১৯৫৫ সাল। ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অনুষ্ঠান। ট্যাক্সি ড্রাইভার সিনেমার 'যায়ে তো যায়ে কাহা' গানটির জন্য সেরা সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কারটি হাতে তুলে নিলেন শচীন দেব বর্মন (তখন পুরো সিনেমা নয়, সেরা গানের জন্য পুরস্কার দেয়া হতো)। প্রায় ৮ বছর ধরে পেছনে থাকার পর প্রথম সারির কম্পোজারদের কাতারে উঠে এলেন শচীন কর্তা। একটা প্রশ্ন রয়েই গেল, কারণ গানটির সুর একটি রবীন্দ্র সঙ্গীত 'হে ক্ষণিকের অতিথি' থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। নকল গানের জন্য সেরা সঙ্গীতকারের পুরস্কার পেলেন শচীন দেব। এটাই প্রথম নয়, তিনি তার দ্বিতীয় ফিল্মফেয়ারটি পেলেন অভিমান (১৯৭৩) এর জন্য। এর সবচেয়ে জনপ্রিয় গান 'তেরে মেরে মিলন কি এ র্যায়না' একটি রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুরে সাজানো। এই লেখায় শচীন দেব বর্মনের ব্যাপারে প্রচলিত কিছু মিথ ভাঙ্গার চেষ্টা করবো। গায়ক শচীন দেবের ব্যাপারে আলোচনা এটি নয়, এ লেখার আলোকপাত 'হিন্দী ফিল্মি কম্পোজার' শচীন দেবের উপর।
ফিল্ম সঙ্গীতের দুটো ভাগ - গান এবং নেপথ্য সঙ্গীত। দ্বিতীয় ভাগটিতে শচীন কর্তার পারফরম্যন্স মোটেও বলার মতো নয়।
অর্কেষ্ট্রেশনে তার দুর্বলতা চোখে পড়বার মতো। এতটাই যে, চল্লিশের শেষের দিকে কোন এক সিনেমাতে কর্তার সঙ্গীতায়োজন করে দিয়েছিলেন সি রামচন্দ্র। পরে এই দুর্বলতা তিনি কাটিয়েছিলেন বেশ কিছু ভালো সহকারী দিয়ে। তবে বরাবরই এদিকে তার নজর কম ছিল। তাছাড়া তার দুর্বল স্বাস্থ্যও একটা বড় কারণ বলে মনে হয়।
একজন কম্পোজারের একটা সিগনেচার থাকে। তার কোন কাজ শুনলেই বুঝা যায় এটার স্রষ্টা কে। শচীন কর্তার ক্ষেত্রে সেটা পাওয়া যায় না। অথার থিওরি প্রয়োগ করা হলে মুম্বাইয়ের প্রথম সারির কম্পোজারদের মধ্যে কেবল তিনিই উৎরাতে ব্যর্থ হন। এটা তার ভেরিয়েশনের কারণে নয়, অনুকরণপ্রিয়তার কারণে।
অনেক বেশি কাজ সহকারীরা করে দিতো। অনেকেই বলে গাইড সিনেমার কয়েকটি গান সহকারী জয়দেবের করা (এরকম একটা রিউমার শোনা গিয়েছিল)। তেরে মেরে সাপ্নে বা দিন ঢল যায়ে - এরকমের গান শচীন আগে বা পরে কখনো করেননি। সমসাময়িক সময়ে করা জয়দেবের গানগুলো শুনলে বরং অনেক বেশি মিল পাওয়া যায়। সহকারীদের তিনি সিনেমা হলে পাঠাতেন ইংরেজি সিনেমা থেকে সুর তুলে আনতে।
ছেলে রাহুল দেব ১৯৫৭ সাল থেকে বাবার সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। সঙ্গীতায়জনে তার প্রভাব ছিল ব্যাপক, শচীনের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাবার কাজে সাহায্য করেছেন। আরাধনার 'বাগো মে বাহার হ্যায়' এবং 'গুনগুনা রাহি হ্যায় ভমর' গানদুটোই কেবল কর্তার করা। বাকীগুলো রাহুল দেবের করা। স্ত্রী মীরা দেব কিছু সুরে সাহায্য করেন কর্তাকে।
বিমল রায়ের দেবদাস (১৯৫৫) মুভিটির প্রথম পছন্দ কর্তা ছিলেন না। সে সময় শীর্ষে থাকা কম্পোজার নওশাদের রেট তখন এক লাখ দশ হাজার রুপি। তিনি এটা কমাতে রাজী না হলে, বাংগালী বিমল কর্তার কাছে আসেন। কর্তার রেট তখন পঁচিশ হাজার রুপি! শঙ্কর জয়কীষান, ও পি নাইয়ার, সি রামচন্দ্র - এরা সবাই কর্তার সামনে ছিলেন, পেছনে নয়। শচীন দেব কখনোই ১ নম্বর হতে পারেননি। ১৯৩৭-১৯৪৪ অনিল বিশ্বাস, ১৯৪৪-১৯৬৩ নওশাদ (শেষের কয়েক বছর তিনি ইঁদুর দৌড়ে ছিলেন না কারণ এত কম মুভি করতেন যে বছরে গড়ে একটাও এ্যালবাম বেরুতোনা), ১৯৬৩-১৯৬৯ শঙ্কর জয়কীষাণ, ১৯৭০-৭৫ রাহুল দেব বর্মন, ১৯৭৬-১৯৯১ লক্ষীকান্ত পেয়ারেলাল (এ আর রেহমান, নাদিম-শ্রাবণদের আগ পর্যন্ত) মুম্বাইয়ের শীর্ষ কম্পোজার ছিলেন।
রফি, লতা, আশা, মুকেশ, তালাত - এদের কাউকেই গড়ে তুলবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না তিনি। কিশোরের জন্য ছিলেন, শুরুতে গীতার জন্য ছিলেন।
নিচে শচীন দেব বর্মনের নকল গানগুলো দেয়া হলো লিঙ্কসহ (প্রথমে কর্তার গান, পরে মূল সুর)। ইন্টারনেটে বিভিন্ন সূত্র এবং ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে ১৯ টি গান। এর বাইরেও আছে, কিন্তু তখনকার ওয়ার্ল্ড মিউজিকের কতটাই বা এখন জানা সম্ভব!
