রাস্তায় এক বৃদ্ধের সাথে এক যুবকের দেখা। যুবক আগ বাড়িয়ে গিয়ে সম্বোধন করে জিজ্ঞাসা করলেন, 'স্যার! আমায় চিনতে পেরেছেন?'
___'নাহ্!' উত্তরে ভালো করে খানিকটা দেখে নিয়ে হাল ছেড়ে দেবার মতো করে বললেন। 'তোমাকে ঠিক চিনতে পারলাম না তো বাবা।' স্বরের মধ্যে আগন্তুকের পরিচয় জানার কৌতূহল।
__'আমি একসময় আপনার ছাত্র ছিলাম, স্যার!'
___'ও আচ্ছা!' কুশলাদি ইত্যাদি জানার পর জিজ্ঞাসা করলেন '...এখন তুমি কি করছো?'
যুবক বিনয়ের সাথে জানালো যে সে একজন শিক্ষক। বর্তমানে শিক্ষকতা করছে।
সাবেক ছাত্রের মুখ থেকে এই কথা শুনে বৃদ্ধ শিক্ষক অত্যন্ত খুশি হয়ে বললেন 'আহা, খুবই ভালো, আমারই মতো হয়েছো তাহলে?'
___'হ্যাঁ ঠিকই স্যার! আপনারই মতো। আসলে আমি আপনার মত একজন শিক্ষক হতে পেরেছি বলে নিজেকে ধন্য মনে করছি। আর সরকার এর পেছনের অনুপ্রেরণা আপনি।
___'আমি! কিভাবে?' বৃদ্ধ শিক্ষক কিছুটা কৌতূহলী দৃষ্টিতে যুবকের কাছে শিক্ষক জানতে চাইলো।
___'আপনার মনে আছে কিনা জানিনা স্যার, একদিন আমার এক সহপাঠি… সে একটি নতুন ঘড়ি নিয়ে ক্লাসে এসেছিল। তার ঘাড়িটি এতটাই সুন্দর ছিল যে আমি লোভ সামলাতে পারিনি। ঘড়িটি আমার চাই। অতঃপর তার পকেট থেকে ঘড়িটি আমি চুরি করি।
কিছুক্ষণ পর আমার সেই বন্ধুটি তার ঘড়িটা খুঁজে না পেয়ে আপনার কাছে অভিযোগ করে। আপনি তখন ক্লাসের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আজ ক্লাস চলাকালীন সময়ে এই ছাত্রের ঘড়িটি চুরি হয়েছে। যে চুরি করেছো, দয়া করে ঘাড়িটি ফিরিয়ে দাও।
কিন্তু আপনার বার্তা শুনেও আমি ঘাড়িটি ফেরত দেইনি কারণ ওটা আমার কাছে খুব লোভনীয় ছিল। তারপর দরজা বন্ধ করে আপনি সবাইকে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ক্লাসরুমের ফ্লোরের মধ্যে একটি গোলাকার বৃত্ত তৈরি করতে এবং সবাইকে চোখ বন্ধ করতে বলেছিলেন। এরপর ঘড়ি না পাওয়া পর্যন্ত আপনি এক এক করে আমাদের সবার পকেটে খুঁজতে লাগলেন।
আমরা সবাই আপনার নির্দেশ মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।
আপনি এক এক করে সবার পকেট চেক করে একটা সময় যখন আমার পকেটে হাত দিয়ে ঘড়িটি খুঁজে পেলেন তখন ভয়ে আমার সমস্ত শরীর কাঁপছিল। কিন্তুু সেই মুহূর্তে ঘাড়িটি আমার পকেটে পাবার পরও আপনি কিছু বলেননি। ওটা নিয়ে শেষ-ছাত্রটি পর্যন্ত সবার পকেট চেক করছিলেন। সবশেষে আপনি সবাইকে বলেছিলেন, 'ঘড়ি পাওয়া গেছে। এবার তোমরা সবাই চোখ খুলতে পারো।'
ঘড়িটি পাবার পর আমার সেই বন্ধুটি আপনার কাছে জানতে চেয়েছিল ঘড়িটি কার পকেটে পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তুু আপনি তাকে বলেছিলেন, 'ঘড়িটি কার পকেটে পাওয়া গেছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। তোমার ঘড়ি পাওয়া গেছে সেটিই আসল গুরুত্বপূর্ণ।'"
যুবক এক নাগাড়ে বলে চলল আর বৃদ্ধ শুধু শুনছে। কিছুক্ষণ থেমে সে আবার শুরু করলো।
____'সেই দিনের ঘটনা নিয়ে পরবর্তীতে আপনি আমার সাথে কোনো কথা বলেননি। এমনকি সে কাজের জন্য আমাকে তিরস্কারও করেননি। নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমাকে স্কুলের কোনো কামরায়ও নিয়ে যাননি। সেই ঘটনা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে লজ্জাজনক। অথচ আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে, কৌশলে চুরি হওয়া ঘড়িটি উদ্ধার করলেন এবং আমার মর্যাদা চিরতরে রক্ষা করলেন।'
সে ঘটনার পর আমি অনেকদিন অনুশোচনায় ভুগেছি। ক্লাসে ঘটে যাওয়া ঘটনার রেশ একদিন চলে গেলেও ওই ঘটনার প্রভাব রয়ে যায় মনের মধ্যে। বিবেকের আগুনে নিত্য পুড়েছি। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম, একজন ভালো মানুষ হবো। একজন শিক্ষক হবো। সত্যিকার অর্থে মানুষ গড়ার কারিগর হবো। আপনার কাছ থেকে সে দিন আমি স্পষ্টভাবে বার্তা পেয়েছিলাম কি ধরণের একজন শিক্ষাবিদ হওয়া উচিত। অপমান বা শাস্তি ছাড়াও মানুষকে কিভাবে সংশোধন করা যায়, সেটি আপনার কাছ থেকে শিখেছি। আপনার উদারতা এবং মহানুভবতা আজ আমাকে শিক্ষকের মর্যাদায় আসীন করেছে।'
সাবেক ছাত্রের কথাগুলো শুনে বৃদ্ধ শিক্ষক বললেন, 'হ্যাঁ, সেই ঘটনা আমার মনে আছে। চুরি হওয়া ঘড়ি আমি সবার পকেটে খুঁজেছিলাম। কিন্তুু আমি তোমাকে মনে রাখিনি, কারণ সে সময় আমার চোখও বন্ধ ছিল। তাই তো তোমাদের বৃত্তাকারে সাজিয়েছিলাম।
(সংগৃহীত এবং সংশোধিত।)
সদাচরণের মতো ভালো ওষুধ আর নেই।
[Some read to reply, some to understand.]
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০২৪ ভোর ৫:৫৮