লোকটি অনেকক্ষণ ধরে তার পেছনে পেছনে ঘুরছে, সেই অনুষ্ঠান শেষে হলঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকে যখন তার চারদিকে ভক্ত ও তদবিরবাজদের ভিড়। এত ছেলেমেয়ের মাঝখানে সাদামাটা প্রায় ময়লা কাপড়ে উসর-ধূসর চুল মাথায় বিদ্ঘুটে রঙের শার্ট পরা লোকটির প্রতি তার চোখ পড়ার কথা না, তবু পড়ল। এতে তিনি বিস্মিত হলেন এবং কিছুটা বিরক্তও।
অনেকেই তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। কেননা, তিনি শুধু একজন সেলিব্রিটি নন, ইংরেজিতে যাকে বলে ফেভার। তা অন্যের প্রতি দেখানোর মতো তার যথেষ্ট ক্ষমতাও আছে। সেলিব্রিটির পেছনে, ছেলেমেয়েরা ঘোরে মুগ্ধতার জন্য অথবা কিছু পাওয়ার আশায়।
লোকটি নাছোড়বান্দা, তিনি যতই তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, সে ঘুরে এসে দাঁড়ায় সামনে, প্রথম সারিতে না হলেও দ্বিতীয় কি তৃতীয় সারিতে। দেখতে সে সুশ্রী নয়, তবে তার চোখে-মুখে তীক্ষ একটা কামুক ভাব আছে, “দোধারী তালয়ারের” মতো। তার চোখের নিচে ক্লান্তির কালো দাগ, মুখে একধরনের রুক্ষতা। আগে সেখানে যে কমনীয়তা ছিল তা মুছে ফেলেছে। ঠোঁট দুটি “লিক লিক” করছে, যেন গ্লিসারিন মাখানো। আসলে সে ঘন ঘন জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে। গলার নিচে কণ্ঠি বের হয়ে এসেছে, ওপরের দিকে গলার মধ্যে কয়েকটি ভাঁজ, সেখানে ঘামের পানি জমে আছে রুপার চিকন হারের মতো।
প্রায় ময়লা কমলা প্যান্ট জড়ানো শরীরের ওপরে মেশিন ঢেকে রেখেছে, প্রায় সমতল এখন। হঠাৎ দেখে ছেলে কি মেয়ে বোঝা যায় না। লোকটি বাংলাদেশের পতাকার রং দিয়েই প্যান্টশার্ট বানিয়েছে। আজকাল অনেকেই এভাবে কাপড় পরে, কিছুটা দেশপ্রেম দেখাতে, কিছুটা ফ্যাশন স্টেটমেন্টের জন্য। লোকটি দেখতে সুশ্রী না হলেও বয়সের জন্য একধরনের আকর্ষণ আছে তার শরীরে। অগোছালো বেশবাস সেই আকর্ষণে একটা বন্যতার ভাব সৃষ্টি করেছে, যেন সে যেখানে খুশি লাফিয়ে পড়তে পারে। দেখেই মনে হয় খুবই বেপরোয়া আর অ্যাগ্রেসিভ।
বুঝলেন স্যার, ওরা আমার সঙ্গে পলিটিকস করছে। সামনের সারিতে থাকতে দিচ্ছে না। অথচ এই কদিন আমি সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে থেকে স্লোগান দিয়েছি। আমার গলার স্বর এত উঁচু যে মাইক্রোফোনের বলতে গেলে দরকার হয় না। এক মাইল দূর থেকেই শুনে বুঝতে পারবেন এটা আমার গলার স্বর। মিটিংয়ের জন্য স্লোগানের দরকার, স্লোগানই মিটিং জমিয়ে তোলে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন। অভিজ্ঞ লোক আপনি। আমি কয়েক দিন মিটিং জমিয়ে রেখেছি শুধু আমার গলার জোরে স্লোগান দিয়ে দিয়ে।
কাগজে আমার নাম এসেছে। টেলিভিশনে আমাকে প্রায়ই দেখিয়েছে। পাবনা মেন্টাল থেকে দেখে আমার ছোট ভাই দেলু পাগলা ফোনে বলেছে, দাদু তোকে দেখা গিয়েছে। কয়েকবার। এরকম ভরা সমাবেশে মেশিনের মেরামত করে তুই খুব মাতিয়ে রেখেছিস। আমার পোষা ম্যাও ম্যাও পুষিটিও প্রশংসা করেছেন সেটি দেখে। কেন করবে না? তুই তো তাদের মতোই পশুদের মতোই পথে ঘাটে হুলুস্থুল লাগিয়ে দিয়েছিস! আমার পাশের ব্যাডের কালু পাগলার ডগিটাও তোর এহেন কর্মে দুর্দান্ত উৎসাহ বোধ করছিল। খবরটি প্রকাশিত হবার পরপরি গত এক বছর পর সে অনবরত ঘেউ ঘেউ করছে। সবাই বলছে “উঠছে রে উঠছে!” নিজের ছেলেসম খ্যাতিতে কোন বাবাই গর্ব অনুভব করে না?
