দেশ স্বাধীনের পর দেখেছি, মা আর মামি আমাদের দুষ্টুমি থামাতে কিংবা ঘুমোতে ভয় দেখাতেন, ‘ঘুমো নয় তো বাচ্চু খান আসবে।’ অনেক পরে জেনেছি, এই বাচ্চু খান ছিলেন পার্বতীপুরের এক বিহারি বা ননবেঙ্গলি, যিনি কিনা একাত্তরে স্টিম ইঞ্জিন রেলগাড়ি বা ওয়াগন চালাতে অনেক বাঙালিকে স্টিমে জ্যান্ত ঢুকিয়ে মেরে ফেলত। দিনাজপুর-পার্বতীপুর আর সৈয়দপুর হলো বিহারিদের ঘনবসতি এলাকা। একাত্তরে এরা প্রায় সরাসরি বাঙালি নিধনে, বাঙালির বাড়িঘর লুটপাটে ব্যস্ত থাকত। আমাদের বাড়িও রেহাই পায়নি। সকল জিনসপত্র, এমনকি গরুকে জল খাওয়ানোর বালতি পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী এক বিহারি পরিবার লুট করে নেয়। বাবার আইনের আর গল্প-উপন্যাসের বই সংগ্রহের সঙ্গে আমার স্কুলের বই, বনহুর, মোহন আর কুয়াশা সিরিজের কতগুলো বই টিউবওয়েল পাড়ে পড়ে থাকতে দেখি। বৃষ্টির পানিতে পচে-গলে নব্বই শতাংশ শেষ। আমার স্ট্যাম্প কালেকশন অ্যালবাম, খেলনা ক্যামেরা, খেলনা প্রজেক্টর, ঘুড়ি-নাটাই, পারিবারিক ছবির অ্যালবাম এসবও লুটের হাত থেকে রেহাই পায়নি।
একাত্তরের আগস্টে গ্রামে থাকা বিপজ্জনক বেশি হওয়ায় শহরে আসা হয়। আমি দেখছি, বাবার মার্ফি রেডিও বিহারির দোতলায় বাজছে। বাবাকে বললাম। তিনি একটি ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে থাকতে বললেন। শহরের রাস্তায় বিহারি মহিলা দলবেধে ঘুরছে। কোনো বাঙালিকে দেখতে পেলেই, ইয়ে মেরি সহর কো মার ডালা বলে চিৎকার জুড়ে দেয়। কোনো কোনো বাঙালি মারধরের শিকার হয়। এরই মধ্যে সিনেমা হলে উর্দু ছবি চলে। আমি বাসায় বসে গানের সুর শুনতে পাই। বাসা থেকে বেরোনো নিষেধ। ঘর থেকে বারান্দায় দাঁড়ালে বিহারি ছেলেদের এমনকি বয়সিদের গালিগালাজ নিশ্চুপ হজম করি। ‘বাঙালি ভূত, খাটিয়া মে শুত...আগ লাগা তো ধড়পারাকে উঠ।’ আমাদের মুখ বন্ধ। সেলাই করা ঠোঁট। প্রতিবাদ করলে কোন সময় গরু-ছাগল জবাই করা ছুরি নিয়ে বিহারি তেড়ে আসবে বলা মুশকিল। যে সকল জামাত কিংবা মুসলিমপন্থী বাঙালি খানের দালাল হলেন, কেউ প্রতিবেশী বাঙালির ষড়যন্ত্রের শিকার হলেন, ব্র্যান্ডিং হলেন, তারা দেশ স্বাধীনের পর জেলে গেলেন। তাদের বিচার হলো। খানের দালাল রাজটিকা তকদিরে বসে গেল, কেউ কেউ ফাঁসিতে ঝুলল; কিন্তু বিহারিদের কিছু হলো না। তাদের বাঙালি হত্যা, বাঙালির বাড়িঘর লুটপাট এসবের কোনো বিচার পঞ্চাশ বছরেও কোনো সরকার করল না, কিংবা এড়িয়ে গেল। আজ শহরের বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ কসাইপট্টি বিহারি নিয়ন্ত্রণ করছে, এমনকি পৌরসভার কাউন্সিলর বিহারি হয়ে যাচ্ছে। কোথায় আপনার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী ভদ্র মহোদয়গণ? আজও কেন জেনেভা ক্যাম্পের বিহারিদের পাকিস্তান ফেরত পাঠাতে পারলেন না? এই যে বিহারিরা একাত্তরে বাঙালি হত্যা করল, হত্যায় সহযোগিতা করল, বাঙালির বাড়িঘর লুটপাট করে তাদের নিঃশ্ব করে দিল, সে-সবের বিচার হবে? একজন বললেন, ‘স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে, আজ কেন বিহারি-বাঙালি করছেন? আমরা সবাই বাংলাদেশি। পুরোনো ক্ষত চুলকিয়ে রক্ত বের করছেন?’ এই যদি জবাব বা ওজর হয়, তবে এই প্রসঙ্গ থাক; তবু একটি প্রশ্ন থেকে গেল, তা হলে ইতিহাস লেখা হয়, বিচার হয় না। বাচ্চু খানরা আবার হয়তো একদিন আমাদের বর্গির মতো ভয় দেখাতে শুরু করবে, আর আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে সিঁটিয়ে থাকব।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০২১ বিকাল ৪:৩৩