সেই লোকের সঙ্গে তেমন জানাশোনা তো নয়, পরিচয়ও ছিল না। একদিন সন্ধেয় মান্নান আকবর নিয়ে এলো। আকবর বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে লিটল ম্যাগাজিন বের করে। তার কথাবার্তা অ্যালার্জির মতো প্রচণ্ড ছোঁয়াচে, চুলকোতে হবেই; সে কথা কে জানত! তবে সঙ্গে আসা লোকটিকে আগে দেখেছি। কোনো সাহিত্য আসরে হয়তো। ফরসা-লম্বা-কাঁচাপাকা গোঁফ, চশমার ওপার হতে চকচকে দু-চোখ, নেশা নেশা ভাবালু আবেশ। কবিতা লেখেন জানা হলো।
আকবর এর আগে একদিন ভূমিকা না রেখে মন্তব্য করে বসে। এপ্রিলের দুপুর। প্রচণ্ড রোদ। তার কপাল বেয়ে স্বেদবিন্দু কপোল এবং থুতনিতে জমে আছে, এই পড়ল বলে। আকবর উদ্যোগি মানুষ। কাজকর্ম চাকরি-বাকরি কিছু নেই, তবে টাকা ইনকাম ভালো করে; আর সেই বিশেষ প্রক্রিয়া কমবেশি অনেকের জানা। সুতরাং আকবর মান্নান সকল জায়গায় উপস্থিত। এর-ওর বিবিধ সমস্যা সমাধানে একপায়ে খাড়া। কারও উপকার করতে পারলে ধন্য হয়। অন্যকেও কৃতার্থ করে।
‘ভাইজান বরুণদা হলো গিয়ে পরদার আড়ালের কবি। নিভৃতচারী সাহিত্যসেবক। তাকে অনেকদিন ধরে বলছি, একটা বই বের করতে; এবার মনস্থির করেছেন। বই হবে।’
‘ভালো তো!’
‘টাকার পয়সার কোনো সমস্যা নেই, ব্যবসায়ী মানুষ। আপনাকে শুধু উনার পাণ্ডুলিপি একটু দেখে দিতে হবে।’
‘আমার তো অনেক কাজ। সময় কোথায় আকবর?’
‘না ভাইজান উনার হাতের লেখা বুঝতে অসুবিধা নাই। কবিতাগুলো শুধু বিষয় অনুসারে সাজাবেন, বানান-ভাষা এসব দেখে দেবেন। আপনার লাভ আছে ভাইজান। কিছু সম্মানী পাবেন।’
মান্নান আকবর সিজনাল পত্রিকা সম্পাদক। সময়ে পত্রিকা ছাপায়। ছোটবড় বিজ্ঞাপন কালেকশন করে। বাঘা বাঘা মানুষের কাছে তিন টাকার পত্রিকা পঞ্চাশ-একশতে বিক্রি করে। কাজের মানুষ তো বটেই। স্ট্রাটেজিক ম্যান। ক্যাপটেন মার্ভেল বা স্পাইডারম্যান বললেও ভুল হয় না। কয়জনে পারে এমন কাজ? এসব চকিতে ভেবে নিয়ে বলি, -
‘আচ্ছা...সাতদিন সময় দিতে হবে।’
‘সে আপনি একসপ্তাহ নিন ভাইজান। আমি তাহলে সন্ধ্যায় বরুণদার কবিতাগুলো এনে দিই।’
‘অকে।’
‘ভাইজান কাজ তেমনকিছু নয়, বানান আর ব্যাকরণ দেখবেন ব্যস্।’
‘এ তো কঠিন কাজ আকবর, কোনো একাডেমিক মানুষকে দিলে ভালো হতো।’
‘সমস্যা নাই ভাইজান, উনি খরচাপাতি করবেন। টাকাঅলা মানুষ, বুঝলেন কিনা সাহিত্যের ঘোড়ারোগ ধরেছে। এদিকে আপনারও দুটো টাকা হলো।’
‘তাই। হা হা হা! আচ্ছা দিও দেখি।’
