আহারে, আজ এই দিনে কত কত সোনার সন্তানকে হত্যা করেছে জঘন্য নিকৃষ্ট অমানুষ জানোয়াররা। আজ কেন এত বেশি কষ্ট হচ্ছে আমাদের?
একজন মহান মানুষকে ওরা ধরে নিয়ে যায়,
জঘন্য কুৎসিত পিশাচের বিশ্রী নোংড়া হাত স্পর্শ করে একেকটি উদার শরীর। একেকজন জীবন্ত সম্ভাবনাকে নিমিষেই ওরা ধ্বংশ করে দেয়। একেকজন ভালো মানুষকে ঘাতকরা তাদের নোংড়া পায়ে পিষ্ট করে। মহান সুরস্রষ্টা কে তারা এই ভাবে হত্যা করে, যে ভাবে একটি হিংস্র নেকড়ে ঝাঁপিয়ে পরে কোমলতার গায়ে। ১৯৭১ এর এই সময়ে, নির্মম পাষন্ড রাক্ষসরা উল্লাসে মেতে হত্যা করতে থাকে একেকটি সূর্যকে। একজন লেখকের কলমকে তারা থামিয়ে দেয়, আহারে!! সেই কলমের আঁচরে না জানি কি ফুল ঝরে পড়ত সোনার খাতায়!!!
কুচক্রী শয়তানরা খুঁজে বের করে দেশের প্রতিটি সূর্য-সন্তানকে। শয়তানরা সোনার মানুষদের খুঁজে পায়, কারন, সূর্য-সন্তানরা সবসময় আলোকিত, উজ্জ্বল আর প্রকাশিত। একজন স্বাপ্নিককে রাজাকার-আল বদর-আল শামস্ নামক কুৎসিত জঘন্য হন্তারকরা নির্দ্বিধায় গুলি করে হত্যা করে। দেশকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিতে রাজাকারদের অনাবিল আনন্দ হয়েছিল, দেঁতো হাসি হেসে ছিল পাকিস্তানী জানোয়াররা। অমানুষ গুলো বুঝেছিল, জেনে ছিল, আবিষ্কার করেছিল যে, একটি দেশকে পঙ্গু করে দিতে চাইলে সে দেশের সূর্য-সন্তানদের হত্যা করতে হবে!
আহারে আহারে আহারে...
আজ আমার সোনার বাংলা অনেক বেশী সোনার বাংলা থাকতো সূর্য-সন্তানরা বেঁচে থাকলে। আমরা সবকিছুতে আরো বেশী বেশী "ভালো" পেতাম।
প্রতিটি মানুষের জীবন মূল্যবান। অমানুষরা জীবনকে ভালবাসেনা (হয়তো বাসতে জানেও না)। যারা মানুষের জীবনকে সুন্দর করতে চায়, চেয়েছিলেন...অমানুষরা তাদেরকে সহ্য করতে পারে না। আমানুষরা চায় দেশ পঙ্গু হয়ে যাক, দেশ মরে যাক, মরে যাক দেশের মানুষগুলো। একাত্তরে তাই অমানুষরা ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষকে হত্যা করতে। একাত্তরে অমানুষরা রক্তকমল ছিড়ে পায়ে পিষ্ট করে, এমনকি তারা ফুলের চেয়েও কোমল সুন্দর নিষ্কলুষ শিশুটিকেও হত্যা করতে দ্বিধা করেনি। আজ সোনার মানুষগুলো বেঁচে থাকলে আমরা বাংলাদেশকে আলোয় উদ্ভাসিত করতে পারতাম। আহারে, আমার সোনার বাংলার বঞ্চিত ত্যাগী সূর্য-সন্তানেরা...তোমরা আমাদের ভালবাসা জেনো অনন্ত কাল ধরে।
আহারে, আমার ভোলা ভালা শিক্ষক বাবামনি! তোমাকে ওরা কোথায় নিয়ে গেল? তুমি কোথায় আছো আজ? মা তোমার পথচেয়ে বসে আছে যুগ যুগ ধরে। ছোট্ট বোনটি তখন অনেক ছোট, তোমাকে বাবা বলে ডাকতে পারেনি কোনদিন। ও এতো বড় হবার পরও জানে না "বাবা" শব্দটার মানে। ওর বুকে সবসময় হু হু করে বয়ে যায় হাহাকারের তীব্র বাতাসের করাত।
আহারে আমার পৃথিবীর চেয়েও প্রিয় প্রেমিক! তুমি কেন আমাকে স্বপ্ন সুখের ছোঁয়া দিয়ে হারিয়ে গেলে হঠাৎ? আমি যে তোমার দেওয়া তীব্র ভালবাসাকে বুকে পুষে এক অনন্ত বিষাদের পৃথিবীর পথে পথে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। তুমি মানুষকে আলো দিতে বলে ওরা তোমাকে হত্যা করেছে? নাকি তোমাকে ওরা কোথাও লুকিয়ে রেখেছে? তুমি কি ফিরে আসবে!!
