তেরো মাসের শিশু; মায়মুনার মন কিছুতেই সায় দেয় না। সে তো মা। সে কি করে পারবে অমন কাজ? দুধের বাচ্চা, ওকে না দেখে মরে যাবে যে! না না কিছুতেই পারবে না।সিরাজ প্রথমে মাথায় হাত বুলোয়। মিষ্টি করে দুটো কথা বলে। তারপর খুব দ্রুত আর গভীরভাবে বউয়ের গালে চুমু খায়। তির্যক তাকায় শিশুপুত্রের দিকে। দুপুরের ঝাঁজালো রোদ ঝুপড়ির ভেতর কেমন শীতল আর ম্লান হয়ে আছে। সেই আলোতে দেখে, সুলেমান ছোট্ট হাতদুটো দিয়ে মায়মুনাকে জড়িয়ে ধরে আছে। ঠোঁট দিয়ে টেনে নিচ্ছে অমৃতধারা। মায়মুনার ফরসা স্তনের চারপাশ ঘিরে থাকা শিরার নীলচে রেখাগুলো এই জীবন আর বেঁচে থাকার অনন্য এক শিল্প। মা ও শিশুর এই মায়াময় দৃশ্য সিরাজের বুক ঠেলে ভারী দীর্ঘশ্বাস বের করে দেয়। আর উপায় নেই, তাদের বাঁচতে হবে।
সিরাজ বেঁচে থাকার অনেক মূল্য দিয়েছে। অবশেষে একান্ত বাধ্য হয়ে অসহায়ের মতো মায়মুনাকে বলে রুবির মায়ের কথা শুনতে। ছেলেকে তো একেবারে দিয়ে দিতে হচ্ছে না। বিকেলে বা সন্ধেয় ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। আর এই সামান্য কয়েক ঘণ্টার জন্য রুবির মা কুড়ি-পঁচিশ টাকা হাতে দেবে। হতভাগা সংসারে কারও ঠিকমতো খাওয়া জোটে না। একটু তো সুদিন আসবে। সি'তি আসবে। সুলেমানকে সুজি বার্লি কিংবা কৌটার খাবার, কি বলে সেরেলাক কিনে দেবে।
দিন কয়েক আগে থেকেই কথা হচ্ছিল। রুবির মা বসে বসে পান চিবোয়। সিরাজের পেছনে বসেছিল মায়মুনা। সে তাদের সব কথা শুনে রেগে যায়। কি বাচ্চা ভাড়া! কোন্ মায়ে তার বুকের ধন ভাড়া দেয়? রুবির মা, বিগত যৌবন চেহারায় রাজ্যের ছেনালি এনে হি হি করে হেসে উঠে। ঝুপড়ির দেয়াল ঘেঁষে অনাদরে গজিয়ে ওঠা টমেটো গাছের পাতায় পচাৎ করে পানের পিক ফেলে। সবুজ সুন্দর চারাগাছ আপনিই কোনোদিন মুখ উঁচিয়ে সূর্য দেখতে শুরু করেছে কে জানে! তখন আধবুড়ি খ্যাসখ্যাসে গলায় মায়মুনার উদ্দেশ্যে বলে, -
‘ছইল নিয়া কি পালে যাইম বা হে? মোর উবি যদু বাঁচি থাকিল হয়, ওরে বেটাবেটিনি কাজোত গেনু হয়। আর মাগনা তো তোর ছইল নিগাম না...ট্যাকা দিম।’
সিরাজের সবকিছুতে অতি আগ্রহ। সেই ধরে এনেছে বুড়িকে। কোত্থেকে কী খবর কেমন করে যে পায় কে জানে! সে দু-চোখে চকচকে লোভ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, -
‘কত্ ট্যাকা দিবু চাচি?’
‘তা কামাই ভাল্ হইলে বিশ পঁচিশ দিম।’
‘আর যদু তেমন ওজগার না হয়?’
‘ওজগার ক্যান হবি না!’
