রাত দুটোয় সুঁই খুঁজে পাওয়া বেশ মুস্কিল। খাতা সেলাই করা সুঁই। এখন আমার খাতা লাগে না। কোনোকিছু লিখি না। সুঁই দরকার অন্য কাজে। এ মুহূর্তে ভীষণ দরকার। কেননা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কোনোকিছু তুলে ফেলবার মতো এরচেয়ে ভালো টুলসের খবর জানা নেই। মাথায় আসছে না।
মিলা ঘুমিয়ে আছে। আমার ঘুম হয় না। দিনশেষে শরীরের যতটুকু ক্লান্তি, সেই সময়কাল নিঃসাড় পড়ে থাকি। মিলা ঘুমোয়। তাকে ডেকে তোলা যায় না। সারাদিন এটা-ওটা নানান কাজে নিজেকে ছড়িয়ে রাখে। মেয়েদের অনেক কাজ, বাসন মাজামাজি, রান্না, সকলকে খাওয়ানো, কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা, বিছানা ঠিক করা কত কি! সে কাজের কোনো হিসাব নেই, থাকে না। সে রাতে মোষের মতো ঘুমোয়। তাকে ডাকি না। সকালে অন্তত পঁচিশবার অভিযোগ করবে। ‘মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছ...এখন মাথাব্যথা করছে। ইত্যাদি ইত্যাদি।’
তারপর হাই তুলবে। মেয়েরা যে ঘুমকাতুরে কে না জানে! এসব ভালো লাগে না। এখন আমার একটি মজবুত সুঁই দরকার। আমার চারপাশে শুধু অভিযোগ। অসহ্য! নিজের কাছেও আমার শত নালিশ। তাই এই নির্জন নিস্তব্ধতায় সুঁই দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সকল অভিযোগ রক্তাক্ত করা যায়। মুখ আর গালের যন্ত্রণা কমে। এ ছাড়া আমার কোনো পথ নেই। কেননা ফেস ইজ দ্য ইনডেক্স অব মাইন্ড। আমার চেহারায় নিরত্যয় বিমর্ষতা। বিষণ্ন মুখ। চেহারায় শত শত অভিযোগ আর হতাশার বিবর্ণ তৈলচিত্র। মানুষ বিষণ্ন মুখায়বব পছন্দ করে না। আমি তেমন একজন কেউ পছন্দ করে না। যেখানে দাঁড়াই গাছের পাতা শুকিয়ে যায়। ছায়া ছায়া চমৎকার দিন কালো মেঘে মেঘে আচ্ছন্ন হয়। আমি তাই ঘরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে থাকি। আমার কোনো দিন বা রাত নেই। শুধু অন্ধকার। একসময়ে আলোয় ছিলাম। আলোকিত করার চেষ্টা ছিল। এখন শুধু যন্ত্রণা। এ কষ্টের শেষ হওয়া দরকার। একটি সুঁই দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। কলজের অস্বস্তি এড়িয়ে কষ্ট গেঁথে গেঁথে বুকের রক্ত ঝরালে মাথা হালকা হবে। চেহারা-গাল-মুখের যন্ত্রণা কমে যাবে। আমি নিশ্চিত। এ ছাড়া আপাতত অন্যকোনো পথ নেই।
দিন কয়েক আগে সেই লোকের কাছে গেলাম। তার অ্যাসিস্ট্যান্ট স্পাইরেল নোটবুকে নাম লিখছিল। নামের তালিকা। সিরিয়াল নম্বর। আমার সিরিয়াল হলো সাতাশ। অদ্ভুত সংখ্যা। সাতাশ, সাতাশের যুবক, এখন সাতাশ দ্বিগুণে চুয়ান্ন; চুয়ান্নের বৃদ্ধ। নিজেকে বৃদ্ধ ভাবতে সকলের কষ্ট লাগে। কেননা যুবাকালের সোনালি দিন আর মধুময় স্মৃতি মনের গভীরে বড়শি বা আঁকশিতে লটকে থাকে। ছাড়তে চায় না। ইচ্ছে করে না। তবু দিনে দিনে ধীরে ধীরে বয়স বাড়ে, কেউ বলে কমে; যেহেতু অন্ত্যেষ্টেক্রিয়ার দিন ঘনিয়ে আসে। মানুষের জীবন ওয়ানটাইম বলপয়েন্ট কলম। এক কিলোমিটার, আসলে তেমন দূরত্বের সত্যি কি না প্রমাণিত নয়, যেটুকু পথ পেরোন যাক; শেষ তো আয়ুর সমাপ্তি। এত দীর্ঘ পথ পেরিয়ে শেষে তীরে এসে মনে হয়, এই তো সেদিন কি সুন্দর দিনগুলো চলে গেল! আহা এত দ্রুত ফুরিয়ে গেল সবকিছু! জীবন কত ছোট! লোকটিকে বলি, -
‘নাম তালিকায় একটু সামনে এগিয়ে নেয়া যায় না?’
