somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি সাঁকোর ব্যবধান

২১ শে জুন, ২০২৪ রাত ১১:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিজ্ঞানের ব্যাপক বিপ্লবসমূহ, যার অন্যতম দুইটি নির্দেশক হতে পারে ডারউইনবাদ এবং ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের প্রকাশ, মানবজীবনকে একটা ভঙ্গুর পথের দ্বারের কাছে এনে দাঁড় করায়। বহু বছরের উদযাপিত শান্তির উৎস ধর্ম ও ধর্মকে উপস্থাপন করা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে শুরু করে, আর সেই সাথে শুরু হয় সংশয়বাদের উত্থান। মানুষের জীবন হয়ে পড়তে শুরু করে বস্তুবাদ কেন্দ্রিক। তখন যেন বহুদিনের পুরোনো একটা নিরাপদ আশ্রয় টলতে শুরু করে এবং মানুষের চিন্তাসমূহ ও জীবনযাত্রা একটা ধাক্কা খায়। সেই ভঙ্গুর অবস্থা স্বাভাবিকভাবেই প্রতিফলিত হয় সেই সময়কার কবি-সাহিত্যক-দার্শনিকদের দর্শনে। ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে এটি 'ভিক্টোরিয়ান কনফ্লিক্টস' হিসেবে বেশ পরিচিত। এই দ্বান্দিক সময়ের প্রভাব সেই ভিক্টোরিয়ান যুগের ইংরেজ সাহিত্যিক থেকে শুরু করে বিশ শতকের ফ্রেঞ্চ, জর্মান কিংবা আমেরিকান লেখকদের লেখায়ও সুস্পষ্ট। ঊনিশ শতকের ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার যেমন তাঁর 'এনিহোয়্যার আউট অব দ্য ওয়ার্ল্ড' কবিতায় সে সময়ের পৃথিবী ছেড়ে 'অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে' চলে যাওয়ার মনোবাসনা প্রকাশ করেন, তেমনি নর্থ আমেরিকান কবি অ্যালেন গিনসবার্গ তাঁর 'আ সুপার মার্কেট ইন ক্যালিফোর্নিয়া' কিংবা 'সানফ্লাওয়ার সূত্রা'য় বলেন মানবজীবন কীভাবে তৎকালীন আধুনিকতাবাদ, পুঁজিবাদ দ্বারা কর্দমাক্ত হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে জর্মান লেখক ফ্রান্স কাফকা তো তাঁর বিখ্যাত বই 'মেটামোরফোসিস'-এর মূল চরিত্র গ্রেগরকে এ হীন অবস্থার প্রতিবাদ স্বরূপ এক কর্মে অনিচ্ছুক 'ভারমিন' বা পোকাতেই রূপান্তরিত করে ফেলেন!

আলোচ্য লেখাগুলো যখন সৃষ্টি হয় কিংবা প্রকাশিত হয়, তখন আধুনিকতাবাদ বা পুঁজিবাদের শুরুর দিককার সময়। এরপর আরও বহুবছর পেরিয়ে গিয়ে আরও একটি নতুন শতক এসে তার এক চতুর্থাংশ পর্যায়ও শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর এ সময়টা যেন সেই বোদলেয়ারের সময়ে মাত্র শুরু হওয়া আধুনিকতাবাদ বা বস্তুবাদ বা পুঁজিবাদের একটা শীর্ষ সময়। কারণ বর্তমানের জীবনগুলো হয়ে উঠছে একেকটি পণ্য। প্রত্যেকের জীবনে আধুনিকতা এতোটাই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়েছে যে মানুষ একে অপরের থেকে চূড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, যে বিচ্ছিন্নতা উল্লেখ্য বিভিন্ন '-বাদ' এরই এক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার উপস্থিতি দৈনন্দিন জীবনের সাথে এতোটাই মিশে গিয়েছে যে একে আর এখন পৃথক করে তেমন কেউ উপলব্ধি করতে পারে না, বরং সকলে একেই স্বাভাবিক হিসেবে বিশ্বাস করে। স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়ে তারা বসবাস করতে শুরু করে এক অদৃশ্য যোজন যোজন দূরত্বে। তখন বিচ্ছিন্নতাবাদের সূত্র ধরে জীবনে একে একে এসে হাজির হয় ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, বিষণ্ণতা ও এমনই আরও কিছু নেতিবাচক উপকরণ। তখন মনে প্রশ্ন জাগে, জীবন কি কেবল এমনই স্বার্থপরতায় জর্জরিত? সব সম্পর্কের মায়াজালই কি তবে মিথ্যে? মানুষ কি দিনশেষে সত্যিই একা?

