টানা পাঁচ বছর ক্লোনাজেপাম খেয়ে তার প্রতি এক ধরনের গভীর অনুরাগ জন্মে গেছে শরীরের। আরো বেশি চায় সে, আগের ডৌসিজে সাড়া দেয় না। এই আসক্তিমূলক ভালবাসা থেকে নিষ্কৃতি পেতে ছুটলাম ডাক্তারের কাছে। বেশ বড় ডাক্তার তিনি, মাঝেমধ্যেই গোঁফের আকার-প্রকৃতি-বিন্যাস নিয়ে ইক্সপেরিমেন্ট করেন। ঢুকতেই বললেন, ‘কেমন আছো?’
‘ভাল নেই বলেই তো আসা ডক্টর’
সব শুনে দু’পাশে মাথা ঝাঁকালেন, ‘ক্লোনাজেপাম তোমায় ছাড়তে হবে। আমি এই ওষুধটা দিচ্ছি, এখন থেকে এটা খাবে’
এক হাজার টাকা দর্শনী দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম, রাস্তার পাশে। সন্ধ্যা পেরিয়ে সময় ধীরলয়ে ইমন কল্যানে সুর তুলে রাতের পানে এগিয়ে চলেছে। তার সাথে নানা রাগ-বিরাগ মিশিয়ে সুরহীন ঐক্যতানে অফিসফেরতদের বেশিরভাগই ইতোমধ্যে বাড়ি ফিরে গেছে। রাস্তাটা বেশ ফাঁকা, বাতাসটাও একটু ঠান্ডা। ঘড়ি দেখলাম দশটা বাজে। ব্যবস্থাপত্রের পাদটীকায় লেখা ‘সাক্ষাতের সময় বিকেল ০৪ঃ৩০ ঘটিকা হতে রাত ১০ঃ০০ ঘটিকা পর্যন্ত’। প্রায় জনা ত্রিশেক রোগী এখনো বসে আছে। সপ্তাহে পাঁচদিন রোগী দেখেন তিনি, গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে পঞ্চাশজন। সে হিসেবে তার সাপ্তাহিক রোজগার আড়াই লাখ টাকা, মাসিক দশ লাখ টাকা এবং বাৎসরিক এক কোটি বিশ লাখ টাকা, কর ফাঁকি দেয়া নিখাদ বাংলাদেশী আয়।
ব্যবস্থাপত্রে সবচেয়ে বড়ো করে লেখা চিকিৎসক মহোদয়ের নাম – মোঃ হামিদুর রহমান। তার নিচে অপেক্ষাকৃত ছোট অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে জানা অজানা অর্জনাদি – এমবিবিএস, এমডি, এফএসিপি (আমেরিকা), এফসিপিএস, ফেলো হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল (আমেরিকা)। সরকারী ডাক্তার অথচ দেশের কোন হাসপাতালে বা মেডিক্যাল কলেজে কাজ করেন তার উল্লেখ নেই। অফিস কামাই করে তোলা পুরো বেতনে তিনি কর দেন, তবু সাদা টাকার গায়ে লাগা কালো আঁচড়টা হয়তো মুছে যায়না।
ব্যবস্থাপত্রে আমার নাম, বয়স, অসুখ আর ওষুধের নাম আছে; ওজন, বিপি এসব কিচ্ছু নেই। নাম আর বয়সটা বুঝলাম কারণ ওগুলো আমিই ডাক্তারকে বলেছি, অসুখটা অর্ধেক বুঝলাম কারণ তা ধারণ করে আছি আমি আর নির্ণয় করেছেন ডাক্তার, ওষুধটা বুঝলাম না কিছুই, সেটা যে ডাক্তার দিয়েছেন! বুঝলো ডিসপেনসারির পুঁচকে ছেলেটা, ওষুধের নাম কিউটিয়াপিন ফিউমারেট আই এন এন।
আমি এক বিশেষ ধরনের বিদঘুটে রোগী। যেকোনো ওষুধের সাইড ইফেক্টস আমাকে আঁকড়ে ধরে প্রবলভাবে, ঠিক যেন আমার দু’বছর বয়েসী বাপ-নেওটা মেয়ের মতো, ছাড়তে চায় না কোনোমতেই। ওষুধের তথ্য-পাতা চেয়ে নিলাম।
নিদ্রালুতাঃ দরকারী তবে কেবল ঘুমের আগে, চব্বিশ ঘন্টা নয়।
মাথা ঝিমঝিমঃ কে চায়!
শুকনো মুখঃ কর্পোরেট হাসি, স্ত্রী সোহাগ !!
মৃদু দৌর্বল্যঃ দুর্বল কে হতে চায়, এ পৃথিবী সবলের!