বুড়ি আচমকা সিরাজের উপর ধমকে উঠে। সিরাজ প্রত্যুত্তরে মিন মিন দু-একটি কী-সব বলে থেমে যায়। বুড়িকে ক্ষ্যাপানো যাবে না। সে মায়মুনার দিকে দৃষ্টি দেয়। তাকে বোঝা যায় না। সিরাজ গতরাতেই আভাস দিয়েছিল। রুবির মা সকালে আসবে। কিন্তু মায়মুনা ভোর থেকে ছেলেকে একেবারে বুকের ভেতর নিয়ে বসে থাকে। ঝুপড়ির ভেতর শুইয়ে রাখে না। সিরাজ আবার ছোট এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয়। মায়ের বুকের ওমে নিরাপদ নিশ্চেন্তে বাচ্চা হয়তো কোনো পরির দেশের স্বপ্ন দেখতে থাকে। সেখানে ক্ষুধা নেই। বেঁচে থাকার যন্ত্রণা নেই। স্বপ্ন দেখে আর ফিক ফিক করে হাসে। সিরাজ আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজেকে তার পাষাণ সীমারের মতো মনে হয়। কিন্তু উপায় কী? তার দিনকাল খুব খারাপ যাচ্ছে। গেল সপ্তাহে ভ্যান টানতে গিয়ে পিঠের পেশিতে টান পড়েছে। নিজের ক্ষতি তো শুধু নয় ভ্যানটাও শেষ। সেটার ফ্রেম কয়েক টুকরোয় ভেঙে পড়ে। ভ্যানের মালিক পৌরসভার কমিশনার, খবর পেয়ে রিকশায় পায়ের উপর পা তুলে দোলাতে দোলাতে ছুটে আসে। এসেই দুর্দান্ত গালাগাল।
‘চুতমারানির বাচ্চা, ওভারলোডিং করছিস ক্যা? এইডা কি লোহার গাড়ি যে তোর মায়ে-বাপে চোদ্দো গুষ্টি রে উঠাবি? শালা বানচোত।’
‘আপনারে তো অনেকবার কইছি মহাজন, অয়ল্ডিং ফেরেম বেশি দিন যাবা ন। দুইটা বস্তা উঠাইতে এই অবস্থা।’
‘শালা পলিয়া ধুর, খালি মুখে-মুখে তক্কো করিস, যা তোরে আর ভ্যান চালাতে হবে না। ভাগ এইখান থিক্যা।’
‘কিছু ট্যাকা দেন অষুধপত্তর কিনিবা নাগবে।’
কমিশনার তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়। হাঁটুর নিচে পেছন দিকে ছড়ে যাওয়া কাটা দাগ। রক্ত চুইয়ে পড়ে জমাট বেঁধেছে। কয়েকটি মাছি রক্তের স্বাদে ভনভন করে। কমিশনারের মন কি ভেবে আদ্র হয়। দশ টাকার নোট এগিয়ে ধরে।
‘মহাজন পঞ্চাশ টাকা দেন, বাড়িত চাইল-ডাইল কিছু নাই।’
‘ভাগ শালা, গাড়ি ভাঙলি আবার টাকা।’
‘দেন মহাজন দেন। পিঠের বেদনাটা সারি গেইলে ফির কাম করি শোধ দেমো।’
‘তোকে আর গাড়ি দেব না। পলিয়া চাষা, পথঘাট বুঝিস না, ট্রাফিক মানিস না। যা আর এই পাঁচ টাকা নিয়া দূর হ।’