সে এমনভাবে তাকাল যে, ব্যাটা দুদকের চেয়ারম্যান; সত্যনিষ্ঠ যুধিষ্ঠির! তার বিস্ময় আবর্তিত জিজ্ঞাসা, -
‘আপনার সিরিয়াল?’
‘সাতাশ।’
‘সাতাশ, মাহবুব আলী; এতগুলো লোককে টপকিয়ে আপনাকে নেব?’
‘একটু দেখেন না, কিছু করা যায় কি না। সময় কম আর যন্ত্রণাও হচ্ছে।’
‘এদের বলেন, তারা যদি বলে।’
এরপর আর কোনো কথা থাকতে পারে না। সকলের তাড়া আছে। স্বার্থ আছে। যেমনভাবে খুব অনায়াসে যন্ত্রণার ওজর দিয়ে গেলাম। যন্ত্রণা ছিল এখনো আছে। তেমন যন্ত্রণা থাকলে কোনোকিছু করার নেই। দুটো প্যারাসিটামল সে যন্ত্রণার কিছু দমিয়ে রেখেছে মাত্র। এ যন্ত্রণা সহজে যায় না। তখন গোধূলির আকাশে বিশাল সূর্য, ডিমকুসুম হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ঝিলমিল করছে। হাসপাতাল রোডে প্রচুর ধুলো, রিকশা আর নানান রেস মানুষের ভিড়। জোড়াব্রিজের পার্শ্বে ক্লিনিকের ফার্স্ট ফ্লোরে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখা যায়। অনুভব করা সহজ। সিরিয়াল সাতাশ। আমার সেলফোনের শেষ দুই ডিজিট তেরো, আনলাকি থার্টিন। সবকিছুতে আনলাকি। ব্যাংকে গেলাম, হিসাব নম্বরের শেষ ডিজিট হলো সাত। সাত নাকি লাকি নম্বর। সেই লাকে দেখা গেল, হিসাব নম্বরে কোনো টাকা বাড়ে না; শুধু চার্জ দিতে হয়। এভাবে একদিন আরব্য উপন্যাস শেষ। শাহারজাদির গল্পের যবনিকা। উপসংহার যা সে শুধু ভীষণ ভারী এক দৈত্য জীবনের কাঁধে শক্ত করে গেঁথে বসে গেছে। সে অ্যাকাউন্ট একদিন বন্ধ হয়ে গেল, সে যাক; এসব নিয়ে আর তেমন ভাবনা নেই।
লোকটির নাম মোকসেদ। কেউ ঠিক এমন অথবা তেমন নামে ডেকে উঠেছিল। এখন সেই ডাকে সাড়া দেয়। অতএব মোকসেদ। অপেক্ষার ঘরে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছে কয়েকজন। একজন তরুণী উপস্থিত সকলের কমবেশি মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। সে বোঝে কি বোঝে না, নাকি কোনোকিছু জানে না, জেনেও না জানার ভান করে আছে কে জানে! এ পোড়া দুচোখ তার দিকে ঘুরে এলো কয়েকবার। তার পরনে লাল জমিনের উপর হলুদ-কালো-সবুজ-বেগুনি রঙের ফুল আর ফার্ণের প্রিন্ট, সে লতাপাতা ফুল আর কি কি ঠিক বোঝা যায় না; তবে আশ্চর্যরকম আকর্ষণ আছে। একগোছা