সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য, যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু ও বিচার দিবসের মালিক। আমরা একমাত্র তার ইবাদাত করি এবং তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি এক তার কোন শরীক নেই। তিনি পূর্বাপর সবার ইলাহ, আসমান ও যমিনের রক্ষাকর্তা। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ তার বান্দা ও রাসূল। যাকে তিনি দু’জাহানের রহমত, জীন ও মানব জাতির হিদায়াত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন। তার ওপর ও তার পরিবার এবং তার সকল সাথী, স্ত্রী ও সন্তানের ওপর আল্লাহর দরূদ ও সালাম। আরো যারা ইলম, আমল ও আল্লাহর দিকে আহ্বান করার মহান কর্মে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে ও কিয়ামত পর্যন্ত হিদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে - তাদের সবার ওপর।
অতঃপর, আল্লাহ তা‘আলার হিকমত ও রহমতের দাবি, তিনি আমাদের জন্য রাতকে করেছেন আরাম ও বিশ্রামের স্থান এবং দিনকে করেছেন রিযিক ও জীবিকা নির্বাহের কর্মক্ষেত্র। এ হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্ট জগতবাসীর প্রকৃতি বা সাধারণ নিয়ম। এ নিয়মের বিরোধিতা মূলত প্রকৃতির বিরোধিতা, যার পরিণতি কখনো শুভ নয়। ঘুমের জন্য রাত, কর্মের জন্য দিন নির্ধারিত। এর বিপরীত হলে শরীর, স্বাস্থ্য ও মানসিক সুস্থতা বিপর্যস্ত হয়। বিশেষ করে রাত জেগে গান-বাজনা ও অশ্লীল চিত্র দর্শনে মত্ত থাকার ফলে দিনের অধিকাংশ সময় ঘুমে নিঃশেষ হয়, শরীর জুড়ে অলসতা বিরাজ করে, প্রয়োজনীয় কর্মে ব্যাঘাত ঘটে এবং সূর্যাস্তের পর অসময়ে ফজর সালাত কাযা করা হয়। যা দ্বীন, দুনিয়া ও আখেরাত ধ্বংসের কারণ। এ ক্ষতির কোন তুলনা নেই, এর চেয়ে বড় কোন মুসিবত নেই। এ থেকে তওবা করা যতদ্রুত সম্ভব অতি জরুরী।
মুসলিম ভাইদের জন্য কল্যাণ কামনা ও তাদের থেকে অনিষ্ট দূরীকরণের আকাঙ্ক্ষা থেকে অত্র পুস্তিকা রচনা করি। যার নাম দিয়েছি:
"تذكير البشر بفوائد النوم المبكر وأضرار السهر"
“মানব জাতিকে দ্রুত ঘুমানোর ফায়দা ও রাত জাগার ক্ষতি সম্পর্কে অবহিত করা”। এ গ্রন্থের প্রতিটি বিষয় আল্লাহর কালাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস ও জ্ঞানীদের বাণী থেকে সংগৃহীত।
আমি প্রথমে কুরআনের সেসব আয়াতগুলো উল্লেখ করেছি, যেখানে আল্লাহ তা‘আলা রাতকে স্বস্তি ও বিশ্রামের স্থান এবং দিনকে আলোকিত ও কর্মমুখর করে বান্দার ওপর অনুগ্রহ প্রকাশ করেছেন। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘুমের আদর্শ এবং রাত জাগার কুফল বর্ণনা করেছি। আরো উল্লেখ করেছি দিনে ঘুমানোর অপকারিতা বিশেষ করে ফজর ও আসর বাদ, এবং ঘুম দমিয়ে রাখার কুফল, যে কারণে নানা ব্যাধির সৃষ্টি হয়। হ্যাঁ, যার রাত জাগা ইবাদাত, তার পক্ষে ঘুমানোর তুলনায় জাগ্রত থাকা উত্তম, যদি তা সুন্নত মোতাবেক হয়।
আল্লাহ অত্র পুস্তিকাকে তার সন্তুষ্টি অর্জনের উসিলা ও মুসলিম ভাইদের উপকারী করুন। আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তার পরিবার ও সাথীসহ সকলের ওপর দরূদ ও সালাম বর্ষণ করুন।
রাত-দিন আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ
আল্লাহ তা‘আলার দয়া ও অনুগ্রহ যে, তিনি রাতকে বানিয়েছেন অন্ধকার, যা মানব জাতির স্বস্তি ও বিশ্রাম উপযোগী। দিনকে বানিয়েছেন উজ্জ্বল, যা তাদের দ্বীন, দুনিয়া ও আখেরাতের কর্ম উপযুক্ত।
১. আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ هُوَ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلَّيۡلَ لِتَسۡكُنُواْ فِيهِ وَٱلنَّهَارَ مُبۡصِرًاۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يَسۡمَعُونَ ٦٧ ﴾ [يونس : ٦٧]
“তিনিই সে সত্তা, যিনি তোমাদের জন্য রাতকে সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমরা তাতে বিশ্রাম নাও এবং দিনকে করেছেন আলোকময়। নিশ্চয় এতে রয়েছে নিদর্শনাবলি এমন কওমের জন্য যারা শুনে”। [সূরা ইউনূস: (৬৭)]
২. আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ وَمِنۡ ءَايَٰتِهِۦ مَنَامُكُم بِٱلَّيۡلِ وَٱلنَّهَارِ وَٱبۡتِغَآؤُكُم مِّن فَضۡلِهِۦٓۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يَسۡمَعُونَ ٢٣ ﴾ [الروم: ٢٣]
“আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে রাতে ও দিনে তোমাদের নিদ্রা এবং তাঁর অনুগ্রহ থেকে তোমাদের (জীবিকা) অন্বেষণ। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য যারা শোনে”। [সূরা রূম: (২৩)]
৩. আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ ٱللَّهُ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلَّيۡلَ لِتَسۡكُنُواْ فِيهِ وَٱلنَّهَارَ مُبۡصِرًاۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَذُو فَضۡلٍ عَلَى ٱلنَّاسِ وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا يَشۡكُرُونَ ٦١ ﴾ [غافر: ٦١]
“আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্য রাত বানিয়েছেন যাতে তোমরা তাতে বিশ্রাম করতে পার এবং দিনকে করেছেন আলোকোজ্জ্বল। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি বড়ই অনুগ্রহশীল; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না”। [সূরা গাফের: (৬১)]
৪. আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
أَلَمۡ يَرَوۡاْ أَنَّا جَعَلۡنَا ٱلَّيۡلَ لِيَسۡكُنُواْ فِيهِ وَٱلنَّهَارَ مُبۡصِرًاۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يُؤۡمِنُونَ ٨٦ [النمل: 86]
“তারা কি দেখে না যে, আমি রাতকে সৃষ্টি করেছি, যেন তারা তাতে বিশ্রাম নিতে পারে এবং দিনকে করেছি আলোকিত? নিশ্চয় এতে নিদর্শনাবলী রয়েছে সেই কওমের জন্য যারা ঈমান এনেছে”। [সূরা নামাল: (৮৬)]
৫. আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ وَهُوَ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلَّيۡلَ لِبَاسٗا وَٱلنَّوۡمَ سُبَاتٗا وَجَعَلَ ٱلنَّهَارَ نُشُورٗا ٤٧ ﴾ [الفرقان: ٤٧]
“আর তিনিই তোমাদের জন্য রাতকে আবরণ ও নিদ্রাকে আরামপ্রদ করেছেন এবং দিনকে করেছেন জাগ্রত থাকার সময়”। [সূরা ফুরকান: (৪৭)]
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. রাত-দিন সৃষ্টিতে রয়েছে আল্লাহর বিশেষ হিকমত। তিনি দিন সৃষ্টি করেছেন কর্ম ও প্রয়োজন পূরণের জন্য, আর দিনের ক্লান্তি থেকে স্বস্তি হাসিল করার জন্য সৃষ্টি করেছেন রাত।
২. রাত-দিনের পরিক্রমায় রয়েছে আল্লাহর কুদরত, মহিমা ও তওহিদের নিদর্শন।
৩. যাদের বুঝের ক্ষমতা, চিন্তার মেধা ও ইমানি শ্রবণ ইন্দ্রিয় রয়েছে, তারা আল্লাহর সৃষ্ট মখলুক থেকে উপদেশ হাসিল করে।
৪. রাতে ঘুম ও দিনে জীবিকা অর্জনের প্রতিযোগিতা আল্লাহর নিদর্শন, তওহিদ ও কুদরতের দলিল।
৫. ইবাদাত বা প্রয়োজন ব্যতীত যে রাত জাগল, সে মানব প্রকৃতির বিরোধিতা করল, যে প্রকৃতির ওপর আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন।
৬. রাতকে ঘুম, স্বস্তি ও আরামের অনুকূল করা মানুষের ওপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও বড় নিয়ামত, যার শোকর আদায় করা ওয়াজিব, “কিন্তু অধিকাংশ মানুষ শোকর আদায় করে না”।
৭. মুমিন ব্যতীত কেউ রাত-দিনকে স্রষ্টার কুদরত বলে স্বীকার করে না এবং তার বিস্ময় নিয়ে চিন্তা করে না।
৮. বান্দার ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ যে, তিনি অন্ধকারকে করেছেন রাতের আচ্ছাদন, ঘুমকে বানিয়েছেন স্বস্তি অর্জন ও ক্লান্তি থেকে মুক্তির উপকরণ। আর দিনকে করেছেন উজ্জ্বল, যেন তারা জীবিকা অর্জন ও প্রয়োজন পূরণে সক্ষম হয়। সকল প্রশংসার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
রাত জাগার অপকারিতা
রাত জাগার অপকারিতা অনেক, যেমন:
১. রাত জাগার ফলে সুন্নতের বিরোধিতা হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার পূর্বে ঘুম ও এশার পর কথোপকথন অপছন্দ করতেন। আবু বারযাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত:
" أَنّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَكْرَهُ النَّوْمَ قَبْلَ الْعِشَاءِ وَالْحَدِيثَ بَعْدَهَا "
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার পূর্বে ঘুম ও পরে কথাবার্তা অপছন্দ করতেন”। বুখারি: (৫৩৭), মুসলিম: (১০৩২)
২. রাত জাগার ফলে অনেক সময় ফজর সালাত জমাতের সাথে আদায় করা সম্ভব হয় না, যা পূর্ণ রাত কিয়াম করার সমতুল্য। সহিহ মুসলিমে বর্ণিত:
«من صلَّى العشاء في جماعة، فكأنما قام نصف الليل، ومن صلى العشاء والفجر مع الجماعة، فكأنما قام الليل كله».