সিরাজ মালিকের মন গলাতে পারেনি। ভাঙাচুরা ভ্যানগাড়ি মেরামত কারখানায় পৌঁছে দিয়ে হাসপাতাল যায়। ডাকতারের লিখে দেয়া স্লিপের কয়টা ট্যাবলেট নিতে ওয়ার্ডবয়কে পাঁচ টাকা ঘুষ সাধে। তারপরও দশ টাকা দিতে হয়। সেই অষুধে কাজ হয় না। পিঠের ব্যথায় সুড়সুড়ি লাগে মাত্র। মায়মুনা পয়মন্ত বউ। একটু একটু করে সঞ্চয়ের যে কয়েকটি টাকা হাতে রেখেছিল, ওই দিয়ে আরও ট্যাবলেট কেনে। এক-দেড় কিলো চাল, আড়াই শ মসুর ডাল। পাঁচ টাকা অ্যারারুট বার্লি। জীবন আর বেঁচে থাকায় কত কি লাগে! সব জোগাড় করা যায় না। সেই টাকাও ফুরিয়ে গেল। গত দু-দিন আশেপাশের সক্ষম পরিবারগুলোর কাছে থেকে এটা-ওটা ধার করে লবণে ফুটিয়ে চলছে। এখন কেউ আর কিছু দিতে চায় না। ধারবাকি নেই। পাওয়া যায় না। কেউ মুখের উপর বলে দেয়, আশ্বিন-কার্তিক মাস...মঙ্গার দিনকাল। অনেকের কাজ নেই। কেউ কেউ ষষ্টিতলা অথবা চিরিরবন্দরের ঘুগড়াতলি গিয়ে বসে থাকে। সিরাজও কয়েকদিন হাজির হয়। কাজ করতে পারবে কি না কে জানে, তবু আশায় আশায় সময় গোনে; আশাই জীবন। অথচ কেউ ডাকে না। সে বুঝে ফেলে, যার কিছু নেই, কোনো দাম নেই; জগৎ তেলা মাথায় তেল ঢালার। যারা শূন্য, তারা শূন্য; মূল্যহীন। তাদের জীবন কষ্টের বৃত্তে আবদ্ধ। তারা সেখানেই ঘুরপাক খেতে থাকে।
গত পরশু ভোরবেলা আবার ষষ্টিতলার মোড়ে বসে থাকে। অনেকেই আসে। কারও হাতে টুকরি কোদাল, কেউ দা-কুড়াল নিয়ে অস্থির বসে বা দাঁড়িয়ে থাকে। এদিক-ওদিক হেঁটে বেড়ায়। মানুষের বিষাদ দৃষ্টিতে অচেনা প্রত্যাশার রংধনু খেলা। সবাই মজুর। এই দুনিয়া হুজুর আর মজুরের। ঈশ্বর আর বান্দার। সে হতভাগা একজন। বটগাছের নিচে বিমর্ষ চেহারা শুকনো দৃষ্টি বসে থাকে। তার হাতে দা-কুড়াল-টুকরি-কোদাল কিছু নেই। মাথায় জড়ানো ময়লাটে এক লাল-গামছা পরিচয় বহন করে। সে শ্রমিক। মজুর মানুষ। কাজ জোটে না। একনাগাড়ে বসে থাকায় পিঠের শিরা-পেশি আরও টানটান হয়ে যায়। ব্যথা বাড়ে। সে অসহায়ের মতো এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে, কিছু খুঁজতে খুঁজতে একবার খুব অসহায় কষ্টে ভাবে, ঝুপড়িতে ফিরে যাওয়াই ভালো; একটু শুয়ে থাকতে মন চায়। উপায় কি আছে? সে ওঠে না। অপেক্ষা যদি কোনো কাজ পাওয়া যায়। আশায় আশায় সকাল গড়িয়ে চলে। তারপর আকস্মিক এক পুলিশ এসে ডেকে নেয়। তার বাসায় গিয়ে কচি এক জলপাই গাছ টুকরো টুকরো কাটে। পুলিশের ছেলেমেয়েরা অপরিপুষ্ট জলপাই কুড়োতে কুড়োতে হইচই লাগিয়ে দেয়। সিরাজের মন বড় বিষণ্ন। আহা এত সুন্দর