একবিংশ শতকের একজন মানুষ হিসেবে উক্ত প্রশ্নগুলো আমার মনেও ঘুরপাক খায়। কখনো কখনো বিষণ্ণতার স্রোতে তলিয়ে নিয়ে যায়। মনে হয়, সব মিথ্যে। সব কৃত্রিম। আসলে এ জগতে কেউ কারো কিছু না, তবু ভান ধরে ভালোবাসার অভিনয় করে যায় কেবল। সে পরিবার থেকে বন্ধুবান্ধব কিংবা সাধারণ পরিচিত কেউ- অর্থাৎ যে কোনো মানুষের ক্ষেত্রেই সত্য। সত্যিকারের সৌহার্দ্য বলে বোধ হয় কিছু হয় না। আর যদি কখনো বা হয়েও থাকে, অন্তত এ যুগে আর তা বেঁচে নেই। কিন্তু আমার এ বিশ্বাস যেন এক হোঁচট খেল গতকালের এক অভিজ্ঞতায়।

গতকাল আমাদের এলাকার এক প্রান্তিক অচেনা গ্রামে দলবেঁধে আমরা স্কুলের বন্ধুরা পিকনিকে যাই। পদ্মার পাড়ের এক স্থান। সামনে নদীর বিশাল অবস্থান, আমরা সব দাঁড়িয়ে আছি এক খোলা প্রান্তরে- মাথার উপরে খোলা আকাশ। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার বদৌলতে সে স্থানে পৌঁছতে আমাদের অনেকটা দেরি হয়ে যায়। গিয়েই রান্নার যোগাড়-যন্তর শেষ করে বড় বড় পাথরের ফাঁকে চুলোর মুখ তৈরি করে রোস্টের মাংস ভাজতে শুরু করতে না করতেই অন্যদিকে শুরু হয়ে যায় অঝোর ধারাস্রোত। একে তো আষাঢ়ে বৃষ্টি, তার উপরে নদীর নিকটস্থ এলাকা। আড়াই ঘন্টার আগে এ বৃষ্টির অবসান নেই। আমরা ঊনিশ-কুড়িজন মানুষ যে যেভাবে পারলাম নৌকার গলুইতে, দোকানের ছাউনিতে আশ্রয় নিলাম। সব আমরা ছাত্র মানুষ, এতো শখ করে এতোদিন পরে পুরোনো বন্ধুরা হাজির হয়েছি এ আনন্দ আয়োজনের জন্য- তার মাঝে এই বিপদ! আয়োজন পন্ড হলে এতো টাকার ক্ষতি, দুপুরের খাবার বাদ, আনন্দও বিনষ্ট। এসব ভাবনা নিয়ে দূরের এক দোকানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ শুনতে পেলাম কাছাকাছি বাড়ির এক ভদ্রমহিলা এসে নৌকায় রান্নার জিনিসপত্র নিয়ে আমাদের যে বন্ধুরা বসে ছিল, তাদের জোর করে ডেকে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছেন। এই ভদ্রমহিলার সাথে এই স্থানে আসার পরপরই আমাদের আলাপ হয়েছিল। কৌতুহল নিয়ে বাকি আরও মানুষের মতো তিনিও আমাদের উদ্দেশ্য কী জানতে এসে বেশ আন্তরিকতা নিয়েই বলেছিলেন, আমরা যেন সবকিছু তার বাড়িতে দিয়ে আসি। তিনি আমাদের জন্য রেঁধে দিবেন, আর আমরা ঘুরে আনন্দ করে সময় কাটাবো। কারণ তার মনে হয়েছিল খোলা জায়গায় বাতাসের মধ্যে রাঁধতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হতে পারে। কিন্তু তখন আমরা তার এ প্রস্তাবে সম্মত না হয়ে আন্তরিকতা নিয়ে জানাই যে, যদি প্রয়োজন হয় অবশ্যই তাকে জানাবো। দুঃখজনক হলেও সত্যি, তখন আমাদের মনে এ অযাচিত আন্তরিক প্রস্তাবে কৃতজ্ঞতার চেয়ে বিরক্তির উদ্রেকটাই বেশি হয়েছিল। আমরা হাঁসফাঁস করছিলাম কী করে এ আপদ থেকে নিস্তার পাওয়া যায় তার জন্য।

