বিয়ের মাত্র তিন সপ্তাহ হয়েছে, ঘরে নতুন বউ; এ সময়ে কেউ পালায়? কি যে ভেতরের ব্যাপার! অজয় কুমার রায় পালাল। পাড়াপড়শির সামনে যত না এক কৌতুক মেশা কৌতূহল তারচেয়ে অপমান জুগিয়ে সে ভেগেছে। তাদের মুখের দিকে তাকাতে একটু লজ্জা হয় বটে, কিন্তু অনুরাধার চোখে? হয় না। সেখানে যে মায়া আর বেদনা খেলা করে তাকান যায় না। যে গর্ভধারিণী মা, ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট বুঝতে পারে। হোক সে পরের বাড়ির মেয়ে, ছেলের বউ। আর নিজের ছেলে অজয় কুমার রায়, তার আদরের কুমার। তাকে নয় দশ মাস পেটে রেখেছিল সেও কিছু বুঝতে দেয়নি। ছেলের পেটে পেটে এত! বউ পছন্দ না হলে আগে বলে দিতে পারতি। শুধু বলে, এখন বিয়ে করব না মা।
জয়িতা বেশ এলোমেলো ভাবনায় পড়ে যায়। ‘আ রে বাবা বয়স তো কম হলো না! দিনে দিনে সাতাশ বছর। কুমারের বিয়ের বয়স কি হয়নি’? জয়িতা নিজের কথা ভাবে। তার যখন বিয়ে হয়, স্বামী মানুষটির বয়স আঠারো। তখন তার বয়স কত? তেরো চোদ্দো। সে-সময় একটু অল্প বয়সে ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়। জয়িতার বিয়ের বছর-দেড় বছর ঘুরে আসতে না আসতে ঘরে টোয়া টোয়া শব্দে জানান, নতুন মানুষ এসেছে। কুমারের জন্ম। তারপর দু-আড়াই বছর পর পর আরও তিন জন। একজন আঁতুর ঘরে মরেছে, অন্যজন চার বছর পেরোয়নি, পুকুরে খেলো। শেষজনের পর বারো-চোদ্দো বছর যেতে না যেতে, ধরতে গেলে জয়িতা অল্প বয়সেই বুড়ি হয়ে গেল। কেটে গেল আরও দীর্ঘ সময়কাল। তা হোক এখন কি তার দিন আছে? খুব শখ করে কুমারের বিয়ে দেয়া। এদিকে-ওদিকে কত মেয়ে দেখা হলো। জাত মেলে তো চেহারা মেলে না। মুখ পছন্দ হয় তো স্বাস্থ্য খটখটা কাঠ। কত শত নানান বাধা। অবশেষে অনেক ঘেটেঘুটে তবে অনুরাধাকে পেয়েছে। যেমন স্বাস্থ্য তেমন চেহারা। সক্ষম কর্মঠ। গৃহস্থ বাড়ির বউ একটু শক্ত সামর্থ না হলে চলে না। তাছাড়া পণ হিসেবে যে অংক পাওয়া যাবে তা কুমারের একটি দোকান দিতে অনেক। দরকার পড়লে তিন বিঘের এক বিঘে জমি বেচে দেবে। আর এক বিঘে নমিতার বিয়েতে। মেয়েরও তো বিয়ের বয়স হয়ে এসেছে। তারপর সবার ইচ্ছে, আগে কুমারের হোক। তারপর দেখা যাবে। বিয়ের কাজ অনেক ঝামেলার। সব প্রজাপতি ঋষির ইচ্ছে আর দয়া। বিয়ে হলো। মনে হয়, ছেলে একটু রাগ করেই মত দিয়েছে। জয়িতা আগে বার বার বলল, -
‘হ্যারে কুমার তোর বিয়ে, একবার পাত্রীকে দেখবি না। কানা খোঁড়া নাকি খেঁদি বুচি, ঘুমে নাক ডাকে কি না? দেখতে হয় বাপ। সারা জীবনের প্রশ্ন।’
‘বিয়ে তো আমার হচ্ছে না। বিয়ে হচ্ছে ওই মেয়েটির। আমি কতবার করে বলছি, একটু গুছিয়ে নিই। তা তোমরা তো শুনছই না। নিয়ে আসো তোমাদের পছন্দের মানুষ।’