গাছ! সবুজে সবুজে ভরে ছিল। নতুন ফলের অদ্ভুত সুবাস। গাছের প্রতি অনেক দরদ সিরাজের। নিজের বাসাবাড়ি থাকলে অনেক অনেক ফলের গাছ লাগাত। কিন্তু উপায় কি? তার তো কোনো জায়গা-জমি নেই। এত বড় পৃথিবীতে এক-দুই আঙুল জায়গাও না। রেললাইনের ধারে পাথর-সুরকি-আবর্জনার পাশে ছোট ঝুপড়ি তুলেছে। তারই অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে মাটিতে শুয়ে থাকে। মায়মুনা আছে। আদরের বউ। এখন সুলেমান। তার আত্মজ। নিজের জন্য নয়ই, তাদের জন্যও কোনো সুখ-শান্তি এনে দিতে পারে না। এভাবেই সংসার-জীবন আর বেঁচে থাকা...সেভাবেই কোনো একদিন টুপ করে মরে যাওয়া। অর্থহীন আসা-যাওয়া জীবন। সে আর ভাবে না। পুলিশ যেমনভাবে চায়, গাছের টুকরো করে। নির্দেশ অনুসারে সাজিয়ে রাখে। সন্ধেয় যখন মজুরি পায়, এত নগন্য, গাছ নয়, সারাদিন বোধকরি নিজেকে ফালা ফালা করে কেটেছে সে। পুলিশ মানুষ পয়সা নিয়ে কথা আর বাড়াবাড়ি করার ভরসা পায়নি। বলা যায় না, কোনো কেসে ফাঁসিয়ে চালান করে দেবে। এই কারণে তো গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে হলো।
সিরাজ জোর করে হারানো দিন ভুলে যেতে চায়। কী হবে ভেবে? সে ফিরে আসে বাস্তবে। সকাল সোনালি রোদে ঝলমল করে। উজ্জ্বল আলো চারপাশে। তার সকাল হয় না...অন্ধকারে আলো জাগে না। সামনে বুড়ি বসে আছে। শকুনি লোভে চকচকে বড় চোখ এদিক-ওদিক কিছু খোঁজে। পান চিবোয়। চোয়াল হাপরের মতো ওঠে আর নামে। সিরাজের মনে হয়, প্রচণ্ড কালো কোনো গহ্বর গিলে খেতে এগিয়ে আসে...এগিয়ে আসছে। তার দৃষ্টি সেই অন্ধকার বিবরে হারিয়ে যেতে থাকে।
মধ্যরাতে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে সিরাজ। কার্তিকের হিমহিম বাতাস অথচ সে ঘেমে-নেয়ে উঠে। অনেকক্ষণ আচ্ছন্ন-বিমুঢ় জেগে থাকে। সে কি বেঁচে আছে না কি মরে গেছে? মাথা কাজ করে না। অনেকক্ষণপর আকস্মিক সম্বিত ফিরে পায়। অন্ধকার ছায়া ছায়া ফ্যাকাশে আলোয় পাশে তাকায়। মায়মুনা নিথর শুয়ে আছে। ছেঁড়া ব্লাউজের ফাঁকফোকর দিয়ে ফরসা বাহুমূল আর বুক অদমনীয় কামনা জাগায়। অদ্ভুত মায়ার খেলা। মায়মুনা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরেছে ছেলেকে। অষ্টমীর চাঁদ অনধিকারের মতো ঝুপড়ির ফুটো দিয়ে নেমে এসেছে তার চোখে-মুখে। সেই মুখছবি না বলা কত বেদনায় আশ্চর্য বিষাদ-করুণ। আলোছায়ায় জেগে থাকে সুনসান নীরবতা। সিরাজের দুর্ভাবনা-হতাশার কোনো ক্লান্তি নেই। সবসময় তাড়া করে। ঘুমের মধ্যেও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। প্রতিরাতে দুঃস্বপ্ন তাড়িত বারবার ঘুমের মধ্যে চমকে উঠে। তারপর ভয়ংকর জেগে উঠে রাত পাহারা দেয়। তার সামনে-পেছনে অন্ধকার...