হালকা চুল আর পেছনে পরচুলা দিয়ে তৈরি খোঁপা। সেখানে একটি জবা ফুল। আমার দৃষ্টি মেয়েটির চোখ-মুখ-ঠোঁট আর ডানদিকের স্ফীত গণ্ড ঘুরে এসে বারবার জবার লালে থমকে দাঁড়ায়। না এ ফুলের সঙ্গে কোনো পিরিত নেই। সত্যি বলতে অনেকদিন জবা ফুল দেখিনি। যুগপৎ ভাবনার ঢেউ বয়ে যায় মস্তিষ্কের তন্ত্রীতে। সেগুলো ঘুরপাক খায়, একটি গ্রহের দুটি কক্ষপথে যেমন দুটি উপগ্রহ পরিক্রমণ করে, করতে থাকে; কখনো মনে হয়, জুয়ার আসরে সুতীক্ষ্ণ তীরচক্রের মতো কোনো মায়াজাল। হুইল অব ফরচুন। আমার কোনো ফরচুন নেই।
কোনো কোনো দিন একজন জবাকে দেখি বাসের ভেতর। প্রাইমারি স্কুলের টিচার। জোড়াব্রিজ থেকে ছেড়ে যাওয়া বগুড়া মেইলে কখনো দাঁড়িয়ে কখনো ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে বসে বসে হেলেদুলে আমবাড়ি গিয়ে নামে। তারপর হাঁটা পথ। একদিন কথা হয়, সে নাকি সতীশ বাবুর ভাগিনি। চারটি থার্ড ডিভিশন নিয়ে একেবারে আঠারো বছরের অভিজ্ঞ প্রভাষক সতীশ বাবু, অর্থশালী ভূস্বামী লোক; তারপর মাইনরিটি কোটা। এ দেশে টাকায় কি না হয়! বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা ওঠে, দস্যু আর ক্যাডারেরা আইন তৈরির ঘরে বসে মাঝে মধ্যে তাশ পেটায়। এ সমাজে সবকিছু সম্ভব। এসব না জানলেই ভালো...বলতে গেলে শত বিছুটির দংশন। রিমান্ড আর টর্চার। আমার সাধের গণতন্ত্র!
জবার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে সুন্দর করে হাসে। মেয়েদের হাসিতে কি জাদু মাখা কে জানে, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি তার রহস্য খুঁজে গেছেন; আমার দৃষ্টি কোন্ ছার! অবাক হয়ে থাকি আর চুয়ান্ন বছরের ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে দুঃখের স্রোত বুকের শিরা উপশিরায় লাভার ঢেউ হয়ে বয়ে যায়। হায় জীবন! আজ হাসতে ভুলে গেছি। এখন অনন্ত পিপাসায় ইলেকট্রনিক মিডিয়া খুলে ভিনদেশি কমেডি সার্কাস দেখতে হয়। অ্যাডাল্ট কথনের টুকরোতে হাসির গমকে গমকে কিম্ভুতকিমাকার কম্পন বাতাসে ঢেউ তুলে তুলে ঘরের দেয়াল থেকে আছড়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে অবশেষে।
