সবাই বড্ড সাহসী অথবা ভীতু হয়ে গেছে। প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল-কুশীল-সুশীল সবাই। কেউ কেউ মরনে ভয় পায় না। অনেকেই দেশের জন্য মরতে প্রস্তুত। অনেকে আবার তাদের ধর্ম-পুঁজিকরা দলকে বাঁচাতে মরিয়া। জামায়াত-শিবির যেসব শিশুদের মিছিলের সামনে রাখছে সেসব শিশু নিশ্চয়ই বোঝেনা তারা কি করছে। এভাবেই জামায়াত-শিবির শিশুদের মগজ ধোলাই করে নিজেদের স্বার্থে "শিশুদের" কাজে লাগাচ্ছে। মগজ ধোলাই কি পরিমান "কড়া" হলে শিশুরা উদ্বুদ্ধ হয় এরকম সহিংসতায়!!! এইসব শিশুদের পিতা মাতাও হয়তো জামায়াত-শিবিরের কর্মী/নেতা/মগজ ধোলাইয়ের শিকার।
কয়েকটি ব্যাপার অবাক করেঃ
শাহবাগ এর গনজাগরণকে ঘিরে "নাস্তিক/আস্তিক" রটনার পর থেকে দেখছি গনজাগরণ সমর্থক পেইজ গুলো বড় বেশী ধর্ম ঘেষা হয়ে গেছে। ধর্ম ধর্মের জায়গাতেই থাকবে। আন্দোলনেও শুরুর সময় কোরআন পাঠ, গীতা পাঠ, ত্রিপিটক, বাইবেল পাঠ হচ্ছে ঘটা করে। আজানের সময় মাইক বন্ধ রাখার ব্যাপারটা ঠিক আছে। প্রত্যেক ধর্মই সমান সম্মান পাবার যোগ্য। এই আন্দোলন মুসলমানদের একার আন্দোলন নয়। এই আন্দোলনে সকল ধর্মের মানুষ রয়েছে। অনেক নাস্তিক মানুষও এই আন্দোলনে রয়েছেন। আন্দোলনে কেউ ধর্ম প্রচার করতে আসেনি অথবা নাস্তিকতা প্রচার করতেও আসেনি। দেশের টানে যেসব মানুষ সংগ্রাম করছে তাদের একটি পরিচয় “বাংলাদেশী”। আমরা কি নিজেদের আস্তিক প্রমানের জন্য উঠে পরে লেগেছি?
আস্তিক হওয়া মানে যে শুধু “ইসলাম” বিশ্বাস করাই নয় এটা সবাই হয়তো জানি। পৃথিবীতে যতো ধর্ম রয়েছে, যতো ধর্মে পরম শক্তি/সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে, সেই সকল ধর্মের সকল অনুসারীরাই “আস্তিক”। ধর্মে বিশ্বাস অথবা অবিশ্বাস মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার।
কেউ যদি অন্যের ধর্মকে প্রকাশ্যে অপমান করে, অন্য ধর্মাবলম্বীদের নির্যাতন করে, তাহলে সেটা চরম অপরাধ এবং সেই অপরাধীদের শাস্তি প্রাপ্য। এটা অনেক শুভ খবর যে এসব অপরাধ প্রতিহত করতে মানুষ দলবদ্ধ হচ্ছে।
ধর্ম মানুষকে বিভক্ত করতে পারে না। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই ভিন্ন। ভিন্ন রুচির দিক হতে, আদর্শের দিক হতে, আচরনের দিক হতে। তারপরও সবাই এক, সবাই মানুষ। যারা অমানুষ তারা ছাড়া সবাই মানুষ। আচরনই মানুষের পরিচয়ের একমাত্র বৈশিষ্ট্য। আমাদের মানুষ হতে ভয় পেলে চলবে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, সবসময় মানুষ থাকাই মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্ম।
আমার বন্ধুদের মধ্যে বৌদ্ধ খ্রীস্টান হিন্দু মুসলমান নাস্তিক, চাকমা মারমা বাঙ্গালী... সবাই রয়েছে। তাদের অনেকেই অসংখ্য ত্রুটি যুক্ত, অনেকেই নৈতিক দিক থেকে ভীষন ভালো। আমার কখনো মনে হয় নি আমার বন্ধুদের মাঝে কেউ সংখ্যা লঘু। তারা সবাই মানুষ, তারা সবাই বন্ধু, তারা সবাই বাংলাদেশি। “সংখ্যা লঘু” শব্দটা আমাকে অনেক আহত করে, অবাক করে। ধর্ম ভাষা সংস্কৃতির দিক দিয়ে ভিন্ন হলেও আমরা