১। তেরে মেরে মিলন কি এ র্যা য়না
যদি তারে নাই চিনি গো সেকি
২। ন্যায়না দিওয়ানে (১৯৫০)
সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে
৩। যায়ে তো যায়ে কাহা
হে ক্ষণিকের অতিথি
৪। জীবন কে সফর মে রাহি
মেক্সিকান হ্যাট ড্যান্স
৫। এক লাড়কী ভিগি ভাগি সি
সিক্সটিন টন্স
৬। ইয়ে দিল না হোতা বেচারা
মার্চ (দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই) । এই সুরে রাহুল দেবেরও অবদান আছে।
৭। সালা ম্যায় তো সাহাব বান গায়া
চেল্লা লা
৮। পুছো না ক্যায়সে ম্যায়নে
অরুনকান্তি কেগো যোগী ভিখারি
৯। মেরা সুন্দর সাপ্না বীত গায়া (১৯৪৭)
রোদন ভরা এ বসন্ত
১০। জ্বলতে হ্যায় যিসকে লিয়ে
একদা তুমি প্রিয়ে
১১। মেঘা ছায়ে আধি রাত
লহ লহ তুলে
১২। ইয়ে তানহায়ি হায় রে হায়
তোরা যে যা বলিস ভাই
১৩। আল্লাহ মেঘ দে পানি দে
আল্লাহ মেঘ দে পানি দে
১৪। চাহে কয়ি খুশ হো (ট্যাক্সি ড্রাইভার, ১৯৫৪)
তারানতেল্লা
১৫। হাম থে ও থি
ওয়াটার মেলন সং
১৬। ইয়ে ভি কয়ি রুঠ নে কা
ইয়ে ঘযায়েল
১৭। ইয়ে চান্দা রুস কা
আল বিন্ত এল শালাবিয়া
১৮। চান্দ ফির নিকলা
রসিক বালমা
১৯। গুনগুনা রাহি হ্যায় ভমর
সংকোচের বিহ্বলতায়
২০। পিঘলা হে সোনা (জাল, ১৯৫২)
ইউ আর মাই সানশাইন
২১। আরাধনার রুপ তেরা মাস্তানা একটি ত্রিপুরা-লোকগীতি থেকে নেয়া। (সুরটির প্রস্তাবক ছিলেন রাহুল দেব বর্মন এবং উত্থাপক কিশোর কুমার। কর্তার মূল সুরটি ছিল ভাটিয়ালির)
২২। রাহুল দেবের আজা পিয়া তোহে পেয়ার দো (বাহারো কি সাপ্নে, ১৯৬৭) গানটি শচীন দেবের 'তিন দেবিয়া' সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড সুর থেকে নেয়া। তবে প্রভাবের ব্যাপারটা বোধ হয় উলটো, কারণ এই সিনেমায় আরডিবি সহকারী সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে কাজ করেন। তাছাড়া 'তিন দেবীয়া'-র বেশ কয়েকটি গানে শচীনের অবদান নিয়ে প্রশ্ন আছে। খাব হো তুম কয়ি নেহি হো (তিন দেবিয়া, ১৯৬৫) গানটির সাথে পেয়ার দিওয়ানা হোতা হে মাস্তানা হোতা হ্যায় (কটি পতংগ, ১৯৭০) গানটির যথেষ্ঠ মিল আছে - এবং সেটা পঞ্চমের (আরডিবি-র ডাক নাম) কারণেই।
২৩। এ মেরে টোপি পলটকে আ (ফান্টুশ, ১৯৫৬) এর টিউন রাহুল দেবের করা। শচীন ছেলেতে গাইতে শুনে সেটা ব্যবহার করেন।
২৪। সার যো তেরা চকরায়ে (পিয়াসা, ১৯৫৭) গানটি রাহুল দেব বর্মনের করা। রাহুল তখন বাবার সহকারী। এটা তার প্রথম কম্পোজিশন।
২৫। অ্যায়সে তো না দেখো (তিন দেবীয়া, ১৯৬৫)
আমি তোমায় যত শুনিয়ে ছিলেম গান
২৬। আঁখো মে কেয়া জি (ন দো গেয়ারা, ১৯৫৭)। এটাকে অনেকেই রাহুল দেবের কম্পোজিশন মনে করে। এর কিছু অংশ পরে রাহুল দেব তার ১৯৭০ এর দ্য ট্রেন মুভির একটি গানে ব্যবহার করেন।
২৮। রাত আকেলি হে (জুয়েল থীফ, ১৯৬৭) গানটি কতটা শচীনের, কতটা রাহুলের সে ব্যাপারে ভিন্ন মত আছে।