কোষ্ঠকাঠিন্যঃ হাজার রকমের বদ্ধতাই তো সব সমস্যার মূল, মলবদ্ধতা কোনোভাবেই না।
বদহজমঃ বলে কী! পৃথিবীতে টিকেই আছি হজমশক্তির জোরে।
মূর্ছাঃ সময়মতো কাজ দেয় কিন্তু অসময়ে!
ওজন বৃদ্ধিঃ এটা ভালো, ওজনদার সবাই হতে চায়।
আরো আটটা আছে। অর্ধেকেই ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে – এ ওষুধে ওজনদার আমি দুর্বল শরীরে শুকনো মুখে কোষ্ঠকাঠিন্য আর বদহজম চেপে মাথা ঘুরে নিদ্রিতপ্রায় হয়ে মূর্ছা যাবো। কী সর্বনাশ, এ যে কিলিং পিল!
তবু আমি ডাক্তারের কথামতো ওষুধ খাওয়া শুরু করলাম। প্রথম বড়িটা গেললাম দশটার খবরের মাঝামাঝি সময়ে যখন আমাদের সরকারপ্রধানের সাথে আড়ং এর শাড়ী-পরা আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের সৌজন্য সাক্ষাতের ‘বিস্তারিত’ দেখানো হচ্ছিলো।
সকালে ঘুম ভাংগতেই বুঝতে পারলাম আমি ঠিক নেই। সেই থেকে অসাড় শুয়ে পড়ে আছি বিছানায়, চিৎ হয়ে। হাতে জোর পাচ্ছি না, পা দু’টোও নাড়াতে পারছিনা মনমতো। বিছানায় বসিয়ে বউ নাস্তা খাইয়ে গেছে। শুয়ে শুয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে আছি, ভাল না লাগলে রিমোটের বোতাম টিপছি। আর কারণে অকারণে বউকে ডাকছি, ঝাড়ছি পুরো ‘অধিকার’টুকু ফলিয়ে। ডাক্তারকে যে ফোন করবো তার উপায় নেই, দর্শনী দিয়ে দর্শন ছাড়া তিনি কোনোরকমের মতামত দেন না। আজ যে যাবো সে উপায়ও নেই, এ দু’দিন তিনি বসেন না।
নিস্তরঙ্গ সটান দেহে বড় বড় চোখ মেলে ক্যাটরিনা-দীপিকার ঝড়-তোলা নৃত্যাবয়ব দেখা ছাড়া আমার তাই তেমন কোনো কাজ থাকে না। দেশী কয়েকটা মেয়ে উঠে আসছে, চেহারা আছে ঠমক নেই। পরিচালনা আর কোরিওগ্রাফির বদান্যতায় আবেদনটা পরিপূর্ণতা পায়না। তবু দেশী সুখের আশায় দেশী চ্যানেলে ঘুরে আসি মাঝেমধ্যে। সেখানে একঘেঁয়ে অরিজিত সিং আর অনাবিষ্কৃত সুপারস্টার ফারহান আখতারের ঢাকা কনসার্টের বর্নিল প্রচারণা চলে।বাংলায় ডাবকৃত বিদেশী বিজ্ঞাপনের ফাঁকে চলে কথা-ব্যবসায়ীদের টক শো আর একইরকম সংলাপ-কাহিনীতে বোনা স্থূল রসিকতার নাটক। গালি যেমন আমরা বিদেশী দিই, ইতরামোও আমরা বিদেশী দেখি। আমি দেখি আইটেম সং আর আমার বউ দেখে সনি-প্লাস-বাংলা-জলসা। না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারছি এখন সে আমার দিকে ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে দেখছে ক্যাটরিনা-দীপিকাকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। একই চোখে আমি ওকে দেখি যখন সে কূটচাল আর পরকীয়াময় সিরিয়ালগুলো দেখে। ওর বিরক্তিভরা শারীরিক ভঙ্গিমায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া পেছনে আকর্ষনের জাল বিছিয়ে দেয়, সেই সাথে ল্যাভেন্ডারের বর্ণহীন কুয়াশায় আবৃত হই। দীপিকার গৃহ-সংস্করন হঠাৎই আমাকে জাগিয়ে দিয়ে যায়। আমি চ্যানেল ঘুরাই।
জাগ্রত, অসাড় আমি শুয়ে অপেক্ষা করছি, কিন্তু কীসের? সচলতার, বিছানায় গেঁথে ফেলে চেপে বসা সময় ফুরনোর, স্ত্রীর পদ্মার-ঢেউ-তোলা শরীর নাকি অনন্তকাল ধরে চলা ইজরিয়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাত অবসানের? নেতানিয়াহু ওবামাকে চোখ রাঙায়, কেরী ইজরিয়েলে ‘ছুঁই পানি, না ধরি মাছ’ জাতীয় বক্তব্য দিয়ে আব্বাসের সাথে শান্তির পায়রা উড়ায়। পায়রাগুলো উড়ে গিয়ে বসে দূরের বহুতল স্থাপনার মাথায় বা কার্নিশে যেগুলো জাতিসংঘ মহাসচিবের ফাঁকা বুলিকে পাইলিং করে সত্তর ফিট নিচে চাপা দিয়ে নতুন করে অধিকৃত এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে। মানুষ আছে, দেশ নেই, জীবনের দাম নেই। ঘাড়ের ব্যথাটা সহসাই টের পেলাম, একটা ভারী লম্বালম্বি অনুভূতি সমস্তটা জুড়ে। মনে পড়ল কিউটিয়াপিনের ষোলটা সাইড ইফেক্টের মধ্যে এটা ছিল না। আর থাকবেই বা কেন, সব কি থাকতে হয়? জবরদস্তিতে এসে গেলেই হলো। সরাচ্ছে কে!