“যে ব্যক্তি জমাতের সাথে এশার সালাত আদায় করল, সে যেন অর্ধেক রাত কিয়াম করল, আর যে এশা ও ফজর জমাতের সাথে আদায় করল, সে যেন পূর্ণ রাত কিয়াম করল”। [মুসলিম]
৩. আল্লাহ তা‘আলা নিজ হিকমতের দাবিতে মানব জাতির স্বস্তি, প্রশান্তি ও ক্লান্তি থেকে বিশ্রাম গ্রহণের জন্য সৃষ্টি করেছেন রাত, যে রাত জাগল সে আল্লাহর হিকমতের বিপরীত কাজ করল।
৪. রাত জাগার ফলে দিনে ঘুমের চাপ সৃষ্টি হয়, যে কারণে ব্যক্তির পেশা, অথবা ব্যবসা অথবা কৃষি অথবা শিক্ষাদান অথবা চাকুরী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতএব রাত জাগা মানুষের প্রকৃতি পরিপন্থী, যে প্রকৃতির ওপর আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। রাত জাগার কারণে অনেক সময় পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জমাতের সাথে আদায় করা সম্ভব হয় না, যা চরম বিপর্যয় ও মহা মুসিবত।
৫. রাত জাগার ফলে শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন রোগের সূত্রপাত ঘটে। হ্যাঁ যে সুন্নত মোতাবেক রাত জেগে তাহাজ্জুদ, ইবাদাত, যিকর, দোয়া ও কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল থাকে, তার রাত জাগা ক্ষতিকর নয়, বরং উপকারী। আমাদের সকলের কর্তব্য পার্থিব জগতের সংক্ষিপ্ত জীবনে ইবাদাতের জন্য প্রতিযোগিতার ময়দানে অবতীর্ণ হওয়া, যা আমাদের ইহকালীন ও পরকালীন সফলতার চাবিকাঠি।
অতএব আল্লাহর রহমত প্রত্যাশাকারী ও তার শাস্তিতে ভীত প্রত্যেকের উচিত প্রথম রাতে ঘুমানো ও শেষ রাতে উঠা। অতঃপর সালাত, ইবাদাত, দোয়া, ইস্তেগফার ও তওবা ইত্যাদিতে মশগুল থাকা। হাদিসে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন, যখন রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকি থাকে। অতঃপর তিনি বলেন:
«من يدعوني فأستجيب له؟ من يسألني فأعطيه؟ من يستغفرني فأغفر له؟»
“কে আমাকে আহ্বান করবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব? কে আমার নিকট প্রার্থনা করবে, আমি তাকে প্রদান করব? কে আমার নিকট ইস্তেগফার করবে, আমি তাকে ক্ষমা করব?”। বুখারি: (১০৮৩), মুসলিম: (১২৬৭)
এসব ক্ষতি ও অপকারিতা হচ্ছে বৈধ কাজে রাত জাগার পরিণতি। আর হারাম কাজে রাত জাগার পরিণতি আরো মারাত্মক, আরো ভয়ঙ্কর, যেমন খেল-তামাশা, অশ্লীল বিনোদন ও পর্ণো সিরিয়াল দর্শনে মত্ত থাকা। কারণ মানুষের সময় ও হায়াত হচ্ছে ইবাদাতের জন্য, তাকে এ সম্পর্কে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা হবে, তাকে এর জবাবদিহি করতে হবে, অতঃপর সে তার ভালো-মন্দ কর্মের ফল ভোগ করবে। তাকে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা হবে: তার দেখা, তার শ্রবণ করা ও তার অন্তরে গোপন বিষয় সম্পর্কে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ إِنَّ ٱلسَّمۡعَ وَٱلۡبَصَرَ وَٱلۡفُؤَادَ كُلُّ أُوْلَٰٓئِكَ كَانَ عَنۡهُ مَسُۡٔولٗا ٣٦ ﴾ [الاسراء: ٣٦]
“নিশ্চয় কান, চোখ ও অন্তঃকরণ- এদের প্রতিটির ব্যাপারে সে জিজ্ঞাসিত হবে”। [সূরা ইসরা: (৩৬)] অন্যত্র ইরশাদ করনে:
﴿ فَوَرَبِّكَ لَنَسَۡٔلَنَّهُمۡ أَجۡمَعِينَ ٩٢ عَمَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٩٣ ﴾ [الحجر: ٩٢، ٩٣]
“অতএব তোমার রবের কসম, আমি তাদের সকলকে অবশ্যই জেরা করব, তারা যা করত, সে সম্পর্কে”। [সূরা হিজর: (৯২-৯৩)]
অতএব বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে এর সঠিক উত্তর প্রস্তুত করা, নিজের হিসাব নিজে কষা, সর্বদা গভীর দৃষ্টি রাখা: কি বলছে, কি করছে, কি নিচ্ছে ও দিচ্ছে! রাতে তাহাজ্জুদ আদায়কারী মুমিনদের প্রশংসা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ كَانُواْ قَلِيلٗا مِّنَ ٱلَّيۡلِ مَا يَهۡجَعُونَ ١٧ ﴾ [الذاريات: ١٧]
“রাতের সামান্য অংশই এরা ঘুমিয়ে কাটাতো”। [সূরা যারিয়াত: (১৭)] অন্যত্র ইরশাদ করেন:
﴿ تَتَجَافَىٰ جُنُوبُهُمۡ عَنِ ٱلۡمَضَاجِعِ يَدۡعُونَ رَبَّهُمۡ خَوۡفٗا وَطَمَعٗا وَمِمَّا رَزَقۡنَٰهُمۡ يُنفِقُونَ ١٦ فَلَا تَعۡلَمُ نَفۡسٞ مَّآ أُخۡفِيَ لَهُم مِّن قُرَّةِ أَعۡيُنٖ جَزَآءَۢ بِمَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٧ ﴾ [السجدة : ١٦، ١٧]