আমার দুচোখ ঘুরে ফিরে জবায় এসে হোঁচট খেতে থাকে। অনেকদিন পর জবা ফুল দেখছি। বহু বছর দেখিনি তাকে। আর এ জনমে দেখা হবে এমন ভরসা বা বিশ্বাস নেই। দেখা হলে কী হবে? এমন উৎকট ভাবনায় শিহরনের কোনোকিছু নেই জেনেও ভাবতে বসি। জবা থেকে জোর করে দৃষ্টি সরিয়ে আকাশে চোখ রাখি। সন্ধ্যে নামছে। চারপাশে হাত-পা ছড়িয়ে গভীর অন্ধকারের প্রস'তি। সিরিয়াল পাঁচ ভেতরে গেছে। একেকজন প্রায় কুড়ি থেকে ত্রিশ মিনিট। কেউ কেউ তারও বেশি। সিরিয়ালের কয়েকজন নেই। মোকসেদ ঘন ঘন বাইরে তাকায়। উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে তার কোনো রঙিন হাউজি খেলা চলে। কখনো নির্বিকার অথবা কৌতূহলি বোলচাল। এরমধ্যে সাতাশ আসতে অনেক দেরি। সেই দেরিতে অনুপসি'ত লোকজন ‘ইয়েস স্যার’ হয়ে যাবে নিশ্চিত। আমি আবার জবায় চোখ ফেলে রাখি । আমি আর জবাফুল। জবাফুল একুশ-বাইশ, আমি সাতাশ; চুয়ান্নকে গোলি মারো! আমি তাকে ভাবতে বসি। মহুয়াকে মনে পড়ে। ওদের বাসার পশ্চিম দেয়াল ঘেষে জবার একটি গাছ ছিল। গন্ধহীন ফুল দেখতে দেখতে কত দিন অপরাহ্ণে তার সঙ্গে দৃষ্টির যোগ হয়েছে। তেমন করে কোনো কথা না বলেও দু-জন কত কাছের আর দু-জনের হয়ে গেছি! সে শুধু স্মৃতি, শত শত দৃষ্টির সংযোগ হলো; যোগফল হয়নি। সে এখন কোথায়?
আমি ড্রয়ার খুলে খুঁজতে বসি। সেখানে প্লাস্টিকের তিন-চারটি কৌটা, সবগুলোই শেষ হয়ে যাওয়া কোনো না কোনো কসমেটিক্সের; এর কোনো একটিতে সুঁই থাকতে পারে। কোথায় কোন্টিতে? আমার ড্রয়ারে একটি অ্যান্টিকাটার রয়েছে। সুতীক্ষ্ণ ভয়ংকর! সেটি দিয়ে কাজ হবে না। নির্দিষ্ট কাজের জন্য বিশেষ টুলস বা অস্ত্রের দরকার পড়ে। এটি লঘু অপরাধে গুরু দণ্ড। এরজন্য সুঁই সবচেয়ে উপযুক্ত। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করা যায় সহজে। উপড়ে তুলে ফেলা যায় বা যেতে পারে যন্ত্রণার শিকড়।
মিলার দিকে তাকাই। তার নাক আর ঠোঁটের উপর মৃদু স্বেদবিন্দু। শুনেছি, এমন মেয়েরা নাকি স্বামী-সোহাগি হয়, ছেলেরা বউ-পিয়ারি। অনেক কথা মনে পড়ে যায়। মহুয়া একদিন বলে, -
‘তোমার ভাগ্য ভালো...বউ-পিয়ারি।’
‘সে তো এখন থেকেই দেখছি প্রিয়, আমিও তোমায় খুব ভালবাসি।’
‘কেমন?’
‘খুব মানে প্রচণ্ড!’