নাকের ডগায় একটা মশা বসেছে। অ্যানিফিলিস না এডিস? ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু না জিকা? ভাবলাম অনেক কষ্ট করে হাতটাকে কাঁপিয়ে বাতাস কেটে নাক অবধি পৌঁছানো যায়, কিন্তু পারলাম না। আমি তাই কায়দা করে নিজের মুখ-চূড়ায় হুল ফুটিয়ে রক্ত চোষা দেখার চেষ্টা করলাম, কখনো মনে হচ্ছে একটাই মশা আছে, কখনো সেটা দু’টা হয়ে যাচ্ছে, কখনো ঝাপসা। মারামারির শব্দে চোখ চলে গেল টিভিতে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে কয়েক দফায়, আজকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পর্যায়ের ভোটগ্রহণ। নিরাপত্তা বাহিনী আইন মেনে গুলি করেছে, প্রাণ হারিয়েছে এগারোজন। আইন মেনে অপরাধ হয়না, সুতরাং বিচারের প্রত্যাশা বাতুলতামাত্র।বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একটি ছেলে মারা গিয়েছে – খবরের কাগজে কাল লিখলো জাল ভোট দিতে গিয়ে, আজ টিভিতে বলছে ‘রাজনীতিবিমুখ’ ছেলেটি সকালে ভোট দিয়ে বিকেলে ভোটের ফল জানতে গিয়েছিল। কোনটা সত্য? কে জানে? কেউ কি জানে? সত্যমিথ্যার বিস্ময়কর গোলে রাজনীতিতে পাক খেয়ে পিন্ডে পরিণত হই আমরা। ব্যাপক সংঘর্ষ চলে কিছু উত্তরহীন বা অর্থহীন প্রশ্নকে ঘিরে। রক্ত খেয়ে মশাটা যেন ছোট চীনে জোঁকের মত হয়ে গেছে। দূরে যেতে পারে না তাই উড়বার চেষ্টা করে লাফিয়ে পড়ে আশেপাশে কোথাও। আমি তার সঙ্গীর অপেক্ষা করি, একটু আগেই কানের কাছে গুনগুনিয়ে গেছে। গানের বদলে রক্ত। ব্যবসা সবাই বোঝে, কেউ আগে আসে কেউ বা পরে।
ইতিহাসের যে হাসি-মুখ মেয়েটা হিজাব পরতো, নাটক করতো, বাচ্চাদের গান শিখিয়ে রোজগার করতো, দু’টো পয়সা তুলে দিত বাবার হাতে, সেই মেয়েটাই হঠাৎ ইতিহাস হয়ে গেল, বর্তমান থেকে হারিয়ে গেল ভবিষ্যতকে অবান্তর করে দিয়ে। কীভাবে কেউ জানেনা, বুঝতেও পারেনা। খ্রীস্টের মৃত্যুর একুশশো বছর পর, ইসলামের জন্মের চৌদ্দোশো বছর পর, গ্যালিলিও-নিউটন-আইনস্টাইন যুগ পেরিয়ে যাবার অনেক বছর পর, কয়েকমাসের মধ্যে পদার্থবিদ্যায় দু’ দু’টো যুগান্তকরী আবিষ্কারের পর তবু তাই মনে হয় মানুষ এখনো মানুষই রয়ে গেছে, ‘মানুষ’ হয়নি। সাদা ময়নাতদন্ত আমাদের আর অবাক করেনা, কেবল সভ্যতার মাপকাঠিতে নিজেদের অবস্থানকে জানান দিয়ে যায়। তিনটে প্রধান হাসপাতালে যাবার রাস্তা বন্ধ করে প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া মানুষদের ছোট মিছিলের উদ্দীপনা ছুঁয়ে যায়না তেমন কাউকে, আমি চ্যানেল ঘুরাতে উদ্যত হই।
ঠিক তখনি চোখ চলে যায় দরজায়, দীবা দাঁড়িয়ে আছে, দরজার ফ্রেমে আর যা কিছু আছে সব কিছুকে পুরোপুরি ম্লান করে দিয়ে। আমার মুগ্ধতা-মাখা চাহনিকে কোনরকম পাত্তা না দিয়ে বুকের কাছ বরাবর খাটের পাশে এসে দাঁড়ালো।
‘হাবীব ভাইকে একটা ফোন করে দেখো না’
‘হাবীব কী করবে?’