জয়িতা একটু আহত হয়। আজ ছেলে কয়েকবছর ধরে শহরে থাকে। সে শহর আর কত দূর? বাসে উঠে বসলে আধ ঘন্টার পথ। দিব্যি বাড়িতে এসে থাকা যায়। ঘরের ছেলে ঘরে থাকলে মায়ের মনে কত শান্তি! অথচ এই পথটুকু মাড়িয়ে মায়ের কাছে আসা যায় না। শহরের মেসে থাকে। চারুবাবুর মোড়ে ওষুধের দোকান। সেখানে কাজ করে। কাজ ঠিক নয়, কাজ শিখছে। ড্রাগের ব্যবসা, কপাল খুলে গুটি লাল হতে বেশি দিন লাগে না। কুমারের উক্তি। কাজ শিখে যদি নিজের দোকান হয় তাহলে সকলে নিশ্চিন্ত। একটি সুখের ঘর বসে। নীলরঞ্জন বাবু শেষে জয়িতার ইচ্ছে পূরণে উঠে পড়ে লাগলেন। বিয়ে হয়ে গেল। অজয় কুমার বেশ শান্তশিষ্ট নির্বোধ লাজুক পাত্রের মতো প্রজাপতি ঋষির সকল আয়োজনে কোনো গোলমাল করল না। সবকিছু ভালোয় ভালোয় হয়েছে। দুজনকে মানিয়েছে বেশ। একেবারে ভাইবোনের মতো। ঠিক রাধাকৃষ্ণ। এবার মনের কোণায় কত শান্তি! সে মনে মনে ব্রহ্মাকে বড় এক কৃতজ্ঞতা জানায়। অথচ দু সপ্তাহ পেরোয় নি, কেউ কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে চলে যায়? নতুন বউ ফেলে পালায়?
জয়িতার মুখচোখ শুকনো। কী করবে কিছু ঠিক করতে পারছে না। একবার নমিতার কাছে অন্যবার অনুরাধার কাছে গিয়ে বসে থাকে। আর নীলরঞ্জন যখন ফিরে আসেন খুব ব্যগ্র হয়ে এগিয়ে যায়। নতুন কোনো খবর শুনতে মন আনচান করে।
‘কুমারের কোনো খবর পাওয়া গেল?’
‘পাওয়া যাবে, এত অধৈর্য হয়ো না তো!’
স্বামীর শুকনো মুখ দেখে তার চোখের সামনে অমন সুন্দর উজ্জ্বল বিকেল ম্লান হয়ে যায়। আর একজন আছে। সে হলো নিমাই। দুঃসম্পর্কের দাদা। ভাগিনার নানান খবরের সঙ্গী। কুমারের পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কেও কথা বলেছে। ছেলে শহরের যে দোকানে কাজ করে তার দু একটি দোকানের আগে তার দোকান। সেও সেলস্ম্যান। মাঝে-মধ্যে ঘটকালি করে। বংশ জাত কূল মিলিয়ে প্রজাপতির পাখনায় রঙ ছড়িয়ে দেয়। অনেকের জীবন তো সুন্দর রাঙিয়ে দিল। কুমারের জোড়া মিলিয়ে দেয়াও তার। কিন্তু এখানে যে কোনোকিছু রঙিণ হলো না। কোথায় কোন্ খটকা কে জানে! তাকে খবর দেয়া হয়েছে। রাতে এলে জানা যাবে, ছেলে শহরে চলে গেছে কি না। নাকি অন্যকোথাও? সেটি হলেই বিপদ।
জয়িতা বিয়ের ক দিন পর থেকে লক্ষ্য করছিল, কোথায় যেন একটু খাপছাড়া লাগছে। বোধহয় ভুলই হলো। পরে স্বামীকে মুখ খুলে বলে ফেলল বুকের সকল জিজ্ঞাসা।
‘কই কুমার তো একটু সময়ও বউয়ের কাছে বসে না। নতুন বউ পেলে পুরুষ মানুষ ঘর থেকে বেরোয় না। তোমার ছেলে বাজারে গিয়ে বসে থাকে। কেমন অদ্ভুত লাগছে না?’