এরপরে সেই ভদ্রমহিলা বৃষ্টির তোড় দেখেই ভিজতে ভিজতে ছুটে আসেন আমাদেরকে তার বাড়ি নিয়ে যেতে এবং এক প্রকার জোরপূর্বক নিয়েও গেলেন। তবে শুধু তাই না, গিয়ে নিজেদের রান্নাঘরে রাঁধার ব্যবস্থা করে দিলেন, কখনো অনুপস্থিত কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে নিজেদের থেকে দিচ্ছিলেন, বারবার রান্নার কাছে গিয়ে তদারকিও করছিলেন যথাসম্ভব। এছাড়া বাকিদের নিজ ঘরে আশ্রয় দিলেন (অন্তত মেয়েগুলোকে; তবে আমার বিশ্বাস আমাদের ছেলে বন্ধুগুলোও দল বেঁধে এসে ঘরে উঠতে চাইলে মানা করতেন না)। এমনকি সবশেষে আমরা খাবারটাও খেলাম তাদের বড় ঘরে বসে। অবশ্যই শুধুমাত্র এই ভদ্রমহিলা নন, তার পরিবারের বাকি সদস্যবৃন্দসহ পাড়াপ্রতিবেশিরাও একই রকম আন্তরিকতা নিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করলেন। বহুদিন পরে এমন আন্তরিক ব্যবহার পেয়ে আমরা এতোটাই মুগ্ধ হলাম যে মনে হলো, পৃথিবী থেকে এখনও মানবিকতা হারিয়ে যায়নি। হয়ে যায়নি সকলেই বিচ্ছিন্ন কিংবা আত্মকেন্দ্রিক। এখনও পৃথিবীতে এমনও মানুষ আছে, যারা হয়তো শহরীয় আধুনিক প্রাচুর্যের মধ্যে বাস করে না- বরং সকল উন্নয়নের ধারণার থেকে সাধারণ একটি নড়বড়ে বাঁশের সাঁকোর মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন- তবে এদের মধ্যেই এখনো প্রকৃত মানবীয় মিথস্ক্রিয়তা বেঁচে আছে। এরাই মানবকূলের সেইসব প্রতিনিধি, যারা এই পৃথিবীকে ইতিবাচকভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারে আরও বহুদিন।

ছবি: শুভ্র শোভন
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০২৪ দুপুর ১২:৫০
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১৯

'পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......
[/সব

আমার এক মামা ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জব করতেন হোটেলের শুরু থেকেই। সেই মামা মাঝেমধ্যে আমাদের জন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে মুখরোচক কেক, পেস্ট্রি ছাড়াও বিভিন্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তার চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না, তবুও

লিখেছেন খাঁজা বাবা, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৩২



শেখ হাসিনার নাকি বায়ক্তিগত চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না। শেখ মুজিবের বেয়ে নাকি দুর্নীতি করতে পারে না। সে এবং তার পরিবার যে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করতে পারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিষয়ে সামু কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৬

ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং তার দলের পতন ঘটানো হয়। এটা আমাদের একটা জাতীয় গৌরবের দিন। এটা নিয়ে কারও সন্দেও থাকলে মন্তব্যে লিখতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জ্বীনভুতে বিশ্বাসী বাংগালী ও ঢাকায় ৫০ হাজার ভারতীয় একাউন্টটেন্ট

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৩




ব্লগার সাড়ে চুয়াত্তর ব্লগে লিখেছিলেন যে, উনার ভগ্নিপতিকে জ্বীনেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিলো; ২ সপ্তাহ পরে ভগ্নিপতিকে দিয়ে গিয়েছে; এই লোক, সামুর কাছে আমার বিরুদ্ধে ও অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেছুর নিজস্ব একটি জ্বীন ছিলো!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:২৪



আমাদের গ্রামের খুবই সুশ্রী ১টি কিশোরী মেয়েকে জংগলের মাঝে একা পেয়ে, প্রতিবেশী একটা ছেলে জড়ায়ে ধরেছিলো; মেয়েটি ঘটনাকে সঠিকভাবে সামলায়ে, নিজের মাঝে রেখে দিয়েছিলো, এটি সেই কাহিনী।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×