বরুণ চন্দ্র দাশ। একবিংশ শতাব্দির কবি। কম্পিউটার কম্পোজ করা স্ক্রিপ্ট। এক দশমিক পাঁচ পয়েন্ট স্পেসে আশি গ্রাম অফসেটে প্রিন্ট আউট। সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি। পোয়েট্স আর সিনফুল লায়ার্স। প্লেটোর কথা এড়িয়ে গেলাম। কবিতা হলো জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন। হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি। অগত্যা কাজ নিতে হলো। চল্লিশ পেজ দেখে দিতে পারলে কিছু টাকা আসে। কবিতা নামক আবেগ আর বিপ্লবের দু-তিনটি লেখা পড়ার পর মন কেমন হাঁপিয়ে উঠল। এ কেমন কাজ? সেই তুলনায় একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা লেখার কাজ পেলে ভালো হতো। বরুণ চন্দ্র দাশ অর্থাৎ বচদা, বয়স প্রায় পঞ্চান্ন-ষাট। কেতাদুরস্ত লোক। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। ভারী লেন্সের বিচ্ছুরণ। চোখের দৃষ্টিতে আশ্চর্য জিগীষা। সেখানে থেকে থেকে কুমারীর মতো লাজুক চাহনি ঝরে পড়ে। কবিরা কি লাজুক হয়? এই প্রশ্ন কেন? কেননা তাদের অন্তরের চোখে অনেককিছু ধরা পড়ে। হাজারও কথা ভাবেন, বলেন, প্রত্যেক লেখায় লাইনের পর লাইনে বিধৃত হয় সেই ভাবনা। এইসব বিস্তৃত করার মধ্যে তখন কোনো বিব্রতকর শব্দরাশি বা কুণ্ঠা থাকে না। অতি সহজেই প্রিয়ার ঠোঁট-স্তন-উরু-জঘন আর ত্রিভূজের বর্ণনা থাকে; চাইকি প্রয়োজনে পূর্ণিমায় জেগে থাকা পদ্মপুকুর কিংবা সাগর বালুকাবেলায় শারীরিক শৃঙ্গার-সংযোগের অনেককিছু থাকে। আমি কবিতা নামক এসব পড়ি না। ওসব হলো মুক্তচিন্তা...আধুনিকতা। আমি রক্ষণশীল। বচদার কবিতার মধ্যে মুক্তচিন্তার সহজ-সরল স্বীকারোক্তি। ভাবনা। মুগ্ধতা আর বিস্ময়। কখনো একজন নারীর কাছে আবেগময় সমর্পনের মহত্ত্বতম কারুকাজ। সমস্যা শুধু বানান ভুল, একই শব্দ আর বাক্যের পুনরাবৃত্তি, ণত্ব আর ষত্ব বিধান, হ্রস্ব ই-কার আর দীর্ঘ ই-কার। সুতরাং দীর্ঘ এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন শো’কেসের উপর টিভির মনিটরে ভেসে ওঠে। এই কাজ কেন নিলাম?
মান্নান আকবর তিনদিন পর এক দুপুরে হাজির। আশান্বিত হয়ে বাইরে দাঁড়ালাম। অগ্রিম কিছু পাওয়া যাবে হয়তো। সে সাইকেল থেকে নেমে জিজ্ঞেস করে বসল, -
‘ভাইজান এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম...ভাবলাম দেখা করে যাই। এদিকে আবার বাংলা নববর্ষ এসে গেল। একটি পত্রিকা বের করব। আপনি গল্প দেবেন ভাইজান।’
‘পত্রিকা কত পেজের হবে আকবর?’
‘বেশি বড় করা যাবে না ভাই। সময় কম। তারপর বাজেটের ব্যাপার। আপনি ভাই এক হাজার শব্দের মধ্যে গল্প দেবেন। ওই একটি গল্পই যাবে। বাদবাকি কবিতা তিরিশ-পঁয়ত্রিশটা।’
‘প্রবন্ধ?’
‘ওসব যাবে না ভাইজান। মানুষ আজকাল প্রবন্ধ পড়ে না। আচ্ছা ভাইজান, একটা পরামর্শ দিন, একটুখানি হাসি মানে কৌতুক দেয়া যাবে?’
‘আজকাল অনেকেই তো লিটল ম্যাগাজিনের মধ্যে ইত্যাদি বিষয় প্রকাশ করছে। তুমি এসব দিও না। সিরিয়াস পাবলিকেশন করো।’
‘আচ্ছা ভাইজান। আপনি আমার বড়ভাই, গুরুজন, আপনি যা বলবেন, সেটা ফেলে দেয়ার মতো না।...ভাইজান এবার অন্য কথা বলি, বরুণদার কাজ কি চলছে?’