‘শোনো যত বড় বেহায়া পুরুষ হোক, বিয়ের পর তাকে একটু ভ্যাবলাই দেখায়। আর তোমার ছেলে তো লাজুক লাট্টু। দেখ দু এক মাস পর ঠিক হয়ে যাবে।’
‘হলেই ভালো। তোমার ছেলে। তুমিও কম ছিলে না।’
‘আমি তো প্রথম রাতে একগ্রাসে তোমাকে গিলে খেয়েছি। কী বলো ঠিক কি না?’
‘নাহ্ তুমি বড় যাচ্ছে তাই।’
নীলরঞ্জন ফ্যাস ফ্যাস শব্দে পেট কাঁপিয়ে হাসলেন। খুব আবেগে স্ত্রীর পিঠে হাত রেখে সোহাগ করলেন। জয়িতা আবেশে ক মুহূর্ত চুপ করে থেকে উঠে গেল। বাইরের আঙিনায় ধান শুকোচ্ছে। ছাগল গরুতে মুখ দিলে বিশ্রী ব্যাপার।
অনুরাধা বসে আছে। সিঁথিতে উজ্জ্বল দুপুরের মতো জ্বলজ্বল করছে সিঁদুর। সামান্য সাজ করেছে। বারান্দার উত্তরে একটি লম্বা চোকি ফেলে রাখা। তার উপর সকল আহার করা হয়। গ্রীষ্মের রাতে কেউ ঘুমোয়। জয়িতা দেখে ছেলে বউয়ের মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। ঘন্টাখানেক আগে জিজ্ঞেস করেছিল। কুমার কিছু বলে গেছে কি না? দুজনের মধ্যে কোনো কথা কাটাকাটি? কত কিছুতো হতে পারে। না তেমন কোনো সদুত্তর পায়নি। তখন নমিতা কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। সে মুচকি মুচকি হাসে। বলে, -
‘দাদা বউদির জন্য নীলপদ্ম আসতে গেছে। নাকি গো পরের বেটি?’
‘বেশি ফাজলামো করিস না নমিতা। ছেলে আমার কোন কারণে কোথায় চলে গেছে খুঁজে দেখবে, তা না কাব্য করা হচ্ছে! শেষে বিবাগী হলে কি নিয়ে থাকব?’
‘ছেলে তোমার বেশি দূর যায়নি গো মা। পুরুতের দৌড় ওই মন্দির পর্যন্ত।’
‘তিন দিন হয়ে গেল, এখনো নেই। শহরের দোকানে নেই। তোর মামা বাড়িতেও যায় নি। গেল কোথায়?’