শুধুই অন্ধকার। তার আর ঘুম আসে না। আজ তার নিবিড় সজল দৃষ্টি আত্মজের উপর ছড়িয়ে যায়। তাকে কোলে তুলে নিতে সাধ জাগে। আহা! যে বুকের ধন আগলে রেখে মানুষ করবে তাকেই কিনা অবলম্বন করতে হচ্ছে । সিরাজ বড় পাষণ্ড। এভাবেই নিজেকে তার করুণা করতে ইচ্ছে হয়। এসব দেখতে দেখতে আচমকা চারিদিক ঝাপসা হয়ে যায়।
পিঠের ব্যথা কমেনি। ওষুধ কেনার টাকা নেই। হাসপাতালের ডাকতার বলেছে, এক্সরে করতে হবে। পেশাব পরীক্ষা করা দরকার। হাড়ে চির ধরেছে কি না? কিডনি সমস্যাতেও পিঠ-কোমর ব্যথা হতে পারে ইত্যাদি। সিরাজ তেমন কিছু বোঝে না। এটুকু শুধু ধরে নেয়, হাসপাতাল হলো শেষ ঠিকানা, ডাকতার মানে টাকা; টাকা খাওয়ার কসাই। হাজারো পরীক্ষা-নিরীক্ষার চিকিৎসা সিরাজের জন্য নয়। তার জীবনের মুল্য কয় পয়সা? অবশেষে ব্যথা কমাবার কয়েকটা ট্যাবলেট খেয়ে দু-দিনে পেট পচিয়ে ফেলে। এখন পিঠ আর পেট দুটোতেই অসহনীয় ব্যথা। তবু তাকে সইতে হয়। হসাপাতাল আর যায় না।
রাতে মায়মুনা খুব মমতায় পিঠ আর কোমরে অনেকক্ষণ পোড়া মবিল মালিশ করে দেয়। এতে সাময়িক আরাম লাগে। কিন্তু আধঘণ্টা যেতে না যেতেই ব্যথা দ্বিগুন বাড়ে। বাড়তে থাকে। ব্যথায় বেঁচে থাকা হয়ে ওঠে প্রচণ্ড ঘৃণার। সে কখনো চিত হয়, কখনো উপুড়, কখনোবা কাত; স্বস্তি বা শান্তি আসে না। তখন মায়মুনার শরীর ঘেঁষে পড়ে থাকে। ঘুমকাতর বউ তার ডানহাত টেনে নিজের বুকের উপর চেপে রাখে। সিরাজ কোনো অলীক কল্পনায় ভেসে যেতে চায়। পারে না।
দুঃস্বপ্নের ছবিগুলো ভেসে আসে। মুখ ব্যাদান ভয়ংকর একেকটা চেহারা...মৃত্যুদূত। সিরাজ নিজের জন্য কোনো ভয় পায় না। সকল অসি'রতা সন্তান আর মায়মুনাকে ঘিরে। বড় অসহায় তারা। বানের জলে কচুরিপানার মতো তার পাশে পাশে ভেসে চলেছে। এই তার অশান্তি...আশঙ্কা। সুখ-শান্তির সঙ্গে সঙ্গে কোনো নিরাপত্তাও নেই। তার মাঝে মৃত্যুদূত! কখনো প্রচণ্ড হাসি পায়। গরিবির চেয়ে ভয়ংকর কষ্ট দ্বিতীয় আর কী? তাকে অন্যকিছু আর কি ভয় দেখায়? দুঃস্বপ্ন? গরিবির বৃত্ত-ফাঁদ-আবদ্ধ জীবনে স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন সব অন্তঃসার।
