somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বোকাবাক্সতে বন্দী জীবন

০২ রা জুলাই, ২০২৪ রাত ১০:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



হইচই'তে নতুন একটি সিরিজ এসেছে। বোকাবাক্সতে বন্দি। সচরাচর পর্দায় আমাদেরকে যেসব মানুষ তাদের সুনিপুণ অভিনয় দিয়ে বিনোদন দেন, তাদের পর্দার পেছনের জীবনটা কেমন হতে পারে তারই একটি সম্ভাব্য চিত্র এ সিরিজে ফুটে উঠেছে। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, যে তৈরি করা গল্প থেকে আমরা বিনোদন নেই, সেই একই গল্প কি এর অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরও সমান বিনোদন দেয়? নাকি তাদের ক্ষেত্রে এর প্রভাবটা হয় একটু অন্যরকম? সিরিজের স্টোরিলাইনটা সংক্ষেপে বলা যেতে পারে অনেকটা এরকম- অপলা নামের একজন অভিনেত্রী অবুঝ বয়স থেকে মায়ের উৎসাহে অভিনয় করে এসেছে বিভিন্ন নাটক-সিরিয়ালে। কিন্তু অভিনয়টাকে সে মন থেকে কখনোই গ্রহণ করতে পারেনি। এক প্রকার মায়ের কড়া আদেশেই এ জীবনকে বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয়েছে তার। এরপরে যখন দীর্ঘদিন একটি মেগা সিরিয়ালের কেন্দ্রীয় চরিত্রে সে অভিনয় করতে থাকে, তখন সে সিদ্ধান্ত নেয় অভিনয় ছেড়ে দিয়ে সে একজন আদর্শ গৃহিণী এবং মা হয়ে উঠবে। কিন্তু নানা পারিপার্শ্বিক কারণ, যেমন চ্যানেল এবং দর্শকের তীব্র দাবিতে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক মারপ্যাঁচে পড়ে সে আসলে কাজটা ছাড়তে পারে না। আর এখানেই শুরু হয় সিরিজের আসল গল্প। অভিনেত্রী অপলা আর সিরিয়ালের চরিত্র সন্ধ্যামণি- দুজনের পৃথিবী যেন একাকার হয়ে যায়। কে অপলা, কে সন্ধ্যামণি, তারা কি একই ব্যক্তি নাকি জমজ দুজন- সবকিছু এলোমেলো হয়ে এক বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে দাঁড়ায়।

সিরিজে মূল চরিত্র হিসেবে একজন মেগাস্টারকে দেখানো হয়েছে। কিন্তু এ মেগাস্টারের যে প্রকৃত জীবনের পাশাপাশি আরও এক আপাত জীবনের গল্প নিয়ে টানাপোড়েন দেখানো হয়েছে- তা কিন্তু এ যুগে আর শুধুমাত্র টেলিভিশন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জীবন নয়। বিগত কয়েকবছরে, বিশেষত কোভিডের সময় থেকে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবনের সাথে অনলাইনের সম্পর্ক কয়েকগুণ বেশি হারে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গিয়েছে। অনেকেই শুরু করেছেন ভ্লগিং নামক ছোটখাটো এক পর্দার সংস্করণে অভিনয়। এ যেন যারা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেইনস্ট্রিমে গিয়ে খ্যাতি পাওয়ার সুযোগ করে উঠতে পারেননি জীবনে, তারাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছেন। নিজেদেরকে তুলে ধরছেন নায়ক-নায়িকার মতো করে, কখনো বা নিজেদের জীবনকে এক কল্পিত মেগাসিরিয়ালরূপে 'ডেইলি ভ্লগের' মাধ্যমে তুলে ধরছেন। উদ্দেশ্য কিন্তু তাদের বিফলও হচ্ছে না। হাজার হাজার মানুষ তাদের শুধুমাত্র নিয়মিত দর্শকই নয়- বরং উৎসুক দর্শকও বটে। তারাও সে সকল ভ্লগিং এর মাধ্যমে হয়ে ওঠা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের 'স্টার' হিসেবেই অনেকক্ষেত্রে মূল্যায়ন করছেন। এমনকি দেশের মূলধারার গণমাধ্যমও ব্যতিক্রম নয় এক্ষেত্রে।

কিন্তু এই যে মুভি-সিরিয়ালে অভিনয় করা মানুষগুলোর মতো করে জনপ্রিয়তা পাওয়ার চেষ্টা করা, নিজেদের সামাজিক থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত জীবন পর্যন্ত উন্মুক্ত করে দেওয়া, শুধুমাত্র 'ভাইরাল' হতে চাওয়ার নেশায়- এর কি কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই? তাদেরও কি অপলার মতো করে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় না?

