১৯৯৫ সালের ২৭ আগস্ট তারিখটা দেশের অধিকাংশ মানুষের স্মৃতিতে জাগরুক আছে কি না তা আমাদের জানা নেই। তবে এরপরে আরও পুলিশি চাঁদাবাজি, অত্যাচার-নির্যাতন, ডাকাত সাজিয়ে হত্যা, টিজিং-ধর্ষণ ইত্যাদি ঘটনা প্রাবল্যে আজ হয়তো সেই ঘটনা ম্লান হয়ে থাকতে পারে। এছাড়া ওই সময়ের ঘটনা প্রবাহের পরবর্তী দিনগুলোতে সুশীল সমাজ ও সাধারণ জনতার যে তৎপরতা দেখা গিয়েছিল আজ তার লেশমাত্র নেই। একজন বালিকার উপর পুলিশি পাশবিকতা ও হত্যা ঘটনার প্রতিবাদ ও বিচার দাবিতে জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের গুলিতে আজকের ২৭ আগস্ট ’৯৫ তারিখে নিহত হয়েছিল কয়েকটি তাজা প্রাণ। মতান্তরে সাত কিংবা তারও বেশি হলেও নাম বাস্তব প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে আব্দুল কাদের, মেহরাব আলী সামু আর সিরাজের নাম। এরা ওইদিন শহরের ব্যস্ততম এলাকা লিলিমোড় ও আশেপাশে নিহত হন।
ঘটনার কেন্দ্রে আছে ইয়াসমিন নামক এক বালিকা। তার বয়স ছিল ১৪ বছর। দিনাজপুর শহরের রামনগর এলাকার দরিদ্র মা শরীফা বেগমের মেয়ে। শরীফা বেগম একজন স্বামী পরিত্যক্ত মহিলা। তার স্বামী মোহম্মদ আব্দুল জব্বার তাকে তালাক দিয়ে দেন। ফলে আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে তার মেয়ে ইয়াসমিন ঢাকার ধানমন্ডি ১নং সড়কের ১৩নং বাসার এক পরিবারে গৃহপরিচারিকার কাজ করত। এই পরিবারটির গৃহস্বামীর নাম আবুল আহসান আহমদ আলী এবং তার গ্রামের বাড়িও দিনাজপুর জেলায়। ইয়াসমিন সেখানে আট-নয় মাস কাজ করার পর নিজ বাসায় ফেরার জন্য, বিশেষ করে মাকে দেখার জন্য ছটফট করতে থাকে। গৃহস্বামী তাকে দুর্গাপুজার ছুটিতে যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু বাড়ি যাওয়ার জন্য উতলা ইয়াসমিন সে বাক্যে সান্তনা পায়নি আর সম্ভবত তাই ওই বছরের ২৩ আগস্ট ওই পরিবারের ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে একাই দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যায়। সে উঠে পড়ে দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁ গামী নৈশকোচ হাছনা এন্টারপ্রাইজে। এই কোচটি ঠাকুরগাঁ শহরের গন্তব্যে চলাচল করে, দিনাজপুর শহর নয়। দিনাজপুর শহরে যাওয়ার জন্য দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁ-রংপুরের জন্য টার্নিং পয়েন্ট বা সংযোগস্থান দশমাইল এলাকায় এসে অন্য বাস বা যানবাহন ধরতে হয়। ইয়াসমিনের কাছে কোচভাড়া ছিল না। কোচটি দিবাগত রাত ২৪ আগস্ট ভোর তিন থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যে দশমাইলে পৌঁছে। তখন ভোরের আলো তেমনভাবে ফুটতে শুরু করেছে মাত্র, অনেকটাই অন্ধকার। তবে যাত্রাপথের সংযোগ এলাকা বলে দশমাইলে চায়ের স্টল খাবারের দোকান প্রায় খোলা থাকে। জনসরগরমও থাকে। কোচের সুপারভাইজার খোরসেদ আলম ও হেল্পার সিদ্দিকুর রহমান ইয়াসমিনকে জনৈক জোবেদ আলীর চা’স্টলে নামিয়ে দেয়। তারা স্টল মালিককে এই বলে অনুরোধ করে যে, মেয়েটিকে যেন দিনাজপুরগামী কোনো গাড়িতে উঠিয়ে দেয়া হয়। জানা যায়, সেসময় আর একজন যাত্রীও বাস থেকে নামে যার নাম জয়ন্ত এবং বাড়ি ঠাকুরগাঁ কলেজ রোডে। কোচ থেকে নেমে জয়ন্ত ও ইয়াসমিন জনৈক হাফিজুলের চা’স্টলে বসে যা জোবেদ আলীর চা’স্টলের কাছেই। তারা সেখানে নাস্তা খায়। তারপর তারা সামনের রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘোরি করে।