‘ডাক্তার মানুষ, সে জানবে না কেন এমন হচ্ছে!’
‘কালকের দিনটাই মাঝে, পরশুদিন তো ডাক্তারই বসছে’
‘এই দু’দিন অচল পড়ে থাকবে?’
‘এটুকুতেই বার্ডেন হয়ে গেছি?’
‘সেটা বলল কে!’
‘কীভাবে বুঝবো যে বলোনি?’
ততক্ষণে সে আমার কোমরের পাশে বিছানায় বসে গেছে। একটা পা তুলে দিয়েছে আরেকটার উপর, হাঁটুর কাছে দু’টো পা মিলে পৃথক হয়ে নেমে গেছে নিচে, একটা মেঝে ছুঁয়ে আছে, আরেকটা একটু উপরে ঝুলছে। পালাৎজোটা উঠে গেছে গোড়ালি থেকে অনেকখানি উপরে, লম্বাটে রক্তাভ-সোনালী-সাদাটে লোমহীন পা দু’টোকে বেশ খানিকটা অনাবৃত করে দিয়ে। দীবা জানে আমি কতটা ভালবাসি ওগুলোকে দেখতে, আদর করতে। ওর পাত্তা না দেয়ার অভিব্যক্তি বদলে নরম রোদেলা আভা ছড়িয়ে পড়েছে সারা মুখে-চোখে-ঠোঁটে এবং লম্বাটে সংবেদী গলায়-ঘাড়ে।
‘সময় আছে তোমার? ইন্ডিয়ার নায়িকাদের গিলে খাচ্ছিলে’। কপট রাগে গোলাপরঙা ঠোঁট দু’টো একটু কাঁপে, কোনায় সামান্য হাসি খেলিয়ে।
চোখের ইশারায় ওর দৃষ্টিটা আমার কুঁচকির দিকে ঘুরিয়ে বললাম, ‘দীপিকা নয়, দীবা জাগিয়েছে’।
গলা বাঁকিয়ে মুখের দিকে তাকালো, ডান হাতটা আমার লোমশ বুকে রাখতেই একটা পড়ে থাকা লোম অদৃশ্য পাখায় ভর করে উড়ে গেলো ফ্যানের বাতাসে, বাইরে প্রচন্ড তাপ ছড়ানো সূর্যকে আড়াল করে দিয়ে একটা মেঘ শুষে নিল রোদের তীব্রতাকে, ঠিক সেই সময় আমার তাপটুকুকে মুখে পুরে নিল দীবা। ওর পিঠ-ছোঁয়া রেশমী চুলগুলো ছড়িয়ে পড়েছে মুখের চারপাশে, দৃষ্টিকে আড়াল করে দিয়ে। বরাবর আমি এসময় হাত দিয়ে চুলগুলোকে ধরে রাখি, আজ কিছুতেই বল পাচ্ছি না। অনেক দিনের অভ্যাসে দীবাও বুঝতে পারল, একটু থেমে হাত ঘুরিয়ে আলগোছে খোঁপা করে হেয়ার-পেন্সিল দিয়ে এফোঁড়ওফোঁড় করে গেঁথে দিল। কয়েকটা লালচে রেশমী চুলের একটা মিহি চপলা রাশি নেমে এসে আদর বুলিয়ে দিচ্ছে ওর বাঁ গালে নাকে, সাথে কিছুটা সুড়সুড়িও। চোখের সামনে ঝুলে থাকা শিহরণ-জাগানিয়া পর্দাটা সরে যেতেই আধুনিক কবরীবন্ধের আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসে ইরাককে উপহার দেয়া চমৎকার গণতন্ত্র যার সুবাতাস ছড়িয়ে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের বুক জুড়ে, উবে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ, হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নগর সভ্যতা-চিহ্ন। পতাকায় অমাবস্যা নামিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিভ্রান্ত মানুষেরা, তারা শেকল-পড়া চূড়ান্ত মুক্তির স্বপ্ন দেখায়।