জয়িতা দুচোখ সরু করে অনুরাধার দিকে দৃষ্টি ফেলে। সেখানে কোনোকিছু খোঁজে। নিজেদের মধ্যে কিছু হয়েছে কি না। একজন নারী আর একজন পুরুষের মধ্যে যে সম্পর্ক তা ওরা ছাড়া কে বলতে পারে? তার মনে সন্দেহ গুনগুন করতে লাগল। মনে হয়, কিছু হয়েছে। ছেলের বউ পছন্দ হয়নি। অথবা...নাকি ছেলের বিয়ে দেয়া ঠিক হলো না। তার মাথা গুলিয়ে উঠে। দেখা যাক নিমাই আসলে কিছু জানা যেতে পারে।
বিয়ের মাত্র তিনটি দিন পেরিয়েছে। অজয় কুমার রায় যে ক্লান্ত তা শরীর থেকে দূর হয়নি। ঘুমও হচ্ছে না। এতদিন নিজের ঘরে একটি বড় খাটে কত আরামে ঘুমিয়েছে। সেখানে অন্য একজন শোবে। তার সকছিুতে বসিয়েছে ভাগ। বড় অংশীদার। মনে হচ্ছে, এতদিন নিজের বলে জমানো সাজানো সকল জিনিসে তার পছন্দ-অপছন্দ নিজস্বতা নেই। তার মালিকানা নেই। কেউ একজন দখল করে নিয়েছে। তা নিক, একটু যে ঘুমায় সেখানেও ব্যাঘাত। সে খাটের বাঁ ধারে শুয়ে তির্যকদৃষ্টিতে সামনে তাকায়। কড়িকাঠের সঙ্গে হাল্কা সবুজ একটি বাল্ব জ্বলছে। পাঁচ ওয়াট। ঘরময় আলোছায়ার মায়া। অনুরাধা টেবিলের ওখানে বসে আছে। সে খুব ধীরে চুলের বেণী খুলে আটপৌরে খোঁপা করল। হাতের চুড়ি বের করে টেবিলের একপাশে সাজায়। এসবের মধ্যে তার দিকে একমুহূর্ত নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল। তারপর দাঁড়িয়ে শাড়ি খুলে ফেলল। পরনে ব্লাউজ আর পেটিকোট। ব্লাউজ বেশ ঢোলা মনে হয়। চেয়ারের উপর ম্যাকসি। ওটাতে হাত দিতে গিয়ে কি ভেবে থেমে আবার তার দিকে তাকাল। কুমার চুপ করে দেখছে। মনে হচ্ছে কোনো এক তামাশা। অনুরাধার চেহারায় কোনো ভাবান্তর নেই। কেমন রহস্যময়। তবুও সেখানে এক কৌতুক আছে বলে মনে হয়। এই মেয়েটি তার বউ। উজ্জ্বল ধবধবে ফর্শা। একটু ভারী শরীর। হাসলে গালে টোল পড়ে। নিজের হাতে প্লাগ করা ভুরুর নিচে বড়বড় দুটি ঝিনুক চোখ। এতকিছুর পরও সে একটি মেয়েমানুষ। এদেরকে তার ভালো লাগে না। কেমন থলথলে মনে হয়। বিদঘুটে! সে আরও কিছু ভাবছিল, চুড়ির রিনিঝিনি শব্দে সচকিত হয়। দেখে তার সামনে এক অনাবি®কৃত পৃথিবী। অনুরাধার উপরের অংশ একেবারে উদোম। ঘরের হাল্কা আলোয় স্তনের দুটো খয়েরি বোটা চোখের মতো চেয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে শিহরে উঠল সে। খুব দ্রুত পাশ ফিরে গেল।
এরপর কিছুক্ষণ খস খস শব্দ। মনে হলো কেউ একজন পাশের বালিশে মাথা রেখেছে। খুব কাছে। সেখানে এক গভীর নিঃশ্বাস। একটু অস্থিরতা। তার বউ। একজন মেয়েমানুষ। মানুষটি ইচ্ছে করে তার পিঠে হাত রাখে। গভীর স্পর্শ। তারপর মেয়েটি বলে বসে, -
‘একটা কথা বলব?’
‘কী?’
‘আমাকে তোমার পছন্দ হয়নি না?’
‘এ কথা কেন?’
‘না এমনি মনে হলো।’
‘ও।’
‘তুমি নাকি বিয়ে করতে চাওনি? পালিয়ে গিয়েছিলে?’