‘শেষ পর্যায়ে। তুমি কাল বিকেলে নিতে পারো।’
‘আরি বাপস্! এ তো বিরাট খবর। আমি এখনই বরুণদাকে বলছি।’
মান্নান আকবর চলে গেলে পুনরায় মনে পড়ল যে, আমার হাতে কোনো কাজকর্ম নেই। এনজিওয় বিবিধ কাজের মধ্যে প্রকল্প প্রস্তাবনা লেখা শিখেছি; কখনো কোনো কাজ এলে আট-দশ হাজার ইনকাম হয়। এখন একজন কবির কবিতা পড়ছি। প্রকল্প প্রস্তাবনায় মিশন-ভিশন, গোল-অবজেকটিভ, জাস্টিফিকেশন বা রেসনালিটি, মনিটরিং মেথড ও ইম্পেক্ট স্টাডি, SWOT Analysis, Logical Frame Work কতকিছু বিশ্লেষণ করতে হয়, যৌক্তিকতা আনতে হয়; এসব ভাবনায় মাথা ঝিম মেরে থাকে। এদিকে বরুণ চন্দ্র দাশের কবিতা পড়ে কোথায় কী পড়লাম, কী বলেছেন, আর কেনইবা বলছেন ইত্যাদি বিষয় দশ মিনিট পর স্মরণে থাকছে না। তারপরও যদি হাজার তিনেক টাকা আসে সেটিই লাভ। আগামিতে এসব কাজ আর নেব না। বাক্যগঠন-বানান-ভাষারীতি-ব্যাকরণ বিষয়ক জটিলতার কথা না হয় বাদই দিলাম।
আজকাল অবশ্য প্রুফরিডার মানুষজন বিভিন্ন দোকান খুলে বসেছে। তারা অকবিকে কবি, অলেখককে লেখক তৈরির মহান পেশায় নিয়োজিত। অর্থশালী নারী-পুরুষ মনের ভাবনা লিখে তাদের হাতে দেয়। ভাষাবিদ রিডারেরা নিজের মনের মাধুরি মিশিয়ে লেখক-কবি উপহার দিয়ে বইমেলাকে সমৃদ্ধ করে থাকে। ষোলো পৃষ্ঠায় এক ফরমা, প্রতি ফরমায় প্রুফ দেখা বাবদ আয় তিনশত টাকা। একটি আশি পৃষ্ঠার বই অর্থ পাঁচ ফরমা। নামতা বলছে তিন পাঁচে পনেরো। একটি আশি পৃষ্ঠার বইয়ের জন্য দেড় হাজার টাকা। বরুণ চন্দ্র দাশের বাজেট কত? তার যত কবিতা নামক লেখা সে-সব দিয়ে বড় জোর বত্রিশ পৃষ্ঠা হয়। যার অর্থ ছয়শত টাকা পাওয়া যেতে পারে। একেবারে ফিউজ হয়ে গেলাম।
মান্নান আকবর পরদিন যথারীতি সন্ধের সময় এসে গেল। কবিও সঙ্গে এসেছে। সুতরাং অতিথি আপ্যায়ন না করলে কেমন হয়? কাউকে পাঠিয়ে এটা-ওটা আনিয়ে ঝরে গেল একশত। এদিকে অরুণিমাকে দ্বিতীয় দফা চা করতে হলো। কবিকে বুঝিয়ে দিলাম যে, প্রতি পৃষ্ঠায় একটি করে কবিতা দিলে তিন-চার ফরমার বই হয়। একশত গ্রাম কাগজ ব্যবহার করলে বইয়ের সাইজ হবে নাদুসনদুস। মানুষজন মালদার লেখার বই বলে হটকেকের মতো কিনে নেবে। এসব বলার মধ্যে কবির মুড অবলোকন করে বুঝতে পারছি, নিজেকে তিনি রবীন্দ্র-নজরুল বা জীবনানন্দ পর্যয়ে নিয়ে গেছে। কথা আর বাড়াতে ইচ্ছে করে না। ক্লায়েন্ট মানে মানে কেটে পড়লে কিছু টাকা আসে। কত দেবে জানি না। হিসাব করে চাইতেও শরম লাগে। সবকিছু বুঝিয়ে দিতে দিতে তিরিশ-চল্লিশ মিনিট শেষ। অবশেষে একদলা নোট পাওয়া গেল হাতের মুঠোয় যেনবা চুরির টাকা এমনভাবে গছিয়ে দিল মান্নান আকবর। টাকা মুড ভালো করে দেয়, কিন্তু অফ করে দিল। অতিথি যায় যায় দরজা পর্যন্ত এগোলে দেখি মাত্র তিনশত টাকা। তার মধ্যে পঞ্চাশের ছেঁড়া একটি নোট জোড়াতালি। বরুণ চন্দ্র দাশ অর্থাৎ বচদা বোকাচোদা বানিয়ে গেছে।
তখন ট্রানজিস্টারে অনুরোধের আসরে গান শুরু হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২২ সকাল ১১:০৭