“তাদের পার্শ্বদেশ বিছানা থেকে আলাদা হয়। তারা ভয় ও আশা নিয়ে তাদের রবকে ডাকে। আর আমি তাদেরকে যে রিযক দান করেছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে। অতঃপর কোন ব্যক্তি জানে না তাদের জন্য চোখ জুড়ানো কী জিনিস লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তারা যা করত, তার বিনিময়স্বরূপ”। [সূরা সাজদাহ: (১৬-১৭)]
চিন্তা করুন কিয়ামুল লাইল আদায়কারীর জন্য আল্লাহ কত নিয়ামত গোপন রেখেছেন!!! অন্তরের সব চাহিদা পূরণ করা হবে: যা কোন চোখ দেখেনি, যা কোন কান শ্রবণ করেনি, মানুষের অন্তরে যার কল্পনা পর্যন্ত হয়নি। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ أَمَّنۡ هُوَ قَٰنِتٌ ءَانَآءَ ٱلَّيۡلِ سَاجِدٗا وَقَآئِمٗا يَحۡذَرُ ٱلۡأٓخِرَةَ وَيَرۡجُواْ رَحۡمَةَ رَبِّهِۦۗ قُلۡ هَلۡ يَسۡتَوِي ٱلَّذِينَ يَعۡلَمُونَ وَٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَۗ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٩ ﴾ [الزمر: ٩]
“যে ব্যক্তি রাতের প্রহরে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে, আখিরাতকে ভয় করে এবং তার রব-এর রহমত প্রত্যাশা করে (সে কি তার সমান যে এরূপ করে না) বল, ‘যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান?’ বিবেকবান লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে”। [সূরা যুমার: (৯)]
কিয়ামুল লাইল সম্পর্কে ইমাম তিরমিযি মুয়ায ইব্ন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত করেন, হাদিসের অংশ:
" أَلَا أَدُلُّكَ عَلَى أَبْوَابِ الْخَيْرِ: الصَّوْمُ جُنَّةٌ، وَالصَّدَقَةُ تُطْفِئُ الْخَطِيئَةَ كَمَا يُطْفِئُ الْمَاءُ النَّارَ، وَصَلَاةُ الرَّجُلِ مِنْ جَوْفِ اللَّيْلِ
“... আমি কি তোমাকে কল্যাণের পথগুলো বলে দেব না: সওম ঢাল। সদাকা পাপ মোচন করে, যেমন পানি অগ্নি নির্বাপণ করে, অনুরূপ ব্যক্তির সালাত রাতের মধ্যভাগে ...” তিরমিযি: (২৫৫৮), ইমাম তিরমিযি হাদিসটি হাসান ও সহিহ বলেছেন। আল্লাহ তা‘আলা শেষ রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন যখন এক তৃতীয়াংশ বাকি থাকে। তিনি বলেন:
«من يدعوني فأستجيب له؟ من يسألني فأعطيه؟ من يستغفرني فأغفر له؟ حتى يطلع الفجر»
“কে আমাকে আহ্বান করবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব? কে আমার নিকট প্রার্থনা করবে, আমি তাকে প্রদান করব? কে আমার নিকট ইস্তেগফার করবে, আমি তাকে ক্ষমা করব? যতক্ষণ না ফজর উদিত হয়”। [বুখারি ও মুসলিম]
আফসোস! বর্তমান যুগে অধিকাংশ লোক এ ফযিলত থেকে বঞ্চিত, বিশেষ করে যারা অর্ধেক রাত পর্যন্ত নাচ-গান ও অশ্লীল বিনোদনে মেতে থাকে, অতঃপর ফজর সালাত সূর্য উঠার পর অসময়ে কাযা করে। আহ্! কত বড় বিপর্যয়! কত বড় মুসিবত!
ঘুমের হিকমত ও উপকারিতা
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ وَجَعَلۡنَا نَوۡمَكُمۡ سُبَاتٗا ٩ وَجَعَلۡنَا ٱلَّيۡلَ لِبَاسٗا ١٠ وَجَعَلۡنَا ٱلنَّهَارَ مَعَاشٗا ١١ ﴾ [النبا: ٩، ١١]
“আর আমি তোমাদের নিদ্রাকে করেছি বিশ্রাম। আর আমি রাতকে করেছি আবরণ। আর আমি দিনকে করেছি জীবিকার্জনের সময়”। [সূরা নাবা: (৯-১১)]
ঘুম আল্লাহর নিখুঁত পরিকল্পনার ফল। ঘুম মানুষের স্বস্তি আনয়ন করে, দিনের কঠোর পরিশ্রম ও কর্ম-ব্যস্ততা থেকে মুক্তি দেয়। ঘুম না মৃত্যু-না জীবন বরং উভয়ের মধ্যকার এক বিশেষ অবস্থা, শরীর ও অস্থির প্রশান্তি বিধায়ক। দিনের নানান কোলাহল ও কর্ম-ক্লান্তির বিপরীতে রয়েছে রাতের পিনপতন নীরবতা। সব কিছু এমন সূক্ষ্ম ও নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়, যা মানুষের চিন্তার অতীত, যেখানে তাদের ইচ্ছার কোন দখল নেই। জেগে আছে, অথচ জানে না কিভাবে জেগে আছে! ঘুমিয়ে আছে, অথচ জানে না কিভাবে ঘুমিয়ে আছে! এসব পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা তার নেই। এখানে বিদ্যমান জীব জগতের গূঢ় রহস্য, যা তার স্রষ্টা ব্যতীত কেউ জানে না। কোন প্রাণী লাগাতার নির্ঘুম থাকতে পারে না, যে কৃত্রিম উপায়ে চেষ্টা করবে, তার মৃত্যু নিশ্চিত।