মহুয়ার সঙ্গে শেষ-অবধি কিছু হলো না। জানা গেল না, স্বামী-পিয়ারি আর বউ-পিয়ারির খাবনামা। এর সকল দায় আমার। কোনো কোনো রাতে ঘুম ভেঙে গেলে জানালা গলিয়ে দূর আকাশে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিই। রাতের আকাশ। তার পরতে পরতে অদ্ভুত সৌম্য শান্ত গভীরতা; অনাস্বাদিত রহস্যময়। তার পটভূমিকায় নক্ষত্রেরা হাতে হাত রেখে সখ্যতার ছায়াপথ তৈরি করেছে। আমার মনে আকস্মিক তার ছবি ভেসে ওঠে। সে ছবির কোনো বয়স বাড়ে না। সে মুখ রাতের আলোছায়া দেয়ালে ভেসে ভেসে চলচ্চিত্র হয়। অসম্ভব ফরসা এক কিশোরী, তার প্রজাপতি বেণিতে লাল ফিতের দুটি ফুল। কলাপাতা সবুজ কামিজ আর অফহোয়াইট পাজামা। নাকের ডগায় সদ্য ছিদ্রে বিবর্ণ-নীল সুতোর রিং। আমার কৈশোর স্বপ্ন দোলা। মিথ্যে স্বপ্ন আর কল্পনার অসমাপ্ত গল্প। সে কাহিনী একান্ত আপনার। কারও প্রবেশ অধিকার নেই। মিলার দিকে তাকাই। আমার মহুয়া ঘুমিয়ে আছে। তার কপালে চুলে স্পর্শ করি। ইচ্ছে করে একবার ‘মহুয়া’ বলে ডাকি। একবার দু-বার বারবার। না পারি না...পারা যায় না। একজনকে দিয়ে আরেকজনের শূন্যতা পূরণ হয় না। একজনকে সামনে রেখে অন্যজনের ভাবনা নিষিদ্ধ বিকৃতি। আমি চাই না...পারি না। মিলাকে জড়িয়ে ধরি। সে ঘুমের ঘোরে অথবা কোনো স্বপ্নের বালুকাবেলায় হেঁটে হেঁটে কাব্যবিভোর আমাকে তার বুকের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে। জীবনের এইটুকু প্রাপ্তি স্বর্গের চেয়ে বেশি।
আনলাকি থার্টিন ছিল না। সে এলো। সে নয় তিনি একজন মোটাসোটা মধ্যবয়সি মহিলা। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কোনো চ্যানেলে শাড়ি গয়নায় সেজেগুজে আসা রেসিপি অনুষ্ঠানে দেখা রাধুনির মতো। তিনি এখন চকোলেট কেক তৈরি শেখাবেন। এ দেশের অনেক মানুষ দু-বেলা ঠিকমতো ভাত জোগাড় করতে পারে না। তারা আধপেটা কি না-খেয়ে স্বপ্ন দেখে, দেখিস একদিন আমরাও; তারা কেক খাবে। আমি চকোলেট কেকের বাহার দেখে ঘন ঘন ঢোক গিলে ফেলি। থার্টিন মনে হয়, কোনো পার্লার থেকে এসেছেন। দুচোখের পাতায় সবুজ-রুপালি আভা আর ঘরের মধ্যে পারিজাত সৌরভ। তার কাছে জবাফুল অতি ক্ষুদ্র জোনাক পোকা। যুগপৎ দু-দিকে দৃষ্টি ফেলে আমি চেয়ারের দিকে তাকাই। প্লাস্টিকের চেয়ার ভেঙে যাবে না তো? তেমন কিছু হয় না। তিনি আয়েশে বসে গেলেন। একটি মেয়ে সঙ্গে এসেছে, আট দশ বছরের; একহাতে প্যাকেট ধরে চিপস খাচ্ছে। বোম্বে সুইটস। অপেক্ষার ঘরটিতে তখন পাটাশ পাটাশ শব্দে ভরে যেতে থাকে।