এযুগে সবাই মিছিল-মিটিং আর মানববন্ধন করে সময় নষ্ট করছে। পড়াশোনার কী হবে? মাজহার ভাই তো পড়ার কথা বলেই লোকটিকে নিয়ে গেলেন ঢাকায়। এখন এসব কী হচ্ছে? ওর ভবিষ্যৎ আমার চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
মাজহার ভাই, মানে আমার বাবার অনাত্মীয় মাজহার সাহেবকে জানেন স্যার? আমরা তাকে চাচা বলি। তিনি একজন অঘোষিত রাজনৈতিক নেতা, মফস্বল শহর পাবনা থেকে শুরু করেছিলেন রাজনীতি, আস্তে আস্তে লুঙ্গি পরিধানের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঢাকায় পৌঁছেছেন। বাবার সঙ্গে জানাশোনা অনেক দিন থেকে। আগে প্রায় প্রতিদিন আসতেন, ঢাকায় আসার পর যান মাঝেমধ্যে। একদিন আমাদের বাসায় এসে বললেন, তোমার ছেলেটার তো বেশ স্বাস্থ্যবান! ওকে ঢাকায় পাঠাও। মফস্বলে থেকে কত দূর আর যেতে পারবে? এখানে কি-ই বা সুযোগ রয়েছে? এখন সবই তো ঢাকায়।
"ঢাকায় গিয়ে কী করবে হাঁসনাত? ওর তো গ্র্যাজুয়েশনও হয়নি।" বাবা বলেছিলেন।
শুনে মাজহার চাচা উত্তর দিয়েছিলেন, "কেন? ঢাকাতেই গ্র্যাজুয়েশন করবে। সেই ব্যবস্থা করে দেব আমি। কলেজ ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে জানাশোনা আছে। বললেই অ্যাডমিশন হয়ে যাবে। হোস্টেলেও জায়গা পেতে অসুবিধা হবে না। সবই তো রাজনৈতিক দলের কন্ট্রোলে, যখন যারা ক্ষমতায় থাকে, তাদের। এখন আমরা আছি, সব সিদ্ধান্ত আমরাই নিই।"
বেশ সুন্দর চলছে। কেউ বাদ সাধছে না, কোনো হট্টগোল নেই। সবাই পাবে এই সুযোগ, পালা করে। বেশ গণতান্ত্রিক এই ব্যবস্থা। তা ছাড়া দলের কেউ না হলেও এসব সুযোগ পাওয়া যায়। একটু খরচ করতে হয় আর কি। সে যাই হোক, আপনার ছেলেটার দায়িত্ব আমি নিলাম। ও ঢাকায় যাবে, কলেজে ভর্তি হবে, হোস্টেলে থাকবে। পড়াশোনা করবে। মেচেজ করবে মাঝেমধ্যে আমাদের পার্টি অফিসে। এসে এটা-ওটা নিয়ে কাজ করে সাহায্য করবে।
"কী কাজ করবে? কী নিয়ে সাহায্য করতে হবে হাঁসনাতকে?" বাবার স্বরে উদ্বেগ ও ব্যাকুলতা।
"তেমন কিছু না। ধরেন নেতার জন্য বক্তৃতা লেখা, প্যামফ্লেট তৈরি, প্রচার পুস্তিকা লেখা, ব্যানারের স্লোগান, মাঝে মধ্যে লুঙ্গি-ধুতি ধুয়ে দেয়া, মাথায় তেল মেখে দেয়া, শরীরে অলিভওয়েল দিয়ে ঢলা দেয়া—এই সব আরকি। বড় ধরনের কোনো কাজ না, জটিলও না। খুব বেশি সময় দিতে হবে না তাকে। পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হবে না।"
বাবা শুনে আমার দিকে তাকিয়েছেন। মাথা নেড়ে বলেছেন, ও অমন কাজ আগে কখনো করেনি। পারবে না। তা ছাড়া ওই সব নিয়ে থাকলে পড়াশোনা লাটে উঠবে।
মাজহার চাচা আশ্বাস দিয়ে বললেন, "কাজগুলো সব সোজা। লেখালেখি, তা-ও বাংলায়। ছোট ছোট আকারে। তাতে সময় বেশি লাগবে না। আর পড়াশোনার সময় তো সে এসব কাজ করবে না, অবসরে করবে। সন্ধ্যার পর। কখনো রাতে।"
"সন্ধ্যার পর, রাতে? বাবা খুব চিন্তিত হয়ে তাকিয়েছেন মাজহার চাচার দিকে। বলেছেন মাথা দুলিয়ে কাঁপা গলায়, শুনেছি, সন্ধ্যার পর ঢাকার রাস্তাঘাট নিরাপদ না। গুন্ডা-বদমাশ ঘুরে বেড়ায়। অ্যাডামটিজার পিছু নেয়।"
"আরে না। ওসব বাড়িয়ে বলে লোকে। ঢাকা রাজধানী, সেখানে আইনশৃঙ্খলা থাকবে না তো থাকবে কোথায়? অন্য সব মেশিনম্যান থাকছে না ঢাকায়? কাজ করছে না, ঘোরাঘুরি করছে না? মজার ব্যাপার কি জানেন?"