সকলেই বাংলাদেশের নাগরিক, আমরা সকলেই মানুষ। সংখ্যা লঘু যদি কেউ থেকেই থাকে তবে তারা হল সেইসব অমানুষ যারা “মানবতার” বিরুদ্ধে। কোন ধর্মের বর্নের গোত্রের মানুষরা সংখ্যা লঘু নয়। অমানুষরাই “সংখ্যা লঘু”। আমি মানুষ হিসেবে কোন পার্থক্য খুঁজে পাইনা আমার অন্য ধর্মের বন্ধুদের সাথে। তাই আমার জানা কোন ধর্ম গোত্র বা সংস্কৃতির মানুষরা সংখ্যা লঘু নয়, সংখ্যা লঘু হতে পারে না, কারন আমাদের সবার একই পরিচয়, আমরা মানুষ, আমরা বাংলাদেশী, আমরা এই পৃথিবীর।
আজ যারা মুসলমান পরিবারের সন্তান, তারা বড্ড বাঁচা বেচে গেছে? মুসলমানদের মসজিদ ভাঙ্গা হচ্ছে না, রাত জেগে পাহারায় থাকতে হচ্ছে না! আজ আমাদের পরিচয় হোক আমরা মানুষ। মন্দির ভাঙ্গা মানে আমাদের সবার অপমান, মসজিদে আগুন দেওয়া মানে আমাদের সবার বিপর্যয়, শহীদ মিনার ভাঙ্গা মানে আমাদের সবথেকে ভালবাসার-শ্রদ্ধার বিষয়কে তীব্র অপমানের চেষ্টা, জাতীয় পতাকা ছিড়ে ফেলা-পোড়ানো মানে আমাদের সবথেকে মহৎ অর্জনকে ধর্ষন করা। সত্যি বলছি আজ আমার সবচেয়ে বেশী ঘৃনা জাগছে “অমানুষ জামায়াত-শিবিরের” কার্যকলাপ দেখে। এই জামায়াত ১৯৭১ সালেও ঠিক একই ভাবে তাদের পৈশাচিক কাজ-কর্ম সম্পাদন করেছে। সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতি সৃষ্টি করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে জামায়াতে ইসলাম নামক নরপশুদের দল। তাদের সাথে যারা তাল মিলাচ্ছে, যারা সহযোগীতা করছে, পক্ষ নিয়ে কথা বলছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যারা নিজেদের শেষ সম্মানটুকু বেঁচে দিয়েছে তাদের প্রতি আমার চির ধিক্কার ও ঘৃনার থু থু। থু থু থু!!!!
আমি কোন রাজনৈতিক দলের কর্মী বা নেতা নই। আমি এদেশের নাগরিক। আমি একজন ভোটার। আমার মতো হাজারো মানুষের ভোটেই সংসদ গঠিত হয়, সরকার গঠিত হয়। আমরা যেন কোন দলের প্রলোভনে প্রভাবিত হয়ে প্রতারিত না হই, এজন্য আমাদের সজাগ থাকতে হবে। বিএনপি/ আওয়ামীলীগ/জাতীয় পার্টি এই তিনটি দল বাংলাদেশে সরকার গঠন করেছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন উপায়ে তারা দেশ চালানোর দায়িত্ব পেয়েছে। তাদের কাজের মধ্যে ভালো মন্দের মিশ্রন ঘটেছে। কোন রাজনৈতিক দল ভালো কাজ করলে আমি তা সমর্থন করি। কিন্তু আমি, আমরা আমাদের দেশে আর কোন স্বৈরশাসক আসুক তা চাইনা, আর কোন জামায়াতে ইসলাম এর অমানুষ জাতীয় পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে ঘুরে বেড়াক মেনে নিতে পারি না, আর কোন দল স্বাধীনতার চেতনাকে অথবা ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি করুক তা মানতে পারি না। আমাদের দেশের জন্য যারা কাজ করবে, দেশকে যারা সোনার বাংলা বানাবে তারাই যেন দেশ চালানোর সুযোগ পায় এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। রাজাকার আল-বদর যুদ্ধাপরাধীরা এবং তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতাদের বর্জন করতে হবে।