কোচের সুপারভাইজার একাকী এক কিশোরীকে তার অপরিচিত স্থানে নামিয়ে দিলে দশমাইলের কয়েকজন স্বউদ্যোগী মানুষ তাকে নিরাপদে দিনাজপুর পৌঁছে দেয়ার তাগিদ অনুভব করেন। সেই প্রেক্ষিতে আবদুর রহিম নামক এক পান দোকানদার, ইয়াসমিনকে জিজ্ঞেস করে যে, সে কিভাবে দিনাজপুর শহরের রামনগর মহল্লায় যাবে। তখন জয়ন্ত বলে যে, সে দিনাজপুর যাবে এবং তাকে পৌঁছে দেবে। এতে আবদুর রহিম ও অন্য কয়েকজন আপত্তি জানিয়ে বলে যে, যেহেতু কোচের সুপারভাইজার তাদের উপর দায়িত্ব দিয়ে গেছে সেহেতু তারাই ইয়াসমিনকে দিনাজপুর গামী গাড়িতে তুলে দেবে। এরকম পরিস্থিতিতে সেখানে বীরগঞ্জ থেকে একটি পুলিশ পিকআপ ভ্যান নং ‘ম-০২-০০০৭’ এসে পড়ে। সে পিকআপের ড্রাইভার অমৃতলাল জটলার কাছে বিষয়টি জানতে চায়। পিকআপে আরও দুজন বসে ছিল, তারা হলো এসআই মইনুল এবং আব্দুস সাত্তার। অমৃতলাল সরাসরি ইয়াসমিনকে বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করে। এরপর ঘটনার আনুপুর্বিক জানা হলে সে বলে, আমরা দিনাজপুর যাচ্ছি, আমাদের সাথে চলো, পৌঁছে দেব। কিন্তু ইয়াসমিন পুলিশের সাথে যেতে ভরসা পায় না। সে প্রত্যুত্তরে জানায় যে, সে সকাল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে ও নিজেই চলে যাবে। কিন্তু অমৃতলাল তাকে ধমকে বলে, ‘কি হলো তোমাকে উঠতে বলছি, উঠছ না কেন?’ অমৃতলাল উপস্থিত জনতাকে বলে যে, তারা আইনের লোক, তাদের অবিশ্বাস কেন? মেয়েটিকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেয়া হবে।
অবশেষে ইয়াসমিন পুলিশের পিকআপ ভ্যানে উঠে। পিকআপ ভ্যানটি রওয়ানা দেয় ও সেখান থেকে আড়াই শ তিন শ গজ দূরত্বে সাধনা প্রাইমারি স্কুলের কাছে থেমে আবার কিছুটা পেছনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। দশমাইলের জনতা প্রত্যক্ষ করে যে, পুলিশ টর্চ দিয়ে কিছু একটা বা কাউকে খুঁজছে। রাস্তা সোজা বলে সবকিছু দৃশ্যমান হচ্ছিল। এ সময় ওই স্কুলের দিক থেকে ধান বোঝাই দুটি রিকশাভ্যান আসছিল এবং পুলিশ তাদের জিজ্ঞেস করে যে, তাদের পিকআপ থেকে যে মেয়েটি লাফ দিয়েছে তাকে তারা দেখেছে কি না? তারা এর নেতিবাচক জবাব দেয়। ঠিক ওই মুহূর্তে ঢাকা থেকে দিনাজপুরগামী একটি নৈশ কোচ ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল এবং সেই কোচের হেডলাইডের আলোয় পুলিশ ও উল্লেখিত রিকশাভ্যান চালকেরা দেখতে পায়, ইয়াসমিন রাস্তার উপর পড়ে আছে। এরপর পুলিশেরা তাকে পিকআপ ভ্যানে তুলে নেয়।
পরবর্তীতে ওই এলাকার লোকজন সাধনা স্কুলের ওখানে রাস্তায় রক্তের দাগ দেখতে পায়। আশে-পাশে ইয়াসমিনের জুতা, রুমাল, হাতপাখা ও ভাঙ্গা চুড়িও পড়েছিল। লোকজন তা দেখে সেখান থেকে দশ মাইলে ফিরে যায়। এর তিনঘন্টা পরে গোবিন্দপুর সড়কে ব্রাক অফিসের সামনে ইয়াসমিনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। সেসময় কয়েকজনের জবানিতে জানা যায় যে, একটি পুলিশভ্যান থেকে ‘কিছু একটা’ ফেলে দেয়া হয়েছে। এরপরের ঘটনা খুব দ্রুত ঘটতে থাকে।