"কী? বাবার চোখে একরাশ কৌতূহল এবং পুরোনো প্রশ্ন। হাঁসনাতের মতো মফস্বলের ছেলেরাই ঢাকায় বেশি ফ্রি, বেশি দুরন্ত, বেশ সাহসী। ওরা কাউকে পরোয়া করে না। সব পার্টিতেই তারা আছে। টেলিভিশনে দেখেন না, মিছিলের সময় সামনে থেকে কেমন হাত তুলে জোরে জোরে স্লোগান দেয়। মফস্বলের ছেলেরাই ঢাকায় আন্দোলন জমিয়ে রাখে। বলতে গেলে ওরাই আসল কর্মী দল। মেয়েগুলো ফাঁকিবাজ। তারা ছেলেদের দিয়েই সব কাজ করিয়ে নিতে চায়। শুধু বাহবা আর টাকা নেওয়ার সময় সামনে থাকে। সব কাজের ক্রেডিট নেয়।" মাজহার চাচা অনেকক্ষণ কথা বলে থামেন।
সেই থেকে শুরু। তারপর এখন আমার সব সয়ে গেছে।
স্যার, কিছুই জানা ছিল না আমার, মফস্বলের মানুষ, তা-ও আবার ছেলে। অল্প সময়ে অনেক কিছু শিখলাম। হয়তো আরও শেখার আছে। দেওয়ার মতো কিছু হয়তো একসময় ছিল, এখন তেমন কিছু নেই। মিথ্যে বলব কেন। আপনি অভিজ্ঞ লোক। সেলিব্রিটি।
তিনি বিরক্ত হয়ে বলেন, "তোমার একটা দোষ আছে। তুমি বেশি কথা বল। কথা কম কাজ বেশী।"
হাঁসনাত শুনে মিইয়ে যায়। তারপর বলে, মাজহার চাচা কোথায়? আছেন, তিনি তার জায়গাতেই আছেন, দলের কাজ করছেন উঠে-পড়ে, দলে আরও কিছুটা ওপরে উঠতে পেরেছেন। অনেক ফন্দিফিকির জানেন তিনি। কী করে ডিঙিয়ে যেতে হয়, লুঙ্গিতে গিত্তু মারতে হয়, চুলে ঝুঁটি করতে হয়, ওপরের মানুষকে তুষ্ট করতে হয়, সব জানা আছে তার। তিনি আরও ওপরে উঠবেন।
আমি? না, আমার পক্ষে ওপরে ওঠা সম্ভব হবে না। যেটুকু উঠেছি, ওই পর্যন্ত। মানববন্ধন করি, মিছিলে যাই, মঞ্চ তৈরি করে তার ওপরে উঠে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিই। টেলিভিশনে দেখায়। কাগজে নাম ছাপা হয়। পাবনা থেকে প্রশংসা করে।
পড়াশোনা? হ্যাঁ, মাজহার চাচা তাঁর কথা রেখেছিলেন। কলেজে অ্যাডমিশন হয়েছে। হোস্টেলে শেয়ারে সিট পেয়েছি, মানে দুজনে একসঙ্গে থাকতে হয়। ক্লাস বেশি হয় না, প্রায়ই বন্ধ থাকে। আমরাও ফুরসত পাই না। হরতাল, মিটিং, মিছিল। মঞ্চে উঠে স্লোগান দেওয়া। এতে অনেক সময় চলে যায়। তবে কলেজে নামটা আছে খাতায়। হোস্টেলে সিটটা আছে এখনো। কেউ আপত্তি করে না, কেন করবে? প্রায় সবাই তো আমার মতো অবস্থার। কারও অনুগ্রহে অ্যাডমিশন আর সিট পাওয়া। সন্ধ্যার পর পড়াশোনা? না, সেটা প্রায় কারোরই হয় না। সবাই কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত, টাকার ধান্দায় ঘোরে। আমি পার্টি অফিসে যাই। কখনো একা, কখনো ছাত্রনেতাদের সঙ্গে।
কাজ শেষ হলে আড্ডা দিই, ড্রিংক করে একসঙ্গে বসি।