তখন আবুল হাসিম আর ইদ্রিশ আলির কথা মনে পড়ে যায়। তাদের চেহারা আর কথকথা ভেসে ওঠে। ইদ্রিশ আলি সকাল এগারোটায় অফিসে আসে। অফিস মুখে জোরে আওয়াজ তোলে ‘পাটাশ’। ফিরে যাওয়ার সময় বেলা আড়াই কিংবা তিন আরেকবার ‘পাটাশ’। আবছা অন্ধকার ঘরের কোণায়, ল্যাট্রিন যাওয়া আসার পথে ধ্যানমগ্ন বসে থাকি। দেশ আর মানুষের পক্ষে সরকারের গুষ্টি উদ্ধার করে সম্পাদকীয় ভাবনায় কাতর। শব্দটি পটকার মতো ফেটে ফেটে ভেসে ভেসে সেখানে পৌঁছয়, কাঁপতে থাকে; চেয়ার টেবিল হাঁপায়। মনে মনে কোনোদিন বুকের মধ্যে বেজে ওঠে সেই হাঁক। তার কোনো মানে জানি না, বুঝি না এর উচ্চারণে কিইবা মজা; একদিন দুপুরের শেষাশেষি অফিস থেকে ফিরে যেতে যেতে মুখ দিয়ে আকস্মিক দাঁড়কাকের মতো বেরিয়ে আসে ‘পাটাশ’। সবকিছু কি থমকে যায়? অফিসরুমের বাতাস, রাস্তার প্রান্ত বা অন্যকেউ? আবুল হাসিম মৃদু হাসতে থাকে। সে হাসি কত কুটিল আর মতলববাজ কে না জানে! তার চেহারা থেকে সেই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে সবখানে...রাস্তার গলি আর হাটবাজার। আসলে ‘পাটাশ’ কী?
মোকসেদ কাছে এসে দাঁড়ায়। হাতেধরা স্পাইরেল নোটবুক সেখানে নাম তালিকার ক্রমানুসার, সেটিকে পাখা করে ঝাঁকাতে থাকে। কিছুক্ষণ ঝাঁকানাকা নাকাঝাকা। স্বরাস্ট্র মন্ত্রীর ঝাঁকুনি তত্ত্ব। রানা প্লাজা এর কারণেই পড়ে গেছে। মরেছে এক হাজার এক শত পঁয়ত্রিশজন নারী-পুরুষ। মূল্যহীন মানুষের ক্ষতিপূরণ কয়েক হাজার টাকা!
‘স্যার আপনার কি খুব তাড়া?’
‘উঁ...একটু আগে করে দিতে পারলে খুব ভালো হয় আর কি!’
‘একটু এদিকে আসেন।’
মোকসেদ এখন সিরিয়াল পরিচালক, অবলম্বনহীনের অবলম্বন। প্যাসেজের ভেতরে আলোছায়া অন্ধকার। একটি পঁচিশ বা চল্লিশ ওয়াটের বালব হাঁশ-ফাঁশ করে হাঁপায়। তার ম্লান আলোতে জীবনের শত বেদনা শত যন্ত্রণা।
‘বারো নম্বর আসেনি, আপনি যাবেন?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ খুব ভালো হয়।’
‘চা খাওয়ার একটু আবদার করি স্যার।’
‘আচ্ছা আচ্ছা সে হবে ক্ষণ।’
এখন দিনদুনিয়া এ রকমই। পূর্ণচন্দ্র রায় আর মুসার কাছে গিয়েছি। দুই ব্যাংকের দুই ক্রেডিট অফিসার। সোনালি মানুষ জনতার সেবক তারা উন্নয়ন আর জনসেবার অগ্রণী সৈনিক। অনেক উঁচু আর দায়িত্বশীল পদ। নিঃস্বার্থ স্বার্থহীন। কথা বলতেই সাফ জানিয়ে দিল, -
‘বাজেট নাই, দু-সপ্তাহ পরে একবার খোঁজ করবেন; আ রে ভাই যাদের দিয়েছি তারা বড় যন্ত্রণা করছে। পালিয়ে বেড়ায়। কালেকশন নাই। কোত্থেকে দেব বলেন?’
‘আমার দ্বারা এমন সমস্যা হবে না।’
‘নেয়ার সময় সকলেই এমন কথা বলে বুঝলেন। মানুষ চরিয়ে খাই, লোক চিনি না বলতে চান?’
‘আমাকেও কি সেই গোত্রে ফেলছেন নাকি দাদা?’