নেশা-ধরা চোখে মুখ তুলে সোজা হয়ে বসে দীবা, ভেজা ঠোঁটে। আমার চোখে অনিমিখ চাহনি ফেলে দ্রুত সচল হাতে নিজেকে অনাবৃত করে। মেঘ চুইয়ে পড়া রোদেরা জানলা গলিয়ে ঘরে এসে রাঙিয়ে দিয়ে যায় তাকে। আমি তাকাই, মুহূর্তের মধ্যে বদলে যায় দেয়ালের রঙ, আসবাব, বিছানার চাদর। ভারী পর্দাগুলো মিহি মসলিন হয়ে আরব বসন্তের বাতাসে উড়তে থাকে – প্রান্তের দিকে দাপাদাপি করে, গোড়াটা ঘুরে জায়গায় থেকে। দীবার সুমুখ-পথ সভ্যতার বা অ-সভ্যতার সার্বক্ষণিক দ্বন্দ্বে সর্বদা জবা-রঙা, থকথকে কাঁচা রক্তে ভেজা, কবে থেকে তা মনে করতে পারেনা, হয়তো জন্মাবধি বা তারো হাজার বছর আগে থেকে। দীবা কষ্ট পায় না, অভিযোগ করে না, মেনে নিয়েছে সভ্যতা বিকাশ বা নিকাশের সহোদরকে। সে মার্গে পথচারী হই আমি নিয়মিত। আজ সে নিরবদ্য দেহটা বসিয়েছে উল্টা ঘুরে, মসৃণ মালভূমির মত পিঠটা আমার চোখে আগোচরে মোলায়েম পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে, কাঁধের কাছে সৃষ্টি হয়েছে ছোট উপত্যকার, তাপের পারদখানি বাড়িয়ে। অনভ্যস্ত, অনিয়িমিত পথে দীবা আজ আমাকে প্রবেশ করায়, সরু সে পথ সাঁড়াশির মতো চেপে ধরে আমাকে, তার অস্ফুট চিৎকার-শীৎকার একাকার হয়ে মিলিয়ে যায় নির্লিপ্ত উন্নয়নশীল বা মধ্যম আয়ের বাতাসে।
আফগান বা পাকিস্তান প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠক করে ওবামা আরো সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। কায়েদে আযম টুপি-পরা রাষ্ট্রপ্রধানরা ফটোসেশনে মাথা ঝুঁকিয়ে হাত মেলায়, হাসে, তারপর বাঘের গলা থেকে হাড় বের করা বকের মত ঘাড় বেঁকিয়ে তালিকাভুক্ত ক্যামেরার দিকে তাকায়, ঝলসে উঠে ফ্ল্যাশ লাইট। আলেপ্পোর আকাশে আঁধার পালিয়ে যায়, শান্তি আলোচনা জমে উঠার আগেই ভেস্তে যাবার উদযাপনে। নাম-নিখোঁজ রোহিত শবের অদৃষ্ট ফর্দে দৈনন্দিন রুটিন সংযোজন, পচা রস বেরিয়ে আসে পুরনোগুলো থেকে। মৃতেরা কথা বলে, অভিশাপ দেয়, কেউবা চুপ শুয়ে নক্ষত্র বা বুলেট গুণে নাকের ডগায় তেলের গন্ধ নিয়ে। আমি শুনি ওবামার কথা, লিবিয়া আক্রমণে ভুল স্বীকারের কথা। বুশ ছবি এঁকে বেড়ায়, আঁকিয়ে হিটলারের প্রেতাত্মা আমেরিকান রাষ্ট্রপতি না হবার আফসোসে হতাশার আঁচড় দিয়ে যায় সে ক্যানভাসে। মর্মভেদী চিৎকারে সম্বিৎ ফেরে, নির্জীবতা যায়না। উরুসন্ধিতে পেছন ফিরে উপবিষ্টা, গতি বাড়িয়ে চুল ছেড়ে দিয়ে গন্তব্যে বসে গন্তব্যে পৌঁছার প্রয়াসরত বিবসনা বল্গহীন সাদা ঘুড়ী আনন্দ বা চাপা আক্রোশে ফেটে পড়তে চায় যেন। দুরন্ত ঘুড়ীর পেছন-পেশীর চোখ-বেঁধা ম্যাজিকাল মুভমেন্ট দেখি আমি, ইচ্ছে হয় ছুঁয়ে দেখি, অবশ হাত সাড়া দেয়না, আনন্দ বা বেদনায় দীবা গোঙায়। অধৈর্য্য কলিং বেলের টানা শব্দে অসমাপ্ত, অপরিপূর্ণ, লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ অভিযান থেমে যায়, দীবা নেমে পড়ে, দু’পায়ের উপর ভর করে দাঁড়াতে পারে না, কাঁপে চাপিয়ে দেয়া গণতন্ত্রের মত, দু’চোখ বেয়ে নামে পয়োধারা। আমি দ্বিধায় পরে যাই – আনন্দ না বেদনার!
‘এ সময় আবার কে এলো?’