শরীর ও অস্থির প্রয়োজন ছাড়া আরো অনেক উপকারিতা রয়েছে ঘুমে। যেমন ঘুম আত্মার প্রশান্তি, যার স্পর্শ পাওয়া মাত্র ব্যক্তির হাত ফসকে অস্ত্র-ঢাল সব মাটিতে পড়ে যায়, ইচ্ছা বা অনিচ্ছায়। মুহূর্তের জন্য তলীয়ে যায় সে প্রশান্তির অতল গহীনে, যার প্রয়োজন তার নিকট খাদ্য-পানির চেয়ে কম নয়। এর মধ্যে ঘটে যায় কতক সময় অলৌকিক ঘটনা। যেমন চোখের ঝিমুনি, শরীরের মন্থরতা, অস্থির নিষ্ক্রিয়তা, অন্তরের বেচঈনি ও মনের ভীতিকর অবস্থা। এ হালত বেশী দীর্ঘায়ু হয় না, কিন্তু ব্যক্তির জীবনে এনে দেয় পরিপূর্ণ বিপ্লব। এর ফলে তার শুধু শক্তিই বৃদ্ধি পায় না, বরং সে নিজে শক্তিতে পরিণত হয়, যেন নতুন করে জাগ্রত হল, সাহস পেল ও ভয় দূরীভূত হল। যেরূপ ঘটেছিল বদর ও উহুদ যুদ্ধে মুসলিম মুজাহিদ বাহিনীতে। তাই অনুগ্রহ প্রকাশ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ إِذۡ يُغَشِّيكُمُ ٱلنُّعَاسَ أَمَنَةٗ مِّنۡهُ ١١ ﴾ [الانفال: ١١]
“স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদেরকে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করেন তাঁর পক্ষ থেকে নিরাপত্তাস্বরূপ”। [সূরা আনফাল: (১১)] অন্যত্র বলেন:
﴿ ثُمَّ أَنزَلَ عَلَيۡكُم مِّنۢ بَعۡدِ ٱلۡغَمِّ أَمَنَةٗ نُّعَاسٗا يَغۡشَىٰ طَآئِفَةٗ مِّنكُمۡۖ ١٥٤ ﴾ [ال عمران: ١٥٤]
“তারপর তিনি তোমাদের উপর দুশ্চিন্তার পর নাযিল করলেন প্রশান্ত তন্দ্রা, যা তোমাদের মধ্য থেকে একদলকে ঢেকে ফেলেছিল”। [সূরা আলে-ইমরান: (১৫৪)]
অতএব দিনের ব্যস্ততা ও কর্ম ক্লান্তি থেকে মুক্তির জন্য ঘুম গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়, আল্লাহর বিশেষ কুদরত, যেখানে রয়েছে অফুরন্ত হিকমত ও রহস্য, যা তিনি ব্যতীত কেউ জানে না। এ কারণে ঘুমের আলোচনা কুরআনে এসেছে বারবার, তাতে চিন্তা, গবেষণা ও তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করার জন্য বারবার তাগিদ প্রদান করা হয়েছে।
সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ তা‘আলা এ বিশ্ব চরাচরকে পুরোপুরি জীব জগতের অনুকূল ও অনুগামী করে দিয়েছেন। মানুষ যখন ঘুমায়, পুরো জগত তখন ঘুমায়। তিনি রাতকে অন্ধকার আচ্ছাদন দ্বারা ঢেকে দিয়েছেন, ফলে স্বস্তি ও প্রশান্তি লাভের জন্য সকলে রাতের আচ্ছাদনে অদৃশ্য হয়ে যায়। অতঃপর রাতের ওপর দিনের বিচ্ছুরণ ঘটান, ফলে পুনরায় সবাই জীবিকার অন্বেষণ ও কর্ম-ব্যস্ততায় মগ্ন হয়। এভাবে মহান আল্লাহ তার সৃষ্ট জগতের ভারসাম্য রক্ষা করেন, যে কারণে পৃথিবী বসবাস উপযোগী। প্রকৃতির এ সাধারণ নিয়মে জীব জগত যেরূপ অভ্যস্ত, অনুরূপ জীব জগতের সাধারণ স্বভাবের অনুগামী প্রকৃতি। একে অপরের পরিপূরক, একটি ব্যতীত অপরটি অসম্পূর্ণ, উভয়ের সমন্বয়ে এ সুন্দর পৃথিবী। এখানে আল্লাহর কুদরতের প্রমাণ, এ হচ্ছে তার নিখুঁত ও ত্রুটিহীন নির্মাণ। সুবহানাল্লাহ! {তাফসীর “ফি জিলালিল কুরআন” লি সায়্যেদ কুতুব: (৮/৪৩০)}
রাত-দিনের ঘটনাবলি ও রহস্যসমূহ
রাত-দিন আল্লাহর অলৌকিক নিদর্শন, দু’টি আশ্চর্য সৃষ্টি ও রহস্য ঘেরা মখলুক। এ জন্য কুরআনুল কারীমে বারবার এর উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন তিনি বলেছেন:
﴿ وَمِنۡ ءَايَٰتِهِ ٱلَّيۡلُ وَٱلنَّهَارُ ٣٧ ﴾ [فصلت: ٣٧]
“আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে রাত ও দিন”। [সূরা ফুস্সিলাত: (৩৭)] অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:
﴿ وَهُوَ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلَّيۡلَ لِبَاسٗا وَٱلنَّوۡمَ سُبَاتٗا وَجَعَلَ ٱلنَّهَارَ نُشُورٗا ٤٧ ﴾ [الفرقان: ٤٧]
“আর তিনিই তোমাদের জন্য রাতকে আবরণ ও নিদ্রাকে আরামপ্রদ করেছেন এবং দিনকে করেছেন জাগ্রত থাকার সময়”। [সূরা ফুরকান: (৪৭)] আরো ইরশাদ হচ্ছে:
﴿ ٱللَّهُ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلَّيۡلَ لِتَسۡكُنُواْ فِيهِ وَٱلنَّهَارَ مُبۡصِرًاۚ ٦١ ﴾ [غافر: ٦١]
“আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্য রাত বানিয়েছেন যাতে তোমরা তাতে বিশ্রাম করতে পার এবং দিনকে করেছেন আলোকোজ্জ্বল”। [সূরা গাফের: (৬১)] এ জাতীয় আরো আয়াত রয়েছে।
এসব আয়াতে আল্লাহর কুদরত লক্ষ্য করুন। তিনি রাতকে স্বস্তি ও পৃথিবীর আচ্ছাদন বানিয়েছেন। এতে সর্বত্র পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে ও যাবতীয় কোলাহল স্তিমিত হয়। প্রতিটি প্রাণী নিজ নিজ আশ্রয় স্থলে ফিরে যায়। আত্মাগুলো দিনের ক্লান্তি শেষে বিশ্রাম গ্রহণ করে। অতঃপর প্রভাত উদ্ভাসক আগমন করেন দিনের আলো ও উজ্জ্বলতা নিয়ে, ফলে অন্ধকার বিদীর্ণ করে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে। রাত শেষে পুনরায় জীব জগত জীবিকা নির্বাহ ও কর্ম ব্যস্ততায় মগ্ন হয়। মানুষেরা বিছানা ত্যাগ করে কর্মে যোগদান করছে, পাখিগুলো তাদের বাসা থেকে বের হয়ে আসছে! এ পুনরুত্থান ও পুনর্জীবন কিয়ামতের পুনরুত্থান ও পুনর্জীবনের প্রমাণ নয়! সন্দেহ নেই পৃথিবীর এ প্রকৃতি পরকালের পুনরুত্থান ও পুনর্জীবনের আশ্চর্য এক নমুনা! কিন্তু নিত্য ঘটমান তাই আমরা একে গতানুগতিক নিয়ম জ্ঞান করি, কোন উপদেশ গ্রহণ করি না। আমরা এ থেকে গাফেল, অন্যমনস্ক। যাকে ইচ্ছে আল্লাহ হিদায়েত দান করেন, যাকে ইচ্ছে তিনি গোমরাহ করেন। যাকে ইচ্ছে তিনি এসব নিদর্শন থেকে অন্ধ করে দেন, সে চোখ দ্বারা তা দেখে না, কান দ্বারা তা শ্রবণ করে না, অন্তর দ্বারা তা চিন্তা করে না, সে হিদায়াত থেকে বঞ্চিত। ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে আবক্ষ পানিতে থেকেও তৃষ্ণায় পানি পানি চিৎকার করছে, আর পানির অস্তিত্ব অস্বীকার করছে। অতএব এসব কুদরত দেখে আল্লাহকে জানা, তার শোকর ও প্রশংসা করা এবং তার নিকট আকুল প্রার্থনা করা প্রত্যেকের জন্য জরুরী। {“মিফাতুহু দারুস সাআদাহ” লি ইব্নিল কাইয়ূম: (১/২৫৬)}
রাত-দিন ও জীবিকান্বেষণ আল্লাহর নিয়ামত ও নিদর্শন
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ وَمِنۡ ءَايَٰتِهِۦ مَنَامُكُم بِٱلَّيۡلِ وَٱلنَّهَارِ وَٱبۡتِغَآؤُكُم مِّن فَضۡلِهِۦٓۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يَسۡمَعُونَ ٢٣ ﴾ [الروم: ٢٣]
“আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে রাতে ও দিনে তোমাদের নিদ্রা এবং তাঁর অনুগ্রহ থেকে তোমাদের (জীবিকা) অন্বেষণ। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য যারা শোনে”। [সূরা রূম: (২৩)]
﴿ ٱللَّهُ يَتَوَفَّى ٱلۡأَنفُسَ حِينَ مَوۡتِهَا وَٱلَّتِي لَمۡ تَمُتۡ فِي مَنَامِهَاۖ فَيُمۡسِكُ ٱلَّتِي قَضَىٰ عَلَيۡهَا ٱلۡمَوۡتَ وَيُرۡسِلُ ٱلۡأُخۡرَىٰٓ إِلَىٰٓ أَجَلٖ مُّسَمًّىۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يَتَفَكَّرُونَ ٤٢ ﴾ [الزمر: ٤١]
“আল্লাহ জীবসমূহের প্রাণ হরণ করেন তাদের মৃত্যুর সময় এবং যারা মরেনি তাদের নিদ্রার সময়। তারপর যার জন্য তিনি মৃত্যুর ফয়সালা করেন তার প্রাণ তিনি রেখে দেন এবং অন্যগুলো ফিরিয়ে দেন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল কওমের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে”। [সূরা যুমার: (৪২)]
দিনের ব্যস্ততা ও রাতের স্বস্তি আল্লাহর অনুগ্রহ
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ قُلۡ أَرَءَيۡتُمۡ إِن جَعَلَ ٱللَّهُ عَلَيۡكُمُ ٱلَّيۡلَ سَرۡمَدًا إِلَىٰ يَوۡمِ ٱلۡقِيَٰمَةِ مَنۡ إِلَٰهٌ غَيۡرُ ٱللَّهِ يَأۡتِيكُم بِضِيَآءٍۚ أَفَلَا تَسۡمَعُونَ ٧١ قُلۡ أَرَءَيۡتُمۡ إِن جَعَلَ ٱللَّهُ عَلَيۡكُمُ ٱلنَّهَارَ سَرۡمَدًا إِلَىٰ يَوۡمِ ٱلۡقِيَٰمَةِ مَنۡ إِلَٰهٌ غَيۡرُ ٱللَّهِ يَأۡتِيكُم بِلَيۡلٖ تَسۡكُنُونَ فِيهِۚ أَفَلَا تُبۡصِرُونَ ٧٢ وَمِن رَّحۡمَتِهِۦ جَعَلَ لَكُمُ ٱلَّيۡلَ وَٱلنَّهَارَ لِتَسۡكُنُواْ فِيهِ وَلِتَبۡتَغُواْ مِن فَضۡلِهِۦ وَلَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ٧٣ ﴾ [القصص: ٧١، ٧٣]
“বল, ‘তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি আল্লাহ রাতকে তোমাদের উপর কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী করে দেন, তবে তাঁর পরিবর্তে কোন ইলাহ আছে কি যে তোমাদের আলো এনে দেবে? তবুও কি তোমরা শুনবে না’? বল, ‘তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি আল্লাহ দিনকে তোমাদের উপর কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী করে দেন, তবে তাঁর পরিবর্তে কোন ইলাহ আছে কি, যে তোমাদের রাত এনে দেবে যাতে তোমরা বিশ্রাম করবে? তবুও কি তোমরা ভেবে দেখবে না’? আর তাঁর অনুগ্রহে তিনি তোমাদের জন্য রাত ও দিন করেছেন যাতে তোমরা বিশ্রাম নিতে পার এবং তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যেন তোমরা শোকর আদায় করতে পার। [সূরা কাসাস: (৭১-৭৩)]
আল্লাহ তা‘আলা বান্দার ওপর রাত-দিনের অনুগ্রহ প্রকাশ করে তাদেরকে কৃতজ্ঞতা আদায় ও ইবাদাতের প্রতি আহ্বান করেছেন। কারণ তিনি নিজ অনুগ্রহে দিন বানিয়েছেন, যেখানে তারা রিযক অন্বেষণ করে, তাদের প্রয়োজনে দিক্বিদিক ছুটে চলে। অনুরূপ তিনি রাত বানিয়েছেন যেন তারা স্বস্তি হাসিল করে, তাদের রুহ ও শরীর ক্লান্তি দূর হয়, যা বান্দার ওপর আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ।