ওইদিন ২৪ আগস্ট ’৯৫ দশমাইল মোড়ে সকাল দশটায় পূর্ব-মল্লিকপুর কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল মজিদের সভাপতিত্বে জাগপা’র স্থানীয় নেতা, উত্তরণ সংঘ ও স্পোর্টস ক্লাব ইত্যাদি সংগঠন যৌথভাবে এক প্রতিবাদ সভা করে। তারা ঘটনার প্রতিবাদ ও ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ন্যায্যবিচার দাবিতে ওই সড়কে দুই ঘন্টা যান চলাচল অবরোধ করে রাখে। সেখান থেকে একটি মিছিল বের হয়ে দিনাজপুর শহরে আসে এবং শহরের জনগণ ঘটনার বিষয়টি আনুপুর্বিক অবগত হন। দিনাজপুর কোতয়ালী পুলিশ বিষয়টি সামাল দেয়ার জন্য ‘একজন অজ্ঞাত পরিচয় যুবতীর লাশ উদ্ধার’ মর্মে ঘটনাটি সাজিয়ে থানায় একটি ইউডি মামলা ফাইল করে। লাশের তড়িঘড়ি ময়নাতদন্ত শেষে আঞ্জুমানে মফিদুলের মাধ্যমে বালুবাড়ি শেখ জাহাঙ্গীর গোরস্থানে দাফন করা হয়। লাশের কোনো প্রকার গোসল ও জানাজা করা হয়নি। এখানে উল্লেখ্য যে, উত্তর গোবিন্দপুর এলাকায় পড়ে থাকা ইয়াসমিনের লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির উদ্দেশ্যে কোতয়ালী থানার এসআই স্বপন কুমার প্রকাশ্যে জনতার সামনেই লাশ উলঙ্গ করে ফেলে, যা উৎসুক জনতার মাঝে ক্ষোভ সঞ্চার করে।
২৫ আগস্ট ’৯৫ দিনাজপুর শহরের স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোয় ঘটনাটির পরস্পর বিরোধী ও বিভিন্নরকম খবর প্রকাশিত হয় এবং জনমনে রহস্যের কুয়াশা ও গুজব আরও ছড়িয়ে পড়ে। আগেরদিন ঘটনার অব্যবহিত পরে পুলিশ প্রকৃত ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়া ও অন্যখাতে সরিয়ে নেয়ার জন্য যে রহস্যময় আচরণ করে আসছিল তার অংশ হিসেবে পুলিশ স্থানীয় সাংবাদিক নামধারী হলুদ সাংবাদিকদের ক্রয় করার চেষ্টা করে ও নিহত ইয়াসমিনকে ‘পতিতা বানু’ বানাবার চক্রান্ত চালায়। অভিযোগ পাওয়া যায় যে, কিছু সংবাদপত্র দরদামে বনিবনা না হওয়ায় ও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের নটবরদের নেপথ্য ইন্ধনে ঘটনাটির খবরে পরস্পর বিরোধী ও অস্বাভাবিক কভারেজ করে।
২৬ আগস্ট ’৯৫ শহরে ঘটনার বিষয়ে রামনগর মোড়ে মিটিং আহ্বানের মাইকিং হতে থাকে। মাইকিং’এর রিকশা কোতয়ালী থানা এলাকা পেরোবার সময় পুলিশ মাইক ভেঙ্গে দেয়। এই ঘটনার খবর রামনগর এলাকায় পৌঁছয় ও আশেপাশের এলাকার লোকজন সংগঠিত হতে শুরু করে। ওইদিন সন্ধেরাতে রামনগর মহল্লার মোড়ে ইয়াসমিনের গায়েবি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে সমাবেশ থেকে রাত দশটার দিকে প্রতিবাদী জনতা বিক্ষোভ মিছিল সহকারে কোতয়ালী থানা ঘেরাও করে। তারা অভিযুক্ত তিন পুলিশ কর্তৃক ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদ, ন্যায্য বিচার ও শাস্তি দাবি করে। এসময় পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করে। এতে আট-দশজন ব্যক্তি আহত হয়। পুলিশ ছয় রাউন্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে। গুলির খবরে থানা ঘেরাও’এ আরও শত শত মানুষ যোগ দেয় এবং তারা সারারাত থানা অবরোধ করে রাখে।