অপলার সুর টেনেই না হয় আমার লেখাটা টেনে নেই। অপলা যেমন করে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও অবুঝ বয়স থেকেই মায়ের 'তাড়নায়' (অনুপ্রেরণা না বলে একে আমার তাড়নাই বলা যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে) একদিন সন্ধ্যামণি হয়ে উঠে হাঁপিয়ে গিয়েছে, তেমনই আরও শত শত অপলা তৈরি হচ্ছে বর্তমান পৃথিবীতে সোশ্যাল মিডিয়ার চক্কোরে। বাবা-মায়েরা কেবল নিজেদের জীবনকেই উন্মুক্ত করে শান্তি পাচ্ছেন না, পুঁজি হিসেবে বিনিয়োগ করছেন অবুঝ সন্তানদেরও। এই সন্তানদের ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা এখনও তৈরি হয়নি, শুধুমাত্র বাবা-মাকে অনুকরণ করে তাদেরই তাড়নায় ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে এক একজন যান্ত্রিক, ক্রেজলোভী, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূল্যবোধহীন মানুষ হিসেবেও। যদি বড় হওয়ার পরে কখনো ভুল করেও তাদের মনে প্রশ্ন জাগে, যে জীবন সে পেয়ে এসেছে সেটা ভুলে ভরা এক মোহ, আর এর জন্য যদি বা তাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির শিকার হতে হয়, তারা তাদের মা-বাবাকে কাঠগোড়ায় দাঁড় করাবে না তো?

যে ধরণের ভ্লগারদের কথা বললাম, এরা সংখ্যায় অনেক। সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে এদেরকে হরহামেশাই দেখতে পাওয়া যায়। তেমন করে জনপ্রিয় পাকিস্তানি ক্ষুদে ভ্লগার সিরাজকেও চোখে পড়েছে আমার দুই একবার। কিন্তু কখনো সেভাবে গুরুত্ব নিয়ে দেখিনি। গুরুত্ব নিয়ে তার ভ্লগ দেখতে শুরু করলাম তখন, যখন জানতে পারলাম পড়াশোনায় ক্ষতি হচ্ছে বলে সিরাজ এবং তার ছোটবোন মুসকান আপাতত ভ্লগিং দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছেন। সম্ভবত এই মাস দেড়েক আগের ঘটনা। এ ঘটনার সংবাদে অল্প বয়সে খ্যাতি পাওয়া সিরাজের খ্যাতি এবং তার বাবার বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রশংসা দুই-ই হু হু করে আরও বেড়ে গেল এবং তারা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, অনলাইন পোর্টালের শিরোনাম-উপশিরোনামে স্থান পেতে লাগলো। সেটা দেখেই তাদের প্রতি আমার আগ্রহ বাড়ে এবং আমি তাদের অতীতের ভিডিওগুলো দেখতে শুরু করি।


ছয়/সাত বছর বয়সের ছোট বাচ্চা এক ছেলে সিরাজ আর তার চার-সাড়ে চার বছর বয়সী ছোট বোন মুসকান- তাদেরই দৈনন্দিন জীবন, গ্রাম, গ্রামের মানুষ, উৎসব ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে 'সিরাজি ভিলেজ ভ্লগ' এর ভিডিওগুলো তৈরি হয়। আমার কাছে তাদের ভিডিওগুলো বেশ ভালো লাগলেও কেন যেন কখনো আমি মনের মধ্যে সম্পূর্ণ সন্তুষ্টি খুঁজে পাইনি। যখনই তাদের দেখি, মনে হয়, এই যে পাখির মতো দুটো ছোট মানুষ কিছু মুখস্ত কথা বুলবুলিয়ে বলছে, এগুলো কি আদৌ তাদের করার কথা? যে বয়সে তারা প্রাথমিক শিক্ষা নিবে, নতুন নতুন নানা বিষয় শিখবে, সে বয়সে তারা মত্ত হয়ে আছে লাইক-ভিউ-সাবস্ক্রাইবের ভিড়ে। এখন হয়তো তাদেরকে এই অনেক অনেক অযাচিত ভালোবাসা, উপহার পাওয়া মুগ্ধ করছে। কিন্তু তারা কি আসলেও এটা বুঝতে পারছে যে তারা কেন কী করছে? আমার এই ভাবনাগুলো মাঝে মাঝে আমার কাছেই পরশ্রীকাতরতা বলে মনে হয়। তখন ভাবি, তাদের এই ছেলেখেলার মতো করে করা এসব ভ্লগ যদি তাদের প্রত্যন্ত গ্রামকে উন্নয়নের বিভিন্ন পথ দেখিয়ে দেয়, তবে মন্দ কী! কিন্তু পরক্ষণেই আবার তাদেরকে তাদের পিতা ছাড়াও আরও অনেক বড় বড় মানুষের পুঁজি হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখে ব্যথা পাই। তারা কীভাবে অন্যের সুবিধা আদায়ে ব্যবহৃত হচ্ছে, তারা নিজেরাও বুঝতে পারছে না। চার বছরের মুসকান, সাত বছরের সিরাজ-এর কাছে সবটাই খেলা বলেই মনে হওয়ার কথা। এর বাইরের কোনো হিসাব-নিকাশও এ বয়সে তাদের মাথায় এলে তা প্রশংসনীয় নয় অবশ্যই।