রাত-দিন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি, এতে কোন মখলুকের দখল নেই। ইরশাদ হচ্ছে:
﴿إِن جَعَلَ ٱللَّهُ عَلَيۡكُمُ ٱلَّيۡلَ سَرۡمَدًا إِلَىٰ يَوۡمِ ٱلۡقِيَٰمَةِ مَنۡ إِلَٰهٌ غَيۡرُ ٱللَّهِ يَأۡتِيكُم بِضِيَآءٍۚ أَفَلَا تَسۡمَعُونَ ٧١ ﴾ [القصص: ٧١]
“যদি আল্লাহ রাতকে তোমাদের উপর কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী করে দেন, তবে তাঁর পরিবর্তে কোন ইলাহ আছে কি যে তোমাদের আলো এনে দেবে?”। [সূরা কাসাস: (৭১)] অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:
﴿ إِن جَعَلَ ٱللَّهُ عَلَيۡكُمُ ٱلنَّهَارَ سَرۡمَدًا إِلَىٰ يَوۡمِ ٱلۡقِيَٰمَةِ مَنۡ إِلَٰهٌ غَيۡرُ ٱللَّهِ يَأۡتِيكُم بِلَيۡلٖ تَسۡكُنُونَ فِيهِۚ أَفَلَا تُبۡصِرُونَ ٧٢ ﴾ [القصص: ٧٢]
“যদি আল্লাহ দিনকে তোমাদের উপর কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী করে দেন, তবে তাঁর পরিবর্তে কোন ইলাহ আছে কি, যে তোমাদের রাত এনে দেবে যাতে তোমরা বিশ্রাম করবে?”। [সূরা কাসাস: (৭২)]
লক্ষ্য করুন আল্লাহ রাত সম্পর্কে বলেছেন: ﴿ أَفَلَا تَسۡمَعُونَ ٧١ ﴾ “তোমরা কি শোন না”। আর দিন সম্পর্কে বলেছেন: ﴿ أَفَلَا تُبۡصِرُونَ ٧٢ ﴾ “তোমরা কি দেখ না”। কারণ রাতে দৃষ্টি শক্তির চেয়ে শ্রবণ শক্তি প্রখর থাকে, অনুরূপ দিনে শ্রবণ শক্তির চেয়ে দৃষ্টি শক্তি প্রখর থাকে।
বান্দা যদি এসব নিয়ামত নিঃশেষ ও বিলীন হওয়ার কথা চিন্তা করে, তাহলে তার বিবেক আল্লাহর অনুগ্রহের নিকট অবনত হবে। আর যে মনে করে এগুলো প্রকৃতির চিরাচরিত নিয়ম, আদিকাল থেকে চলছে, অনন্তকাল চলবে, তার অন্তর কখনো আল্লাহর কৃতজ্ঞতার জন্য উন্মুক্ত হবে না। তার চোখ অন্ধ, সে কখনো এ থেকে উপদেশ গ্রহণ করবে না, তার থেকে কখনো আল্লাহর শোকর প্রকাশ পাবে না। {“তাফসীর সাদী”: (৬/৫৩-৫৪)}
আল্লাহর সকল প্রশংসা, তিনি আমাদেরকে অগণন ও বেহিসাব নিয়ামত দান করেছেন। তিনি আমাদেরকে ঘুমের জন্য দিয়েছেন অন্ধকার রাত, আর কাজের জন্য দিয়েছেন আলোকিত দিন। আমরা এতে নানা ইবাদত সম্পাদন করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে সক্ষম হই।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘুমের আদর্শ
রাতের শুরুতে ঘুমানো ও শেষে ঘুম থেকে উঠার উপকারিতা স্বাস্থ্য সচেতন প্রত্যেক ব্যক্তির নিকট স্পষ্ট। রাতের শেষার্ধে ঘুম থেকে উঠা, মিসওয়াক করা, ওযু করা ও আল্লাহর তাওফিক মোতাবেক সালাত আদায় করার গুরুত্ব ইসলামে অনস্বীকার্য। এতে শরীর ও মন প্রফুল্ল থাকে, স্বস্তি হাসিল হয়। এতে আরো রয়েছে শারীরিক ব্যায়াম। ইবাদাতের সওয়াব তো আছেই, এভাবে ঘুম ও রাত জাগার ফলে মুসলিমের অন্তর ও শরীর সতেজ থাকে এবং দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ লাভ হয়। কারণ এতে শরীর যেমন প্রয়োজনীয় ঘুম পূর্ণ করে, অনুরূপ অতিরিক্ত ঘুমের অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘুম ও রাত জাগা ছিল পরিমিত ও নিয়মতান্ত্রিক। যখন ঘুমের প্রয়োজন হত ডান কাত হয়ে ঘুমিয়ে নিতেন। ঘুমের আযকার আদায় করতেন। তিনি কখনো খাদ্য-পানীয় দ্বারা উদর পূর্ণ করতেন না। তিনি মাটির ওপর শয়ন করতেন না, অনুরূপ উঁচু বিছানাও গ্রহণ করতেন না। তার বিছানা ছিল চামড়ার। তিনি বালিশের ওপর শয়ন করতেন, কখনো গালের নিচে হাত রাখতেন।
ঘুমের উপকারিতা
ঘুমের দু’টি প্রধান উপকার:
এক. ঘুমের ফলে দিনের ব্যস্ততা শেষে স্বস্তি হাসিল হয়, বিরক্তি ও আলস্য দূর হয়।
দুই. ঘুমের ফলে খাদ্য হজম হয় এবং পেটে বিদ্যমান বিভিন্ন খাদ্যে সুন্দরভাবে মিশ্রণ ঘটে। কারণ শরীরের উষ্ণতা ঘুমন্ত অবস্থায় পেটে জমা হয় ও হজম শক্তি বৃদ্ধি করে। তাই আমরা দেখি ঘুমন্ত ব্যক্তির দেহের বর্হিরাংশ ঠাণ্ডা থাকে, ফলে তার অতিরিক্ত পোশাকের প্রয়োজন হয়। {“যাদুল মায়াদ”: (৪/২৩৯-২৪০)}
দিনের ঘুম ক্ষতিকর, বিশেষ করে ফজর ও আসরের পর
দিনের ঘুম ক্ষতিকর। এর ফলে রোগের বিভিন্ন উপসর্গ সৃষ্টি হয়, যেমন বংশগত রোগ, স্নায়ু তন্ত্রের দুর্বলতা ও অলসতা এবং যৌন শক্তি হ্রাস পায়, তবে গরমের মৌসুমে দ্বি-প্রহরের ঘুম উপকারী। প্রভাতের ঘুম বেশী ক্ষতিকর, আরো ক্ষতিকর আসর পরবর্তী ঘুম। আব্দুল্লাহ ইব্ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু তার এক ছেলেকে সকালে ঘুমাতে দেখে বলেন: “উঠ, তুমি এমন সময় ঘুমচ্ছ যখন রিযক বণ্টন হচ্ছে?!”