‘কে বলেছে তোমাকে?...নমিতা?’
‘না কেউ বলছিল শুনলাম।’
‘ও।’
‘এদিকে একটু মুখ ঘোরাবে? একটি কথা বলব।’
‘শুনছি বলে ফেল।’
‘এদিকে একটু তাকাও না বাবা, একটি কথা বলব।’
অগত্যা কুমার পাশ ফেরে। লাল রঙের জমিনে সাদা আর হলুদ ফুলের প্রিন্ট ম্যাকসি পরেছে অনুরাধা। এই মেয়েটি তার স্ত্রী। একে নিয়ে সারা জীবন কাটাতে হবে। উহ কী সাংঘাতিক! আপাতত একে বউ নয়, একজন অপরিচিত মানুষ ভাবা যাক। সে দেখে একটি মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাতের আলো-আঁধারে চকচক করছে তার মুখ। দুচোখে উদগ্র জিজ্ঞাসা। সে ওই দুচোখে তাকিয়ে থেকে অপেক্ষা করে। অনুরাধা তার ডান হাতটি নিজের বুকের দিকে টেনে টেয়। সেখানের স্পর্শে শিহরে উঠে সে। তার আবার মনে হয়, পাশের জন একজন স্ত্রী-লোক। তার জীবনসঙ্গী।
‘বলো কী বলবে?’
‘তুমি বিয়ে করেছ কেন?’
এই প্রশ্নের মুখোমুখি কোনো পুরুষ হয় কি না তা কুমারের জানা নেই। সে হাতেপায়ে চমকে উঠল। অনুরাধা এ প্রশ্ন কেন করেছে? কী জবাব তার আছে? কোনো জবাব নেই। সে চুপ করে থাকে। দুচোখ বুজে সবকিছু এড়িয়ে যেতে চায়। একটু ঘুম দরকার।
অনুরাধা খুব ব্যাগ্রভাবে তাকায়। তখন বাইরে কদম গাছের কোনো এক ডালে একটি পেঁচা ডেকে উঠছে, হুউম হুউম। এই ডাকটি তার পরিচিত হয়ে গেছে দ্বিতীয় দিনেই। নমিতাকে জিজ্ঞেস করেছিল। সে জানায়, রোজ রাতে একটি পেঁচা তাদের বাড়ির উত্তরে কদম গাছের ডালে বসে। লক্ষ্মী পেঁচা। অনেকক্ষণ ডেকে চলে যায়। আজও একটুপর চলে যাবে। সে তার প্রশ্নের কোনো উত্তর পায় না।
‘তুমি কারও সাথে প্রেম করতে? ওকে বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল?’
‘এই প্রশ্ন করা কি ঠিক হচ্ছে? তুমি বলো তো কেন বিয়েতে বসেছ?’
‘আমি মেয়েমানুষ...বাবামার বোঝা। বিয়ে দিয়েছে। তারা হাল্কা হয়েছে। কিন্তু তোমার বিয়ে করার উদ্দেশ্য কী?’
‘মা বাবাকে খুশি করা।’
‘তার মানে আমাকে তোমার পছন্দ হয়নি।’
‘আমি এসব ভাবছি না।’
‘কিন্তু আমি ভাবছি। তুমি আমাকে একটু ছুঁয়ে দেখলে না।’
অজয় কুমার খুব আবেগে স্ত্রীর বাঁ কাঁধ আর হাতের উপর নিজের ডান হাতটি রাখল। মেয়েদের শরীর এত নরম আর মোলায়েম! বেকারির পাউরুটির মতো তুলতুলে। একটু গরম ভাঁপ রয়েছে।
‘কই জবাব দিলে না?’
‘কী?’
‘তুমি বিয়ে করেছ কেন?’
‘জানি না।’
‘গাধা!’