আহারে আমার, বুকের মানিক, আমার হৃদয়ের টিয়া, আমার আকাশের চাঁদমনি মেয়েটি! ওকে বর্বররা নিঃশেষ করে দিল। এরপর থেকে আমি আর বেঁচে নেই এই পৃথিবীতে। এরপর থেকে আমার হৃদয় স্থবির হয়ে আছে!!! আমি হাহাকারের মহাসমুদ্রে ডুবে আছি।
মুক্তিযুদ্ধে সকল বাংলাপ্রেমীর মহান আত্মত্যাগ আমাদের বাংলাদেশ এনে দিয়েছে। আমার হৃদয় সেইসব ত্যাগী মানুষদের জন্য কেন জানি আকুল হয়ে থাকে। তারা কেমন ছিলেন! তাদের সাথে কথা বলতে পারলে আমার অনেক অনেক অনেক ভালোলাগতো। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ানক রকম ভালবাসি! একজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে কথা বলার সময় আমি আমার আবেগকে কখনই ধরে রাখতে পারি না। একজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে দেখা হলে আমি তাকে ভাল করে দেখি, চোখ ভরে দেখি, বুক ভরে দেখি। আমার স্বপ্ন, আমি আমার প্রিয় মানুষকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশদের প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার কাছে গিয়ে আমার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসব, আমার গভীর ভালবাসার কথা বলে আসব, আমাদের প্রেমের কথা বলব, আমাদের স্বপ্নের কথা বলব, আমাদের সংগ্রামের কথা বলব।
আহারে! মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স হয়ে গেছে! প্রকৃতির নিয়মেই তাদের অনেকে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন, যাঁরা এখনো বেঁচে আছেন, তাদের অনেকেই অনেক কষ্টে দিন যাপন করছেন। কয়েক বছর পর হয়তো তাদের অনেকেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন একবুক অভিমান নিয়ে। আমরা অনেক লজ্জিত যে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের কিছুই দিতে পারিনি। এই কষ্ট আমাদের অনেক অনেক কষ্ট দেয়।
মুক্তিযোদ্ধা সোনা মানিকেরা, মায়ের জন্য প্রান উৎসর্গকারী সূর্য-সন্তানেরা, ১৯৭১ এ নিহত অমর মানুষেরা, ১৯৭২ এ হারিয়ে যাওয়া আলোকিত জীবনেরা, আমাদের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় জীবন দানকারী অগ্রপথিকেরা... ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ হারিয়ে যাওয়া আমাদের ভাই, আমাদের পিতা, আমাদের প্রেমী, আমাদের সন্তান, আমাদের বোন... তোমরা আমাদের ভালবাসা নিও। তোমাদের অনেক অনেক অনেক অনেক অনেক অনেক অনেক বেশী ভালবাসি।