তার আর ঘুম হয় না। কোনোদিনই আসে না। রাতের কোনো প্রহরে ঘুম ভেঙে গেলে আর জোড়া লাগে না। সে শুয়ে শুয়ে ভাবে, কত ভাবনা, কত কষ্ট, কত সাধ; আর মায়মুনার কথা। সে কি ছেলেকে দেবে? অনেক কষ্ট হবে...তবে পারবে। মেয়েরা সব পারে। তারা এ সমাজ-সংসারে বুকে পাথর বেঁধেও হাসতে জানে। আড়ালে-অন্তরালে শত দুঃখ-বেদনা-চাপাকান্না লুকিয়ে রেখে কী করে যে মায়মুনা হাসে...বাঁচতে শিখেছে, সিরাজ কোনো কিনারা পায় না।
খোলা আকাশের ছায়াপথ আর চারপাশের আলো-অন্ধকার দেয়ালে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবার পেছনে ফিরে যায় সিরাজ। গ্রামের সবুজ দৃশ্যাবলী। সবুজ গাছপালা-বাঁশবাগান-পুকুর আর দূর থেকে জেগে থাকা একলা তালগাছ...বৈকুণ্ঠপুর। তার শৈশব-কৈশোর আর যৌবন শুরুর দিনকাল কেটেছে সেখানে। দিনগুলো কি সুন্দর মায়াময় ছিল! সেখানের কত দৃশ্য, কত ছবি, কত কথা ভাবতে ভাবতে বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে দীর্ঘশ্বাস তৈরি হয়। সুখ-দুঃখের দিনগুলো মনে পড়ে। সেখানেও দুঃখ-শঠতা-অত্যাচার ছিল। এসবের মানচিত্র সবখানেই একরকম। মালিক আর শ্রমিকের সম্পর্কের মতো।
শিকদার মাত্র দু-মণ ধান চুরির অপরাধে থানায় তুলে দিয়েছিল তাকে। বড়লোক মানুষ। সিরাজ কিছুতেই বোঝাতে পারেনি অপরাধ তার নয়। শিকদার বাড়ির বড়ছেলে মোজাম্মেলের হয়ে ধান বিক্রিতে সহায়তা করেছে মাত্র। মোজাম্মেল অস্বীকার করে। সিরাজ হয়ে যায় চোর। থানায় খুব খাতির হয় তার। সেই শিশুকাল থেকে বাপের হাত ধরে শিকদার বাড়ি যাওয়া। তার ছোট্ট হাতে শত শত কাজ, ফাই-ফরমাশ, নরম কচি মনে দিনে দিনে ভৃত্যের শেঁকলে বাঁধা আনুগত্য মজবুত হতে থাকে, আন্তরিক গভীরতা পায়, সে হলো দীর্ঘ এক মহাকাব্য; সেদিন ছাব্বিশ বছরে এসে পুরস্কৃত হয়। তাকে প্রায় উদোম করে নিমগাছে বাঁধা হলে সকালের উজ্জ্বল আলোয় শত শত মানুষের দৃষ্টিতে কৌতূহল জমে উঠে। সার্কাস খেলার বিশেষ আকর্ষণ। শিকদার থানার বারান্দায় হাতলঅলা চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে নাচাতে থাকে। তার দু-চোখে বিকট ভর্ৎসনা...কখনো বীভৎস রাগ খেলা করে। এই লোক বড় বেশি কথা বলে, চাকর মানুষ, মোজাম্মেল ডাইল খায় না কি খায়; এত বড় গলা তোর?