ওইদিন থেকে অজয় কুমার গাধাই থেকে গেল। এরপর অনুরাধা তার ঠোঁটে-গালে চপ-চপ করে চুমু দেয়। কুমারের মনে কেমন এক ঘিনঘিনে ভাব জেগে উঠে। কেমন মেয়ে, তার সারা মুখে থুতু লাগিয়ে দিয়েছে! অনুরাধার কোনো যায় আসে না। সে দ্রুত ম্যাকসি খোলে। তারপর অজয়ের বুকের উপর চড়ে বসে। তার হাতদুটো চঞ্চল হয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করে। কুমারের করার কিছু নেই। সে চুপ করে দেখে থাকে। কিছু বলে না। কিছু করে না। অনুরাধা শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে নিচে নেমে যায়। বলে, -
‘তোমার সমস্যা, বলো নাই তো! তুমি বিয়ে করলে কেন? না কি ভাণ করছ?’
‘জানি না।’
অনুরাধা জানে কুমার কেন চলে গেছে। নাকি পালিয়ে গেছে! কিন্তু সে কথা কেমন করে বলবে? তা কি বলা যায়? সে ভেতরে ভেতরে খুব স্বার্থপরের মতো গুমরে মরতে থাকে।
অনুরাধা আরও দেড় সপ্তাহ শ্বশুর বাড়ি থাকল। বাবা-মা’র কাছে খবর গেছে। এসব খবর বিষ্ঠার গন্ধের মতো বাতাসে ছড়িয়ে যায়। ছড়ানোর লোক আছে। সে ভাবছিল বাবা আসবে। জামাই হঠাৎ চলে গেছে তা জানতে নিশ্চয় বাবা-মা’র কৌতূহল হবে। সেটি ঘটনার জন্য যতটুকু, তারচেয়ে মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনা। একটু দায়িত্ব বা অধিকার বলে কথা। একান্ত হলেও হাল্কা যে গুজব বা কানকথা তার সত্যতা জানারও একটি বিষয় আছে। মেয়ের জীবন। কিন্তু নতুন বেহাইর বাড়ি যেতে আড়ষ্ট হয়ে গেছে তারা। আজকালকার ছেলেমেয়েদের ব্যাপার। কুমার হয়তো ফিরে আসবে। অথচ দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেল, সে আর ফিরে এলো না।
সেদিন সন্ধেয় নিমাই আসে। হাসিখুশি আর খুব অস্থির চঞ্চল মানুষ। অনুরাধা আগে দেখেছে। বিয়ের সময় বেশ হইহুল্লোড় করেছিল। সে লোকটিও কেমন নিশ্চুপ। শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে কি কি সব আলোচনা হলো। দরজা ভেজানো। সে তেমন কান দিতে পারে নি। কদম গাছের নিচে সন্ধ্যের ছায়া। সেখানে দাঁড়িয়ে নমিতার সঙ্গে বসে গল্প করে। এই ননদটি বেশ বন্ধুর মতো। একটু ফাজিলও...আজেবাজে কথা বলে। দাদা কতক্ষণ ধরে চুমু খেয়েছিল। দম বন্ধ হয়ে আসছিল কি না। তারপর কেমন ভালবাসল। লাজুক ছেলেরা নাকি বড্ড...। শেষে সে বলে বসে, -
‘দাদা সম্পর্কে এসব বলতে খারাব লাগছে না?’
‘ওমা আমি কী বললাম! দাদা তোমাকে কেমন ভালবাসে তাই বলেছি।’
‘এমন ভালবাসে যে বউ ফেলে চলে যায়। নমিতা তুমি সত্যি করে বলতো, তোমার দাদা অন্য কাউকে বিয়ে করতে চেয়েছে কি না?’
