এদিকে দু একজন কাস্টোমার আমায় এমন কাদতে দেখে অন্যরকম ভাবে তাকিয়ে আছে
হয়তো ভাবছিল, এমন বৃষ্টির দিনে প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে ইমোশনাল কান্না কাদছে মেয়েটা।
আমি তড়িঘড়ি করে ব্যাগ আওড়াতে লাগলাম,
সোনার হরিণের মতো রুমাল খুঁজে চললাম,
এরপর রুমাল দিয়ে কোন মতে কান্নাটাকে আড়াল দেয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম।
বৃষ্টি বেশ অনেকটাই কমে গেছে,
চাইলেই এই ফাঁকে বাসায় রওনা দেয়া যায়
তবুও উঠলাম না।
খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো লোকটিকে জানানোর যে
“জানেন আমার বাবাও না ঠিক আপনার মতনই দেখতে ছিল
আপনি কি আমার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলবেন?”
কিন্তু পারিনি, ইন্ট্রভার্ট হওয়ার কুফল!
কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি একেবারেই থেমে গেলো,
আর এরপর লোকটিও উঠে চলে গেলেন।
আমি তার উঠে যাওয়া থেকে শুরু করে
গ্লাসের বাইরে থেকে তার হেটে চলে যাওয়া দেখতে থাকলাম
এক দৃষ্টিতে!
ঠিক ততোক্ষণ, যতক্ষণ অব্দি দৃষ্টির একেবারে বাইরে চলে না যায়,
এরপর আমিও উঠে বিল পে করে চলে এলাম।
যদি সত্যি বলি, এরপর আমার মনটা খুব ভালো হয়ে গিয়েছিলো।
এতোটা ভালো এই দুবছরে আমার একবারও লাগেনি!
কারণ, এই দুবছরে আমার বাবাকে একবারও এত কাছ থেকে অনুভব করিনি,
বাবার আদল এর আগেও মিলেছে তবে, সেদিনের মতো না।
মনে হয়েছিলো আমার বাবাকেই দেখেছি!
বাবার আদলেই বাবার ছায়া পাই
এমন সব বাবার মাঝেই এখন
আমার বাবাকে খুঁজে পাই।
-১৫ ই মার্চ, ২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ৮:৫০