এবার আমি আমার অবস্থান স্পস্ট করছি। আজ দেশজুড়ে যে আন্দোলন চলছে আমি সে আন্দোলনের সাধারন এক কর্মী। আমি কোন বাঁধাকে ভয় পাইনি, কোন গুজবে কর্ণপাত করিনি, কোন রাজনৈতিক দলের কর্মী হয়েও আন্দোলনে জড়াইনি। আমি এদেশের নাগরিক হিসেবে, এদেশকে কলংকমুক্ত করতে পথে নেমেছি। এখানে যারা এসেছে তাদের সবাই এক নয়। তাদের মধ্যে কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান, কেউ বৌদ্ধ, কেউ খ্রীস্টান, কেউ আওয়ামীলীগ কেউ বাম কেউ ডান... কিন্তু সবাই আমার সহযোদ্ধা। আমি বরাবরই অহিংস। কিন্তু এই বিপর্যয়ের মূহুর্তে আমার সব বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েছে। এখনই প্রতিরোধের সময়, প্রতিশোধের সময়। আমার দেশের কোন মানুষের প্রতি জামাতিদের ও তাদের দোসরদের নির্মম আচরনকে আমরা মেনে নিতে পারি না।
পুলিশদের আমি নানা কারনে অপছন্দ করতাম। এই পৃথিবীতে এই সভ্য (!!!!) যুগেও পুলিশ আর্মি রাখার প্রয়োজন হয়...এটা আমাকে আহত করে। তারমানে, আমদের পৃথিবী এখনো সভ্য হয় নি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পুলিশদের অনেক বড় অবদান রয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের পাশে পুলিশের ক্ষমতা অনেকটা ম্লান, তবুও আমাদের এই দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বন্ধুদের আত্মত্যাগ আমাকে ভালবাসা ফিরিয়ে দিয়েছে। আমি পুলিশদের প্রতি কৃতজ্ঞ। পুলিশ সরকারী চাকুরে। তাদের দায়িত্ব দেশের শৃঙ্খলা রক্ষা করা। তবুও যেসব পুলিশ বন্ধুরা এই যুদ্ধে মৃত্যু বরন করেছে তাদের প্রতি, তাদের পরিবারের প্রতি আমার ক্ষমা চাওয়ার মতো স্পর্ধা নেই।
আমি সরকারের কাছে তীব্র দাবী জানাই, সেইসব পুলিশ ভাইদের পরিবারকে সারাজীবন সর্বোচ্চ আর্থিক সাহায্য দিতে হবে। তাদের সন্তান, স্ত্রী, পিতা-মাতা দের বিনামূল্যে সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা দেবার নিশ্চয়তা দিতে হবে, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের সন্তান,পোষ্য, (ক্ষেত্র বিশেষে ছোট ভাই-বোন) দের পড়াশুনার সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। যেসব পুলিশ বন্ধুরা যুদ্ধে শহীদ হলেন তারা তো কিছুই পেলেন না। আসলে শহীদরা কিছুই পায় না। তারা তাদের অমূল্য জীবন উতসর্গ করে যান মানুষের কল্যানের জন্য, বিনিময়ে নিজেরা কিছুই পান না। সেইসব ত্যাগী পুলিশ ভাইদের আত্মীয়দের উদ্দেশ্যে বলছিঃ আপনাদের বাবা/সন্তান/ভাই/বন্ধু/স্বামী যে কিনা পুলিশ ছিল, যে কিনা নৃশংশভাবে নিহত হয়েছে অমানুষদের হাতে, সেই মহান পুলিশ, সেই সব মানুষদের প্রতি আমার সর্বোচ্চ সম্মান ও ভালবাসা থাকবে আজীবন, আর আমি যদি আপনাদের কারো সামান্য সেবাও করতে পারি তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করবো। আমরা যারা এখনো বেঁচে আছি... আমাদের ক্ষমা ক্ষমা করবেন।