‘মাছওয়ালাকে আসতে বলেছিলাম’।
‘আর সময় পেলো না হারামজাদা!’
কাপড় পরে হাবীবকে কল দিয়ে মোবাইলটা কানের কাছে বালিশে গুঁজে দেয়। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় দীবা, মূল দরজা খোলার শব্দ হয়। মাছওয়ালার সাথে কথা বলে, আমি টিভির ভলিউম বাড়িয়ে দিয়েছি। হাবীব ফোন ধরে।
‘কীরে ব্যাটা কী খবর?’
‘আর কইস না, ডাক্তার পুরা হুতায়া দিসে’
‘কেন কী হইসে?’
‘ওষুধ বদলায়া দিসে, অহন আমি তো নড়তে চড়তে পারি না’
‘কস কী! কী ওষুধ?’
অসুখ এবং ওষুধের বিস্তারিত বললাম।
‘ক্লোনাজেপাম হঠাৎ ছাড়া উচিত না, গ্র্যাজুয়ালি কমাতে হবে, নট কোল্ড টার্কি। তুই নতুনটা বাদ দে। আবার ক্লোনা স্টার্ট করে, আস্তে আস্তে সময় নিয়ে কমা। কয়েক মাস লাগুক, সমস্যা নাই।’
‘অহন তো দুই একটা জিনিস নড়ে, এইডাও বন্ধ হয়া যাইবো না তো?’
‘কী যে কস না শালা, ভিজিটটা পাঠায়া দিস’
‘ভিজিটও মোবাইলে নেস নাকি!’
‘হুম’
‘শালার দেশের নামটাই বদলায়া মোবাইলদেশ রাখা দরকার। তোর বউরে কইস, দাওয়াত খায়া ভিজিট দিয়া যামু’
ঝাড়া দশ মিনিটের আঠারো-প্লাস ফোনালাপ শেষে যখন টিভিতে চোখ রাখলাম, দরজার শব্দ শুনলাম, মাছ কিনে দীবা কিচেনের দিকে যাচ্ছে।
‘কী মাছ কিনলে?’
‘চিংড়ি’
‘চিংড়ি!’
‘কেন কী হয়েছে?’
‘ওজন বাড়ানোর জন্য আজকাল চিংড়িতে চিংড়ি-রঙা জেলী মেশানো হয়। খবরে দেখোনি!’
‘না’
‘ভালো করে চেক করো, এই দেশে খাওয়ার দিন শেষ – ফরমালিন, রঙ, প্রসেস্ড’ আমার বলা শেষ হয়না, দীবা থামিয়ে দেয়।
‘গত দু’বছর ধরে মাছ দিচ্ছে, ও ঠকাবে না’
‘কত জন সারা জীবন ধরে ঠকায়, টের পাওয়া যায় না, আর এ তো মাত্র দু’বছর!’ না, এই কথাটা আমি দীবাকে বলিনি।
আমাদের বিয়েটা ছিল ক্যালকিউলেইটিড ম্যারিজ। গ্রামের কৃষক পরিবারের ছেলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম– বিজনেসে। কোনোদিন কোনো বই কিনিনি, ফটোকপির দোকানে বাঁধাই করে বিক্রি করা নোট-স্লাইড পড়ে দ্বিতীয় বিভাগে পাস করে ব্যাংকে ভালো চাকরী করছি। দীবা বড়লোকের মেয়ে, একেবারেই না পড়ে পাস করা – জামাই জুটানোর সনদ নিয়ে।গরীব বাবার সন্তানের বড়লোক নেটয়ার্কওয়ালা শ্বশুরের দরকার ছিল, আর দীবার ভাল চাকরীওয়ালা স্ট্যাটাস মেইনটেইন করতে পারা স্বামীর দরকার ছিল। তাই আমি বিয়ে করেছিলাম, বিয়ের আগেই একবার গর্ভপাত করানো এই মেয়েকে। আমরা কি সুখে নেই? সুখ কী? সুখী হওয়া যায়না, সুখী ভাবতে হয়। ওইটুকু খুঁত না থাকলে এই স্মার্ট নিখুঁত মেয়েটাকে পেতাম? জীবন মানেই ট্রেইড-অফ।
কিন্তু কতটা? দেশের সেরা অভিনেত্রীর বড় দেশে গিয়ে দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারিতে নেমে যাওয়া? ওদেশে নাকি বাংলাদেশীদের খুব কদর দারুণ আদর, অথচ স্টেডিয়ামে খেলা দেখার সময় সবাই বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ওদের ছয় দশকের শত্রুকেই সমর্থন করলো! জাতীয় জীবনের প্রধান ঘটনা যদি হয় ক্রিকেট ম্যাচ, দেশের ভাগ্য বলের মতো হলে অবাক হওয়ার উপায় থাকেনা। পরিবর্তন ব্যাটে-বলে আসে না, তাও মাত্র আট-দশটা দেশেই যে খেলার পদচারণা। আমরা বারবার ঘোল খাই, তবু খেলি, তার ব্যপ্তি বাড়িয়ে – ক্রিকেট, বাণিজ্য, রাজনীতি। ওরা চারপেয়ে গরুকে রাষ্ট্রমাতা করার জন্য জান দেয়, আমরা ওদের সাথে জাল পেতে খেলি।