কেউ বলেছেন: দিনের ঘুম তিন প্রকার: উত্তম অভ্যাস, দহন ও বোকামি। উত্তম অভ্যাস: দ্বিপ্রহরের ঘুম, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভ্যাস ছিল। নির্বুদ্ধিতা: প্রথম প্রহরের ঘুম, যা দুনিয়া ও আখেরাতের কাজ থেকে বিরত রাখে। বোকামি: আসর পরবর্তী ঘুম।
জনৈক বুজুর্গ বলেছেন: আসরের পর ঘুমানোর কারণে যার বিবেকের বিলুপ্তি ঘটে, সে যেন নিজেকে ব্যতীত কাউকে দোষারোপ না করে। কোন এক কবি বলেছেন:
أَلاَ إِنَّ نَوْمَاتِ الضُّحَى تُورِثُ الفَتَى = خَبَالاً وَنَوْمَاتُ العُصَيْرِ جُنُونُ
“জেনে রেখ প্রথম প্রহরের ঘুম মানসিক বিকৃতি সৃষ্টি করে, আর আসর পরবর্তী ঘুম পাগলামি”।
দিনের শুরুতে সকল সৃষ্টিজীব রিযকের সন্ধানে বের হয়। এটা মূলত রিযক বণ্টনের বিশেষ মুহূর্ত। তাই এ সময়ের ঘুম মূলত বঞ্চিত হওয়ার ঘুম, তবে প্রয়োজনের সময় ব্যতীত। এ ঘুম শরীরের জন্য ক্ষতিকর, অলসতা সৃষ্টি করে ও হজম ক্রিয়া বাধা গ্রস্ত করে, ফলে দুর্বলতা, অস্বস্তি ও আলস্য দেখা দেয়। আর এ ঘুম যদি হয় প্রভাতের মল ত্যাগ, হাঁটাচলা ও সামান্য খাদ্য গ্রহণের পূর্বে, তাহলে আরো ক্ষতিকর, যার ফলে কঠিন ও জটিল রোগ সৃষ্টি হতে পারে। {“যাদুল মায়াদ”: (৪/২৪১-২৪২)}
ঘুম দমিয়ে রাখার ফলে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়
যার রাত জাগা ইবাদাত, তার রাত জাগা উত্তম
দীর্ঘ সময় ঘুম দমিয়ে রাখা উচিত নয়। দীর্ঘ সময় ঘুম দমিয়ে রাখার ফলে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি হয়। স্বভাব রূঢ় ও কর্কশ হয়, মননশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কর্মের ধারাবাহিকতা বিপর্যস্ত হয় ও শরীরের চঞ্চলতা দূরীভূত হয় ইত্যাদি। তাই ঘুম ও রাত জাগায় মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা শরীর ও সুস্থতার জন্য কল্যাণকর।
“আদাবুল কুবরা”: গ্রন্থে রয়েছে: কতক মনীষী বলেছেন: তন্দ্রা আকল দুর্বল করে, আর ঘুম তা বৃদ্ধি করে। অতএব ঘুম বান্দার ওপর আল্লাহর মহা নিয়ামত, আর তাই বারবার ঘুমের উল্লেখ করে আল্লাহ বান্দার ওপর অনুগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
যার রাত জাগা ইবাদাত, তার পক্ষে তা উত্তম। কিন্তু যার জন্য রাত জাগা গুনাহের কারণ, তার পক্ষে তা ক্ষতিকর। জাগ্রত থাকার কারণে যদি খারাপ সঙ্গের সম্ভাবনা থাকে, পাপ ও অপরাধে জড়িত হওয়ার আশঙ্কা হয়, তাহলে ঘুম উত্তম সন্দেহ নেই, বরং ওয়াজিব, যদি ঘুম ছাড়া হারাম ত্যাগ করার উপায় না থাকে।
কতক বুজুর্গ বলেছেন: এমন যুগ আসবে, যখন মানুষের জন্য ঘুম ও চুপ থাকাই উত্তম হবে।
সুফিয়ান সওরি রহ. বলেছেন: “আদর্শ পূর্বসূরিগণ নিরাপত্তার আশায় অবসর হলে ঘুমানো পছন্দ করতেন”।
অতএব ঘুম উত্তম, কারণ এতে বেহুদা ও অনর্থক কর্মকাণ্ড থেকে নিরাপত্তা লাভ হয়, শেষ রাতে তাহাজ্জুতের জন্য উঠা সম্ভব হয়, যা বিশেষ ইবাদাত এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার অসিলা। আর যদি তন্দ্রা, দুর্বলতা ও ক্লান্তি দূর করার নিয়তে কেউ ঘুমায় এবং প্রয়োজনীয় ঘুম শেষে নতুন করে ইবাদাত, যিকর ও কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল হয়, তাহলে তার ঘুমও ইবাদাত। {“গিযাউল আলবাব, শারহু মানজুমাতুল আদাব”: (২/৩৫৮)}
(আব্দুল্লাহ ইব্ন জারুল্লাহ আল-জারুল্লাহ)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ২:৪৪