পুলিশের চাবুক চলে। সিরাজের চিৎকার-আর্তনাদ নিমগাছ থানা চত্বর আর দেয়াল পেরিয়ে উন্মুক্ত মাঠে ভেসে যায়। সেখান থেকে তেপান্তরের দিগন্ত রেখা আকাশগঙ্গায়। জীবন রূপকথার মতো জিয়ন-মরণকাঠি নয়। সেখানে শুধু দৈত্য আর রাক্ষস। এখানে কাপুরুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকা হাজার মানুষ তাকিয়ে দেখে। চোর পেটানো চলে। সিরাজের বোধ নেই। কেউ চেতনাহীন কোনো সত্ত্বায় ভেবে যায়, কী অপরাধ তার? সে সত্য বলেছিল। মিথ্যের এই জগতে সত্য বড় বিকট বেমানান। অপরাধ: সে গরিব। তার উপর চাবুক চলে। গরিবের শরীর কেটে ছিটকে গড়িয়ে পড়ে সত্য বলার শাস্তি। রক্ত। নির্বুদ্ধিতার লাল রং। সেই রক্তে কুকুরে জিহ্বা দেয়। সুখ করে চাটে। সিরাজ কী করে? তার দুই হাত উঁচু করে বাঁধা। শিশ্নের ডগায় আধ-ধারা বাটখারা দড়ি বাঁধা ঝোলে। সবকিছু টনটন যন্ত্রণায় অসাড়-অস্তিত্বহীন। কোত্থেকে কয়েকটি নীলমাছি উড়ে উড়ে রক্তের গন্ধে মাতোয়ারা হয়। এদিক-ওদিক অস্থির ভেসে ভেসে বুঝে নেয় রক্তের স্বাদ। জনগণ সার্কাস দেখে। একসময় সবকিছু ঝাপসা অন্ধকার, শুধু অন্ধকার কালো গহ্বর; স্যাঁতসেঁতে কাদামাটি দেয়ালের বিশাল বৃত্ত জেগে থাকে। সে ওই আকারবিহীন বিবরে বন্দি। তারপরও কোনো শকুনমুখি কুকুরের ছায়া, ভয়াল দাঁতাল, মুখ ব্যাদান হাসতে থাকে। সেই ছায়াকাঠামো কখনো কুকুর, কখনো শিকদার অথবা কখনো পুলিশের বলে ভ্রম মনে হয়। এভাবেই সত্যি সত্যি নিকষ অন্ধকার নেমে আসে।
সিরাজ পরদিন অজানা এক ডাকাতির মামলায় সদরে চালান হয়ে যায়। তার ঘরে বিয়ে করা নতুন বউ। সে মায়মুনাকে সাবধান করে দিতে পারে না। বলে যেতে পারে না, 'বউ তুই শিকদারের মিলে যাস না।'
মায়মুনা সাবধানী মেয়ে। সে আর কাজে যায়নি। কেউ কেউ শঠতার পৃথিবীতে ঠেকতে ঠকতে নিজে থেকে সবকিছু শিখে নেয়। মায়মুনা তেমন। সিরাজ যখন থানা চত্বরে আর্তনাদে ভেসে গেছে, মায়মুনা বসে থাকেনি। শহরে গিয়ে ধর্মবাপ উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করে। অবশেষে সিরাজ পনেরো দিন জেল খেটে ছাড়া পায়। মায়মুনাকে তাই কিছু বলতে পারে না সিরাজ। সে তার অর্ধেক জীবন। আদরের বউ। আজ সেই প্রিয় মানুষকে কষ্ট দিতে নিজেরও খুব কষ্ট হয়। অন্য আর কোনো উপায় নেই? নেই। সিরাজ কী করে? দুনিয়াতে ক্ষুধার চেয়ে বড় কষ্ট আর কী আছে? সে অসহায়ের মতো আলোছায়া আকাশে একটু আলো খোঁজে, কোনো সকাল; কিন্তু অন্ধকার। অক্ষমতার কষ্টের চেয়ে আরও ভারী, আরও যন্ত্রণাদায়ক শুধু অন্ধকার।
মায়মুনা আগাম পঁচিশ টাকা পেয়েছে। সেই টাকা এখন সিরাজের হাতে। সে চুপ করে আছে। মায়মুনা বারবার বুড়িকে সতর্ক করে। বাচ্চার মাথায় আঁচল দিয়ে রাখতে হবে, রোদ লাগানো চলবে না, কত কি! একটু আগে দুধ খাইয়েছে। চোখে টেনেছে কাজলরেখা। কপালের কোণায় বড় এক টিপ। বুড়ি বলে, -
‘ন্যাও বা হে, ব্যাটা তোমহার সিনামা দেখিবার যাছে না। যতই সাজে দিবু ততই অসুবিধা। মানুষ আউলা হইলে ভিক্ষা বেশি পাওয়া যায়।’
‘ভিক্ষা তো তুই করিবু চাচি, মোর ব্যাটা নাহায়। রাস্তাঘাটোত্ যাবু, মাইনষের নজর খারাপ; নজর লাগে যদু। দুপহর রোইদের বাও-বাতাস আছে না?’