ফিরে যাই অপলার গল্পে। এ লেখার শুরুতে অপলার গল্পের যে দিকটি নিয়ে আলোচনা করলাম, সেটি ছাড়াও আরো একটা বিষয় এ সিরিজে উঠে এসেছে বলে আমার মনে হলো। এই যে অপলা লাইট-ক্যামেরা-একশনের জীবন থেকে সরে আসতে গিয়েও পারলো না, আরও দুই মাস সেখানে আটকে রইল- সেই দুই মাস শেষেও কি সে তার কাঙ্ক্ষিত জীবন শুরু করতে পেরেছিল? নাকি হাতছানি দিয়েছিল নতুন কোনো সম্ভাবনার নেশা?

এ যেন আমাদেরই জীবনের গল্প। সহজলভ্য আধুনিকায়নের ভিড়ে কখন যে আমরা আমাদের প্রকৃতিগত চাওয়া-পাওয়াগুলো থেকে দূরে সরে যেতে থাকি, সে আমরা নিজেরাও টের পাই না। শুধু এক নাম না-জানা সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে থাকি। ছুটতে ছুটতে এক গোলকধাঁধায় পড়ে যাই- বের হতে পারি না। হয়ে পড়ি এক বোকাবাক্সতে বন্দী!

ছবিসূত্র: গুগল
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০২৪ রাত ১১:০৪
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১৯

'পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......
[/সব

আমার এক মামা ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জব করতেন হোটেলের শুরু থেকেই। সেই মামা মাঝেমধ্যে আমাদের জন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে মুখরোচক কেক, পেস্ট্রি ছাড়াও বিভিন্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তার চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না, তবুও

লিখেছেন খাঁজা বাবা, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৩২



শেখ হাসিনার নাকি বায়ক্তিগত চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না। শেখ মুজিবের বেয়ে নাকি দুর্নীতি করতে পারে না। সে এবং তার পরিবার যে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করতে পারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিষয়ে সামু কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৬

ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং তার দলের পতন ঘটানো হয়। এটা আমাদের একটা জাতীয় গৌরবের দিন। এটা নিয়ে কারও সন্দেও থাকলে মন্তব্যে লিখতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জ্বীনভুতে বিশ্বাসী বাংগালী ও ঢাকায় ৫০ হাজার ভারতীয় একাউন্টটেন্ট

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৩




ব্লগার সাড়ে চুয়াত্তর ব্লগে লিখেছিলেন যে, উনার ভগ্নিপতিকে জ্বীনেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিলো; ২ সপ্তাহ পরে ভগ্নিপতিকে দিয়ে গিয়েছে; এই লোক, সামুর কাছে আমার বিরুদ্ধে ও অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেছুর নিজস্ব একটি জ্বীন ছিলো!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:২৪



আমাদের গ্রামের খুবই সুশ্রী ১টি কিশোরী মেয়েকে জংগলের মাঝে একা পেয়ে, প্রতিবেশী একটা ছেলে জড়ায়ে ধরেছিলো; মেয়েটি ঘটনাকে সঠিকভাবে সামলায়ে, নিজের মাঝে রেখে দিয়েছিলো, এটি সেই কাহিনী।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×