২৯-৩২। তেরে মেরে সাপ্নে (গাইড, ১৯৬৫), দিন ঢল যায়ে (গাইড, ১৯৬৫), কাহি বেখায়াল হো কার (তিন দেবীয়া, ১৯৬৫), হাম বেখুদি মে (কালাপানি, ১৯৫৮)। অনেকের মতেই প্রথম তিনটি গান শচীনের সহকারী জয়দেব - এর করা। এই গানগুলোর সাথে জয়দেবের সমসাময়িক কম্পোজিশনের মিল আছে। জয়দেবের উত্তরাধীকারীরাও এরকম দাবী করেছেন। শেষ গানটির কাহিনী এরকম - একদিন জয়দেব একটি সুর ভাজছিলেন, কর্তা শুনে জানতে চাইলেন কী গান। জয়দেব বললেন প্রচলিত। কর্তা জয়দেবকে বলেই এই সুরে একটি বাংলা গান করলেন। তারপর সেই সুরে হিন্দী গানটি করেন।
## জিদ্দী (১৯৬৪)-র মান্না দে'র গাওয়া 'পেয়ার কি আগ মে' র ৩ঃ৩৭-৩ঃ৪৫ পর্যন্ত শুনুন, 'কাম সেপ্টেম্বার (১৯৬১)'-র থিম সং বাজাচ্ছেন শচীন। একই সুরে ত্রিশ বছর পর নাদিম শ্রাবণ 'রাজা' সিনেমা'র 'নজরে মিলি' গানটি বাঁধেন। কর্তার এখান থেকে, ওখান থেকে গান টোকার অভ্যাস নিয়ে আনন্দলোক পত্রিকায় খোলাখুলি কথা বলেছিলেন মান্নাদে।
বিবিসি-র ২০১৩ সালের জরিপে সেরা ১০০ বলিউড গানের তালিকায় শচীনের ৭টি গান স্থান পায় তার মধ্যে রুপ তেরা মাস্তানা এবং হোতো পে অ্যায়সি বাত আছে। এ দুটি গানে রাহুল দেব বর্মনের প্রভাবের কথা আগেই বলা হয়েছে। আউটলুক ম্যাগাজিনের ২০০৬ সালের সর্বকালের সেরা বিশ হিন্দী গানের তালিকায় শচীনের ৫টি গান স্থান পায়। তার মধ্যে একটি নকল (পুছোনা ক্যায়সে ম্যায়নে) এবং দু'টি অনেকের মতেই জয়দেবের করা (গাইড সিনেমার তেরে মেরে সাপ্নে এবং দিন ঢল যায়ে)।
প্রীতমের নাম শুনলেই লোকজন বলে উঠে চোর। কিংবা আনু মালিকের নাম শুনলেও। এখন সময় বদলেছে, ইন্টারনেটের কল্যাণে খুব সহজেই টিউন লিফটিং ধরে ফেলা যায়। কয়েক দশক আগে এটা ভাবাও যেতোনা। আর এর পুরো সুযোগ নিয়েছেন সেই সময়ের অনেক কম্পোজার বিশেষ করে - রাহুল দেব বর্মন,নাদিম-শ্রাবণ, রাজেশ রোশন, আন্নু মালিক, যতিন-ললিত, বাপি লাহিড়ী, লক্ষীকান্ত পেয়ারেলাল, শচীন দেব বর্মন, শঙ্কর-জয়কীষান প্রমুখ। নতুন সুর বানানোর চেয়ে এদের দক্ষতা বেশি ছিল অন্যের সুরকে পরিবর্তিত করে পরিবেশন করায়।
সবশেষে একটা কথা, 'বাঙ্গালী বলেই শচীন কর্তার ব্যাপারে বাড়িয়ে বলা' - এই অভ্যাসটা ছাড়তে হবে।
তথ্যসূত্রঃ
১। ইন্টারনেট
২। বিবিধ ভারতীতে অনিল বিশ্বাসের অনুষ্ঠানের ট্রান্সক্রিপ্ট
৩। R. D. Burman: The Man, The Music By Anirudha Bhattacharjee Balaji Vittal
৪। Behind the curtain : making music in Mumbai’s film studios By Gregory D. Booth
৬। 20 Best Hindi Film Songs Ever
৭। BBC 100 Greatest Bollywood Songs
৮। Naushadnama: The Life and Music of Naushad By Raju Bharatan
৯। ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ১০:৩৭