‘মুইহো ভিক্ষা করিম তোমহার ব্যাটাও করিবে। একজন আঁও কাড়িবে আর একজন...।’
সিরাজুদ্দিন কাছেই বসে আছে। সে এবার চমকে বুড়িকে চোখ টেপে। বেশি কথা বলা যাবে না। ধূর্ত বুড়ি সুর পালটে ফেলে একেবারে।
‘দ্যাও মা, ভাল্ করি সাজে দাও। আহা রে যাদু...!’
‘সাঁঝ লাগিবার আগোতে সুলেমানোক দিয়া যাবু চাচি। দিনকাল ভাল্ নাহায়, কি কয় বলে, বাচ্চা খুবে হারাছে।’
‘মোক তরা অবিশ্বাস করেন বা হে?’
সিরাজ আর কথা বাড়ায় না। এসব কথায় মায়মুনা হঠাৎ বিগড়ে যেতে পারে। সেও বাচ্চাকাচ্চা হারানোর কথা শুনেছে। কেউ বলে নতুন ব্রিজে মানুষের রক্ত দিতে হয়। কেউ বলে ডাকতারেরা মানুষ কেটে কি কি সব নেয়। মানুষ বলতে বাচ্চা, আর বাচ্চা বলতে গরিবের বাচ্চা; যাদের খোঁজখবর নেয়ার মতো দরদি কেউ নেই। সে বুড়িকে চেনে। বেশিদিনের পরিচয় অবশ্য নয়। মানুষ খারাপ না। আর...সে-সকল দুর্বভাবনার ইতি টেনে নেয়। হয়তো জোর করেই।
মায়মুনা ছেলেকে বুড়ির কোলে তুলে দেয়। সিরাজ খুব বড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এ ছাড়া আর কী করে? মায়মুনার মেঘজলভার দৃষ্টি, অব্যক্ত গম্ভীর মুখছবি; সিরাজ একপলক তাকিয়ে চোখ মাটিতে নামিয়ে নেয়। মাটির মতো সহনশীল হতে দুর্মর আকাঙ্ক্ষা। তার ডানহাতে সযত্নে চেপে রাখা তিনটি নোট অসম্ভব ভারী লাগে। সুলেমান তো তারও সন্তান...কলিজার টুকরা। সে পথের দিকে ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে তাকিয়ে থাকে। রেললাইন অনেক দূর পুব-দিগেন্ত মিশে গেছে। কেউ একজন বুকের মধ্যে বিড়বিড় সান্ত্বনা হাতড়ায়। ‘বউ দুইটা দিন, পিঠের ব্যথা সারি গেইলে ফের মুই জোন দিম, রেকশা চালাম, ভ্যান চালাম।’
সিরাজের দৃষ্টি বোবা। মায়মুনার বাঁ-দিকের দুগ্ধভার পুরুষ্ট স্তন ছেঁড়া-বোতাম ব্লাউজের নিচে বেরিয়ে আছে। বৃন্ত বেয়ে বুকে-পেটে নেমে গেছে দুধ। সেখানে অদ্ভুত আলপনা-রেখা। অমৃতধারার কোন্ বিক্ষোভ? সেই একজন বুকের মধ্যে আরও একবার ডুকরে উঠতে চায়। কেঁদে কেঁদে অক্ষম প্রতিবাদ করে, আমি এ জনম চাইনি খোদা... এ জনম চাইনি।
আর ওইদিন থেকে এক ভিক্ষুকের জন্ম হয় এই অদ্ভুত স্বপ্নমাখা আলোকিত পৃথিবীতে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০১৯ বিকাল ৫:২৩