খেলার পর পরিবেশ আসে। শহরের কেন্দ্রপ্রায় থেকে ট্যানারিগুলো সরিয়ে নেবার কঠোর নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে! দু’দশকে যে কাজ হয়নি, তা দু’দিনে হবে! এরা সব বিত্তশালী, আমার শ্বশুর প্রজাতির। দেশ যাদের দুহাত ভরে দেয়, দেশের বুকে কুঠোর মারা তাদের অধিকার। ঢাকার বাতাস আর মরা বুড়িগঙ্গার পানির মূল্য সুপার-নরমাল প্রফিটের চেয়ে বেশি? নীতিনির্ধারকরা একটু আধটু ধমকাবেই, ব্যবসা করতে গেলে সব মেনে, মানিয়ে, বাঁকিয়ে চলতে হয়।
কোন এক নেতা হৃদরোগাক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। আহ্, যদি না বাঁচতো! এরা মরে না, মরে আমার বাবা, বুকে ব্যথা নিয়ে ঢাকা আসতে আসতে শেষ। বাবা-মা গ্রামেই থাকত। ঢাকা ওদের পছন্দ করে না, ঢাকায় ওদের মানায় না, শেকড়-ছেঁড়া গাছের মত নুইয়ে যায়। আমি মাসে দু’একবার গাড়ি নিয়ে তিন ঘন্টার পথ বেড়িয়ে আমার অজ পাড়াগাঁয়ে যাই। হাতেম আলির ছেলের শোহরৎ সবাই দেখে, তার বুক ফুলে যায়। ঢাকায় এরকম ছেলে বা বাবার অভাব নেই, এখানে গৌরবেরও তাই কিছু নেই। এখন বাবা নেই, মা আছেন। বাজারের সবচেয়ে দামী, চকচকে টিন দিয়ে বাড়ি করে দিয়েছি যেন সবার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মা বলে ঘরে গরম বেশি, আমি বলি ট্রেইড-অফ – সব একসাথে পাওয়া যায় না। মা না বুঝেও বুঝে, স্বার্থপর যৌক্তিক মানুষ আমরা সবাই। ছেলের বউ যত্ন করে না, খোঁজ-খবর নেয় না, মেনে তো নিয়েছে।
বাসার কাজের লোক নেই, সব কাজ দীবাকেই করতে হয়। এক ষোড়শী বা অষ্টাদশীকে রেখেছিলাম – আমাদের দু’জনের ব্যবহারই বদলে গিয়েছিল। আমি হয়ে উঠেছিলাম সুযোগসন্ধানী আর দীবা সন্দেহপ্রবণ। মেতে উঠেছিলাম এক মনস্তাত্ত্বিক খেলায় যার অবসান হয়েছিল পরিচারিকাটিকে বিদায়ের মাধ্যমে। তারপর রেখেছিলাম আট বা ন’ বছর বয়সের এক শিশুকে এবং আবারো বদলে গিয়েছিলাম আমরা। দীবা ফিরে গিয়েছিল ক্রীতদাস প্রথার যুগে আর আমি অবতীর্ণ হয়েছিলাম ত্রাণকর্তার ভূমিকায়, ষোড়শীবিদায়ের ঝাল মেটাতে বা আসলেই শিশুটিকে রক্ষা করতে। আমাদের লড়াই শেষ হয়েছিল মেয়েটির বাবাকে ডেকে তার হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে। নিজেদের আমরা কেউ বদলাতে পারিনি, কাজের লোক রাখার আয়েশটা তাই ছেড়ে দিতে হয়েছে।
মেয়ের ঘুম-ভাঙা কান্নার শব্দ পেলাম। একটু পরেই ওকে কোলে নিয়ে দীবা এলো আমার ঘরে, সদ্য ঘুম-ঝরা মুখটা ফুটে আছে ফুলের মতো। আমার পাশে, খাটের ভেতরের দিকে ওকে বসিয়ে দিল দীবা।
‘একটু দেখো, মাছ কুটতে হবে’
‘আমার মা-মনিটার ঘুম ভাঙল!’ আদর-মাখা গলায় বললাম।
ইচ্ছে হল মেয়েটাকে বুকের উপর বসিয়ে আদর করি, দেহ সেই সামর্থ্য জড়ো করতে পারল না। মেয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল, বাবার দিকে তাকায়, টিভির দিকে তাকায়, মা’র চলে যাওয়া দরজার দিকে তাকায়, আবার টিভির দিকে তাকায়। টলটল অস্থির চোখে বাবার দিকে তাকায়।