‘সে কথা নয়, বাজেট নাই; আসুক। অনেকে সিরিয়াল ধরে আছে। খরচপাতিও করতে চায় ষোলো আনা।’
‘খরচপাতি মানে?’
‘আ রে ভাই আপনি তো নিয়মকানুন জানেন না দেখছি! এখন মাল ফেলবেন কাজ পাবেন। দেখেন না বিদ্যুতের সমস্যা হলে লোক আসে, ঠিক করে দেয়; তারপর চা খাওয়ার টাকা চায়।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ তাই তো! সে করা যাবে, করতে হবে। নিয়মকানুন আছে না?’
‘টাকা দিয়ে কী করবেন?’
‘এই ধরেন...।’
‘গৃহ সংস্কার। আমার দশ পার্সেন্ট, বুঝেছেন?’
‘একেবারে দশ পার্সেন্ট দাদা! একটু কমে...?’
‘দশই দিতে হবে। ডিড স্ট্যাম্প রেভিনিউ এসব আলাদা। বলেন তো একসপ্তাহের মধ্যেই টাকা...হে হে হে!’
লোকটির হাসি বাতাসে ছড়াতে ছড়াতে দৃষ্টি ঘোলাটে হতে থাকে। তার ভেতর দিয়ে দেখা যায়, কোনো মানুষ নয় একটি শূকর চেয়ারে বসে পা দোলায় আর তার পান খাওয়া ঠোঁটের কশ বেয়ে রক্তের মতো লালা টেবিলময় ছিটকে পড়ছে; না কি সারা দেশ? কি আশ্চর্য স্বাধীনতা!
‘হাতে তো এই মুহূর্তে টাকা নেই দাদা।’
‘টাকা তুলে দেবেন। অ্যাকাউন্ট আছে তো?’
‘হ্যাঁ তা আছে।’
সবখানে পাটাশ। আবুল হাসিম সেদিন শব্দটির মানে বলে, ‘বাইরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট’। এর মানেও তেমন বুঝি না। শেষে রাগ করে উপসংহার টানে।
‘আপনাকে দিয়ে হবে না, আস্ত বুরবাক।’
‘সে আবার কী?’
‘হা হা হা সত্যি হাসালেন মাইরি!’
অবশেষে যা জানা গেল, একেবারে নোংরা। মানুষের মুখ এত কুৎসিত! তারা নোংরা খায়। মুখে বিকট দুর্গন্ধ। দাঁত আর মাঢ়িতে ক্যাভিটি আর পালপাইটিস। তাদের শরীরে পরজীবি আর পচন। মৃত মানুষের দুর্গন্ধ। তাদের নীতিবোধ বিশ্বাস আর সততা মরে গেছে। আর এরজন্য সংক্রামক কিছু তো আছে...লোভ আর ভোগাসক্তি। আমাদের দিনযাপনে দিনভর সে-সবে ঘৃণা থাকলেও নিরুপায় অবশেষে তার কাছে অসহায় সমর্পণ। কেননা তাদের হাতেই ক্ষমতা। কত শতবার থুতু ছিটিয়ে তাদের কাছেই বারবার যেতে হয়। তাই একদল শূকর হামলে পড়ে সবকিছু চেটেপুটে খেয়ে চলে। তাদের কোনো যন্ত্রণা নেই, শুধু দুর্গন্ধ; ছড়িয়ে পড়ে চার-দেয়ালের ভেতর থেকে বাইরে আকাশের গায়ে দিগন্তে দিগন্তে। বাতাসের পরতে পরতে আর মাটির অনু-পরমাণুতে। কষ্টভোগা মানুষের রক্তের মধ্যে জেগে থাকে অসহায় বিবমিষা আর সেটি ছড়িয়ে পড়ে শুধু তার মনের গভীরে। একেবারে কলজের তলায়। উপায় কোথায়
(ক্রমশ)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৯ বিকাল ৪:৪৫