সকল সহযোদ্ধাদের বলছি, আপনারা যে যেখানেই থাকুন, তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। জেলা শহর, উপজেলা, গ্রাম গুলিতে আপনারা সচেতনতা বৃদ্ধি করুন (নিজ নিজ এলাকায়)। গ্রামের সাধারন মানুষ যেন জামায়াতিদের মিথ্যাচারে বিভ্রান্ত না হতে পারে এই চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে মাইকিং করুন। মসজিদে মন্দিরে গীর্জায় প্যাগোডায় মানুষের বিভ্রান্তি দূর করতে কথা বলুন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরো ভালভাবে নিজেদের সুন্দর মত সহজ ভাবে প্রকাশ করুন। হাটে বাজারে নদীর ঘাটে স্টেশনে ক্যাম্প করে, দলবদ্ধ হয়ে মানুষদের সচেতন করুন। যেসব ধর্মপ্রান মুসলমান “চাঁদে সাইদীর ছবি দেখা” সংক্রান অপপ্রচারে বিভ্রান্ত তাদের কাছে সঠিক খবর পৌঁছে দিন। ধর্ম ও মৌলবাদের মাঝে পার্থক্য স্পষ্ট করে দিন সাধারন মানুষের কাছে। মন্দির গীর্জা প্যাগোডা মসজিদ এর পাশে দলবদ্ধ থেকে জামায়াত শিবিরকে প্রতিহত করুন। কোন ধর্মের মানুষেরই যেন কোন ক্ষতি না হয় সে ব্যাপারে সকল বন্ধুদের সজাগ থাকতে হবে। গ্রাম গঞ্জে সচেতনতার মাত্রা বৃদ্ধি করতে হবে। এই বিপর্যয়ের মূহুর্তে সবাইকে থাকতে হবে সদা জাগ্রত।
আমার অনেক সহযোদ্ধা বন্ধুদের প্রতি জানাচ্ছি হৃদয় থেকে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। আমরা যেখনেই থাকি না কেন, একসাথেই আছি সবসময়। আমরা কেউ একা নই। সার্বজনীন এই যুদ্ধে আমারা সবাই একই মায়ের সন্তান।
শিবির কর্মীদের বলছিঃ সবার উপরে মানুষ। মানুষ মানবতার জন্য, দেশের জন্য। ধর্ম মানুষের মঙ্গলের জন্য। প্রকৃত ধর্ম পালনে কোন অন্যায় নেই। একটু ভালকরে ভেবে দেখলে বুঝতে পারবেন আপনারা বুঝে/না বুঝে কতটা অন্যায় করছেন (আপনি করে বলতে ঘৃনা হচ্ছে)। সাইদী ইসলামের ত্রানকর্তা নয়। তার হাজারো ভন্ডামীর কথা মানুষ জানে। যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন কোন ভাল বিষয় হতে পারে না। এখনো সময় আছে একটু ভেবে দেখুন, মানুষের মতো আচরন করুন। যে কোন মানুষের মৃত্যু আমাকে ব্যাথিত করে,শিবির কর্মীর মৃত্যুও আমাদের কাম্য নয়। একটি মৃত্যু অনেকের কষ্টের কারন হয়। ক্ষমা মানুষের সবথেকে বড় গুন। তবুও আমি দুঃখিত, জামায়াত-শিবিরকে ক্ষমা করতে পারবো না, রাজাকারদের ক্ষমা করতে পারবোনা, এতোটা মহান আমি নই। সময় থাকতে মানুষের দলে আসুন। অমানুষদের সাথে থেকে নিজেকে আর কলুষিত করবেন না। আমি জানি, আমার এই কথাগুলি শুনে আপনারা (অমানুষ জামায়াত-শিবিররা) ক্রোধে ফেটে পরবেন। জানি আমি “চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী”, তবুও বললাম!
বাংলাদেশ, আমার মা, আমার মাতৃভূমি, তুমি ভয় পেওনা মা। আমার মতো তুচ্ছ একজন, যে তোমার সবথেকে দূর্বল সন্তান, সেই আমিই আজ ফুঁসে উঠেছি আগ্নেয়গিরির মতো, এই ক্ষুদ্র শরীর নিয়েই আজ আমি হয়েছি হিমালয়ের থেকেও শতগুন বড়। তোমার লাখো সন্তান আজ জেগেছে। আজ জেগেই আছে। আমাদের কোন ভাই-বোন নির্যাতিত হলে আমরা চুপচাপ বসে থাকি না। মাকে বাঁচাতে, প্রেমকে বাঁচাতে আমরা মৃত্যুকে তুচ্ছ মনে করি। আজ আমরা সবাই ভয় হারা। আমরা সবাই জাগ্রত......এই দুঃসহ রাত কেটে যাবেই যাবে, আমরা সূর্যকে আবার ছিনিয়ে আনবো, আনবো সোনালী সূর্য-রাঙ্গা সকাল।
জয় বাংলা।