ড্রিংক? না, না। চা-টা না। অ্যালকোহল। হুইসকি। বিয়ার। রাতে কাজ শেষ হয়ে গেলে অফিসে বসেই হাতেই মেশিনের পরিচর্যা করেন। মাঝে মাঝে আদর করে জড়ানো গলায় বলেছেন, খাও, খাও। ভালো জিনিস। স্বাস্থ্য ভালো থাকে। এনার্জি বাড়ায়। এত পরিশ্রম করার পর দরকার আছে এটার। সাহেবরা তো খারাপ জিনিস তৈরি করেনি। অল্প অল্প খাও, তাহলে বেসামাল হবে না। একটু সামলে চলতে হবে, হাজার হোক এটা পার্টি অফিস। বেসামাল হতে চাও তো আমার বাসায় এসো।
পাবনা থেকে ঢাকা অনেক দূরের পথ। আমি তো জানি পথের বাধাগুলো কোথায় কোথায়। যেকোনো কাজ, যা ভদ্রভাবে চলতে দেবে, সুন্দরভাবে থাকতে দেবে। আচ্ছা স্যার, আপনার টেলিভিশন চ্যানেলে লেখাটেখার কোনো কাজ নেই? আমি খুব ভালো বাংলা লিখি। কাশেম বিন আবু বকর আমার প্রিয় লেখক। তার “বোরখা পরা মেয়েটি” পড়ে আমার গায়ের রোমকূপ দাঁড়িয়ে যায়। পড়ে কতরাত যে বিছানা ভিজিয়েছি, তার হিসেব নেই। সেই একই রকম লেখা আমারও কয়েকটা প্রবন্ধ আছে। অনেকেই অনেকে প্রশংসা করেছিল। আরও কয়েকটা লিখে একটা বই বের করব ভেবেছিলাম। কিন্তু সময় হলো না। ইচ্ছেটা এখনো আছে। অবশ্য “পি আলু” তে বৈশাখী একটা লেখা যাবে আমার। খতিউর চাচার পেপারে মডারেশন তেমন প্রখর নয়, সাহিত্যে তো একদমই নয়। সো, সহজেই ফাটিয়ে দেব একদম!
যাই হোক, লোকটি প্রসঙ্গ বদলায়। বলে, আপনাকে টেলিভিশনে দেখেছি, টকশোতে আপনার কথা শুনেছি। আপনাকে অন্য রকম মনে হয়েছে। মানে অন্য পুরুষদের মতো না। আমার ভুলও হতে পারে। কিন্তু সত্যিই আপনাকে দেখে আমার এমন মনে হয়েছে। তা স্যার, পারবেন আমার জন্য কিছু করতে? বড় কিছু না। মঞ্চের আড়ালেই থাকব, লেখালেখি কিছু থাকলে করে দেব। টেলিভিশনেও লেখার কাজ নিশ্চয়ই আছে? গশামাজায়, না মানে লেখালেখিতে আমার দারুণ হাত।
তিনি লোকটির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি খুব বেশি কথা বল।
শাহবাগ চত্বর লোকে লোকারণ্য। সব বয়সের মানুষ নর-নারীতে ভরে গিয়েছে সব রাস্তা, ফুটপাত। তুমি সেখানে যাও, পাব্লিকের ডলা খেয়ে তোমার সেটি খসে পরবে বলে দিচ্ছি।
হাঁসনাত ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে বলছে, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’ সে পরেছে লাল পেড়ে সাদা সুতির একটা লুঙ্গি। তার এক হাতে ছোট গাধা ফুলের মালা বালের মতো জড়িয়ে।
*** ইহা একটি কাল্পনিক লেখা। বাস্তবে কোন সংবাদ পত্রে প্রকাশিত কোন লেখা, চরিত্র বা অবস্থার সাথে মিলে গেলে তা কেবলই অভিনেপ্রেত ও কাকতালীয় মাত্র!!