‘মোতু পাতলু দেক্বো’
ফুরফুরি নগর নামক এক কাল্পনিক শহরের ‘মোটু’ আর ‘পাতলু’ নামের দুই বন্ধুর কাহিনী নিয়ে বানানো এই কার্টুন। মেয়েটা এই সিরিজের এতটাই ভক্ত যে আমাকে ডাকে মোটু আর দীবাকে পাতলু – মেনে নিতে একটু কষ্টই লেগেছিল। ও আর কী বোঝে! নিখুঁতা দীবার পাশে একটু মোটা তো আমাকে লাগেই। চ্যানেল ঘুরিয়ে কার্টুনে দিতেই ঘুম-ফোলা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। সুপ্তির পুরো মনোযোগ টিভির দিকে আর আমার দু’চোখ সুপ্তির দিকে – আমাদের প্রথম এবং শেষ সন্তান। সন্ধ্যার পর সন্ধ্যা বা অনেক রাতের নির্ঘুম প্রথম প্রহর শেষে, যুক্তি-তর্ক-মান-অভিমান-ছলনার ধোঁয়াটে পথ পেরিয়ে এই সিদ্ধান্ত। সন্তান জন্মানোতে বাহাদুরি নেই, আছে মানুষ করায়। বাচ্চারা আজকাল অনেক ইক্সপেন্সিভ – সে টাকা হোক বা সময় হোক, আগের মত গন্ডায় গন্ডায় নেয়া যায়না।
কেমন হবে আমার আত্মজা? নিশ্চিতভাবেই কোনো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়বে, হয়তো ভুল উচ্চারণে ‘শুদ্ধ বাংলা’ বলবে, দেশের বাইরে আন্ডারগ্র্যাড করতে যাবে, হয়তো ফিরবে বা ফিরবে না, জীবনসঙ্গী বেছে নেবে ওর পছন্দমতো, ভাগ্যবান হলে অনুষ্ঠানের শোভাবৃদ্ধির কাজে লাগতে পারি। আমরাও কি তা চাই না? কী আছে এদেশে, এখানে?
‘যেওনা মা, ওদিকে যেও না’ সুপ্তি আমার উরু খামচে ধরে তার উপর উঠছে।
‘পাতলু যাবো’
‘ওই যে দেখো টিভিতে দেখাচ্ছে মোটু-পাতলু’
‘পাতলু যাবো’ মা’র কথা মনে হয়েছে, এখন ওকে কোনো কিছুতেই আটকানো যাবে না।
বিপজ্জনকভাবে আমার উরুর উপর উঠে গেছে সুপ্তি। কোমর বা শরীরের যেটুকু নাড়াতে পারছি, তাতে কাজ হচ্ছে না। এক হাতে খাটের প্রান্ত বরাবর পড়ে থাকা বাবার পায়ের হাঁটুতে ভর দিয়ে আরেক হাত তুলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। চেষ্টা করেও হাত তুলে ওকে ধরতে পারছি না। চিৎকার করে দীবাকে ডাকলাম। চিৎকার শুনেই বোধ করি হাঁটু থেকে মেয়েটার হাত ছুটে গেল। মাথাটা খাট থেকে ঝুলে আছে, পড়ে যাচ্ছে আমার মেয়েটা। ওইটুকুন মাথা ফ্লোরে লাগলে কি আর বাঁচবে? কী হল জানিনা, কীভাবে হল জানিনা, শুধু জানি মেয়েকে আমার বাঁচাতে হবে। গায়ের সমস্ত শক্তি এক করে হাত বাড়ালাম। ফ্লোরের কয়েক ইঞ্চি উপরে মাথা থাকা অবস্থায় ওর একটা পা ধরে ফেললাম, টেনে তুলে আনলাম আমার বুকে, দু’হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে।
নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। আমি বিছানায় বসে সুপ্তিকে দু’হাত দিয়ে ধরে আছি, অথচ সকাল থেকেই লক্ড ইন হয়ে ছিলাম, হাতপা নাড়ানোর শক্তি ছিল না। আসলেই জোর ছিল না, নাকি ইচ্ছে ছিল না? আমি কি সত্যিই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অসাড় পড়েছিলাম, নাকি তা ছিল কেবলি দায়িত্ব এড়ানোর বা কিছু না করার ভান? সত্যিই কি আমি ওষুধ খেয়েছি? নাকি খাইনি? বড়ির পাতাটা যদি কেউ গুনে দেখতো!
মার্চ-জুন, ২০১৬ ইং
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৩৬