একজন পরিচিত বালিকাকে ‘অজ্ঞাত পরিচয়’ ও ‘পতিতা’ বানানো, তাকে সর্বসম্মুখে বেআব্রু করা, গোসল ও জানাজা ব্যতিরেকে লুকোচাপা সতর্কতার সঙ্গে লাশ দাফন করা, সেই কবরে প্রহরার ব্যবস্থা নেয়া, বানুকে মেরে কবরের লাশ বদলের পাঁয়তারা ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কিত পুলিশ ও প্রশাসনের রহস্যময় আচরণ জনমনে কৌতূহল ও বিক্ষোভ শতগুনে জাগিয়ে তোলে।
২৭ আগস্ট ’৯৫ সকাল থেকে শহরের পরিস্থিতি থমথমে থাকে। ধীরে ধীরে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জনতার জটলা তৈরি হয়। সকাল এগারোটার দিকে ঘটনার প্রতিবাদ ও ন্যায্যবিচার দাবিতে শহরে একটি বিশাল মিছিল বের হয়। মিছিল চলাকালে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ, জনতা কর্তৃক পুলিশের ভ্যানে ইট পাটকেল ছোঁড়া, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, পুলিশ কর্তৃক লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ ইত্যাদি ঘটনা সংঘটিত হতে থাকে। সবচেয়ে বড় সংঘর্ষ হয় লিলিমোড় এলাকায়। এখানে একটি পুলিশ ফাঁড়ি থাকায় পুলিশ সেখানে বিক্ষোভকারীদের একজনকে আটক করে ও বেদম পেটাতে শুরু করে। জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। অন্যদিকে পুলিশ মিছিলে নির্বিচার লাঠিচার্জ করতে থাকে। এক পর্যায়ে বেলা বারোটার দিকে পুলিশ জনতার উপর গুলি চালালে আব্দুল কাদের নামক এক ব্যক্তি সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। এসময় জনতা ছত্রভঙ্গ হলেও তারা কাদেরের লাশ নিয়ে নেয়। এর কিছুক্ষণ পর লিলিমোড়ের উত্তরে জেলরোড এলাকায় মেহেরাব আলী সামু নামে আর এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়। তিনি ক্রলিং করে একটি আইল্যান্ডে লুটিয়ে পড়েন। তখন তিনি জীবিত ছিলেন। পুলিশ তার দিকে এগিয়ে এসে বুকের উপর বুটের লাথ মেরে টেনে হিঁচড়ে পিকআপ ভ্যানে তোলে। এসময় কয়েকজন ব্যক্তি তাকে বাঁচানোর জন্য পুলিশকে অনুরোধ করে যে, সামুকে তাদের দিয়ে দেয়া হোক। কিন্তু পুলিশ তা না করে অচেতন সামুকে ভ্যানে তুলে পা দিয়ে চেপে ধরে। কিছুক্ষণ পর সামু মারা যান। একইসময় জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশনের বাউন্ডারি দেয়ালে বসে থাকা এক আট-দশ বছরের ছেলেকে পুলিশ ডেকে ধরে পিকআপভ্যানের সাথে আছড়িয়ে মারে বলে জানা যায়। একইদিন থানার সামনে অন্য একটি মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে সিরাজ নামে এক রিকশাচালক গুলিবিদ্ধ হয়। সিরাজ তখনও জীবিত ছিলেন, কিন্তু পুলিশ তাকে তুলে থানায় নিয়ে রেখে দেয়। সিরাজ সেখানে মারা যান। বিকালের দিকে উত্তেজিত জনতা ডিবি অফিসের দিকে মিছিল করে এগোলে পুলিশ সেখানেও জনতার উপর গুলিবর্ষণ করে। এতে রেলওয়ে ইস্টিশান বস্তির একটি শিশু গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এই লাশটিও গুম করা হয়।
ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদ আন্দোলনে নিহত হয় সাত ব্যক্তি। কিন্তু পুলিশ ও প্রশাসন কর্তৃক লাশ গুম হওয়ার কারণে তিনজনের লাশ ও পরিচয় পাওয়া যায়। জনতা চারটি পুলিশ ফাঁড়ি, চারটি পুলিশ ভ্যানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এই সুযোগে কিছু দুষ্কৃতিকারী চুড়িপট্টি এলাকার কাস্টমস গোডাউনে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। শহরের প্রধান প্রধান রাস্তায় কাঠ ও ইটের স্তূপ ফেলে রাখা হয়। এছাড়া টায়ার জ্বালিয়ে বেরিকেড করা হয়। ওইদিন শহরে কার্ফ্যু জারি করা হয় ও শহরের আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্ব বিডিআর’এর হাতে দেয়া হয়।
আগস্ট ১৯৯৫ সালে পুলিশ কর্তৃক ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা ও তৎপরবর্তী সময়ে প্রতিবাদকারী জনতার উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং পরিণতিতে আরও তিনজন (মতান্তরে সাতজন) নিহত হওয়ার বিচার দাবিতে কয়েকটি মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৬ (৪) ধারায় অভিযুক্ত এসআই মইনুল হক, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার ও ড্রাইভার অমৃতলাল বর্মণের বিরুদ্ধে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার চার্জ গঠন করা হয়। অন্যদিকে পরিস্থিতি আরও অবনতি করা, দায়িত্বহীনতা ও হত্যার জন্য অন্য কয়েকটি মামলা বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩০২, ২০১, ১০১ ও ৩৪ ধারা মতে রুজু করা হয়। যার প্রধান আসামী ছিল: ১) এ কে এম জব্বার ফারুক (সংশ্লিষ্ট সময়ে জেলা প্রশাসক), ২) আব্দুল মোতালেব (সংশ্লিষ্ট সময়ে পুলিশ সুপার) ৩) ফকরুদ্দীন আহমদ (সংশ্লিষ্ট সময়ে ম্যাজিট্রেট) ৪) স্বপন কুমার চক্রবর্তী (সংশ্লিষ্ট সময়ে এসআই কোতয়ালী থানা), ৫) রেজাউল করিম (সংশ্লিষ্ট সময়ে এসআই কোতয়ালী থানা) ৬) মাহতাবউদ্দিন (সংশ্লিষ্ট সময়ে এসআই কোতয়ালী থানা)।
বিচারের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে অভিযুক্ত এসআই মইনুল হক, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার ও ড্রাইভার অমৃতলাল বর্মণের বিরুদ্ধে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার চার্জ প্রমাণীত হয়। ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর রাত ১২টা এক মিনিটে রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে একই মঞ্চে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কিন্তু অপর মামলাগুলো একসাথে ট্যাগ হলেও তার পরিণতি অজ্ঞাত রয়েছে।
১৯৯৫ সালের পুলিশের দায়িত্বরত সদস্য কর্তৃক একটি বালিকা ধর্ষণ ও হত্যার পরবর্তী ঘটনার সুযোগ অনেকেই নিয়েছে। মিথ্যে তথ্য দিয়ে কিছু কিছু সংবাদপত্র সম্পাদক আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেছে। তথাকথিত এনজিও সমাজ, সমাজসেবক ও জনদরদীদের অনেক কথা শোনা গেছে। মিটিং-সেমিনার-টক শো হয়েছে। লিফলেট-পোস্টার জনতার হাতে হাতে পৌঁছেছে ও দেয়ালে দেয়ালে শোভা পেয়েছে। কিন্তু মৃত ব্যক্তিদের সম্মান ও স্মরণার্থে শহরের বিভিন্ন রাস্তার যে নামকরণের কথা বলা হয়েছিল তা আর হয়নি। দশমাইলে একটি ইয়াসমিন স্তম্ভ দেখা গিয়েছিল; এখন তার কোনো অস্তিত্ব নেই। দিনাজপুর ও দেশের মানুষ কী সেই ট্রাজেডি ভুলে গেছেন?
রচনা: ২২.০৮.২০১১
প্রকাশ: ২৪.০৮.২০১২ যায় যায় দিন
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৪৪