‘আরে দূর! যে ছেলে মেয়ে দেখলে কুকড়ে থাকে, অমন মানুষের কোনো প্রেম হয়? তুমি খামোখা এসব ভাবছ। দায়িত্ববান মানুষ, তোমার বোঝা কাঁধে এসেছে তো নিশ্চয়ই কোনো বড় কাজের ধান্ধায় আছে। আমাদের অবাক করে দেবে।’
‘সে ফিরে এলেই ভালো।’
‘বাব্বা...এই কদিনেই!’
অনুরাধা এসব কথা বলতে বলতে দেখে নিমাই এসেছে। ঘরে গিয়ে গল্প করছে। একবার ইচ্ছে হয়, গিয়ে শোনে, কুমারের কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে কি না। পরে আর যেতে পারে নি। সেখানে যাওয়া যদি অযাচিত হয়ে যায়। আলোচনা কি হলো কে জানে। ঘোষনা হলো নতুন বউ কয়েকটি দিন বাপের বাড়ি ঘুরে আসুক। অবশেষে পরদিন অনুরাধা অপূর্ণ সাধ বুকে চেপে ফিরে চলে বাপের বাড়ি। টেম্পুতে ওঠার সময় নিতাই কিছু কথা বলে। তার দিকে তাকিয়ে করুণা করতে ইচ্ছে হয় অনুরাধার। মনে হয় তার নয়, লোকটির কপাল পুড়েছে। নিতাই বলে, -
‘এদিকে ওদিকে কিছু খোঁজ করা গেছে বউমা, কোথাও নেই; তবে যাবে কোথায়! ঘরকা মুর্গি ঘরেই ফিরে আসবে। তুমি নাহয় কিছুদিন বাবার বাড়ি বেরিয়ে আসো। আমি ঢাকায় ওর কয়েকটা ঠিকানা আছে খুঁজে আসি।’
‘আচ্ছা!’
‘বউমা তুমি কিছু ভেবনা, আমি সপ্তাহখানেকের মধ্যে ওকে খুঁজে বের করব।’
অনুরাধা আর কী বলবে? সে চুপ করে ভেতরে গিয়ে বসল। এই আড়ালটুকু খুব দরকার ছিল। নিমাই সুতীক্ষè দৃষ্টিতে তার বুকের কথাগুলো পড়তে শুরু করেছে। টেম্পু চলতে শুরু করে, তার ভেতর সহস্র ভাবনার জাল ছড়িয়ে যায়। কুমারকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। ছায়াছবির নায়কের মতো সুন্দর চেহারা। কথাবার্তা এত মধুর। পোশাক আশাকে কে বলবে বেশি দূর শিক্ষিত নয়। তা অত শিক্ষা নিয়ে কী হবে! পণ হিসেবে বাবা এক লাখ টাকা দিয়েছে। জামাই দোকান দেবে। সেই দোকান বসবে বাজারের কোনো এক কোণায়। একটি অষুধের দোকান মানে অনেক টাকা। দোকান ধীরে ধীরে অনেক বড় হবে। কুমার প্রতিদিন সকালে দোকানে যাবে। সে তার জন্য খুব যত্ন করে ভাত-তরকারি রান্না করবে। ভালবাসায় ভরিয়ে দেবে তার মন। একদিন ছেলের মা হবে। তাকে বড় করবে। স্বামী আর সন্তান নিয়ে সুন্দর সুখী জীবন। এ ছাড়া তার কোনো ভাবনা নেই...স্বপ্ন নেই। অথচ সব কেমন গুলিয়ে গেল। এসব ভাবতে ভাবতে তার দৃষ্টি বাজার দোকানপাট সবুজ ক্ষেত ছেড়ে বিরাণ পাথারে এসে পড়ে। তাকিয়ে দেখে যে বাড়ি ছেড়ে একদিন চলে গিয়েছিল, তখন সবকিছু কেমন বিষণ্ন হয়ে যায়, তার আগমনে সে খুশি হতে পারে না। মা শুকনো মুখে এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে।
(ক্রমশ)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৮ সকাল ৮:১৬