গত বছর থেকেই পরিকল্পনা করছিলাম দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় টুরিস্ট ডেসটিনেশন বালি ঘুরে আসবার। ইন্দোনেশিয়ার ১৭,৫০০ দ্বীপ এর মধ্যে বালি অন্যতম সুন্দর দ্বীপ। বালির অবস্থান জাভা আর লম্বুক এর মাঝখানে। বালির আর লম্বুকের মাঝে নুসা আর গিলি নামে ৬ টা ছোট দ্বীপ আছে যেগুলো খুব সুন্দর আর পপুলার ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন। বালির সৌন্দর্য নিয়ে অনেক লেখা আছে তাই সেগুলোর বিস্তারিত না যেয়ে শুরু করলাম আমার ভ্রমনের বিস্তারিত।
১।ট্রাভেল প্ল্যানিংঃ
আমি কখনো দেশ থেকে প্যাকেজ কিনে নিয়ে ঘোরার পক্ষপাতি না। এরচেয়ে নিজে প্ল্যান করে ঘুরতে গেলে অনেক স্বাধীনতা থাকে আর নিজের মত ঘোরা যায়। যেহেতু অনেক দিন ধরেই ইচ্ছা ছিল তাই আমি যখনই সময় পেতাম বালি বিষয়ক বিভিন্ন ব্লগ, ট্র্যাভেলারস অফ বাংলাদেশ এর বালি বিষয়ক লেখা, ইউ টিউব এর বালি বিষয়ক ট্র্যাভেল ভিডিও, ট্রিপ এডভাইজার এর বালি ফোরাম এর বিভিন্ন লেখা পড়তাম আর নোট নিয়ে রাখতাম। যাবার ২ সপ্তাহ আগে একটা ফাইনাল প্ল্যান এক্সেল এ করে ফেলি।
২। ট্র্যাভেল এর উপযুক্ত সময়ঃ
বালি সবসময় ট্র্যাভেলার এ পরিপূর্ণ থাকে। তবে পিক সিজন হল এপ্রিল থেকে অক্টোবর। আর নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বর্ষা। ট্র্যাভেল এর জন্য সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে এপ্রিল থেকে অক্টোবর।
২।এয়ার টিকেট ঃ
বালির সরাসরি কোন ফ্লাইট বাংলাদেশ থেকে নেই। সিঙ্গাপুর অথবা মালয়শিয়াতে ট্রানজিট থাকে। টিকেটের মূল্য নির্ভর করবে আপনি কত আগে কনফার্ম করছেন তার উপর। আমি ২৮ দিন আগে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স এর ইকোনমি ক্লাস টিকেট ৩৫,৫০০ রিটার্ন পেয়েছিলাম। এই টিকেটই আবার ১ সপ্তাহ আগে কাটলে ডাবল হয়ে যেতে পারে।
৩।অবশেষে বালির পথে যাত্রা ঃ
আমাদের যাবার ফ্লাইট ছিল ২৩-সেপ্টেম্বর রাত ১১ঃ৫৫ তে। সিঙ্গাপুর এ ২ ঘণ্টা ট্রানজিট এর পর ২৪- সেপ্টেম্বর দুপুর ১২ঃ০০ টায় বালি নগুরাহ রাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এ পৌছাই।
৪। ট্রানজিট ঃ
ট্রানজিট এর সময় আসলে অপেক্ষা করা ছাড়া কোন কাজ নেই। আমাদের যেহেতু সিঙ্গাপুর চাঙ্গি এয়ারপোর্ট এ ট্রানজিট ছিল তাই এশিয়ার সবচেয়ে সুন্দর এই এয়ারপোর্ট এ এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করেই ট্রানজিট এর সময় পার করেছি। সাধারণত বালির ফ্লাইট টার্মিনাল ২ থেকে টেইক অফ করে। ফ্লাইট নাম্বার, টার্মিনাল নাম্বার আর বোর্ডিং গেইট এয়ারপোর্ট এর ডিসপ্লেতেই দেখতে পাবেন।
৫। বালি ইমিগ্রেশন ঃ
বালিতে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা একজেম্পটেড। শুধু মাত্র এন ও সি, হোটেল বুকিং, আর ফেরার টিকেট দেখাতে হয়। তবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখলে একটু বেশি সময় ধরে প্রশ্ন করে। আমি এন ও সি, হোটেল বুকিং, আর ফেরার টিকেট দেখানো সত্ত্বেও অফিসের আই ডি কার্ড আর আমি কি ধরনের কাজ করি সেই অফিসে, কতদিন ধরে চাকরি করছি সব জানতে চেয়েছিল। শুধুমাত্র বাংলাদেশিদের সাথেই দেখলাম এরকম করছে। অনেক ইউরোপিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান, ইন্ডিয়ানদের দেখেই এরাইভাল সিল দিয়ে দিচ্ছে। যাই হোক আমাদের ১৫ মিনিট পরে এরাইভাল সিল দিল। আমরা দুজন প্রবেশ করলাম বালিতে।
৪। বালিতে যাতায়াতঃ
বালিতে সলো ট্র্যাভেলারদের জন্য সবচেয়ে বেস্ট হচ্ছে বাইক ভাড়া করে ঘোরা অথবা গ্রাব বাইক ইউজ করা। এছাড়াও সারাদিন বা যতদিন থাকবেন ততদিন ট্যাক্সি ভাড়া করা যায়। বাংলাদেশি টাকায় প্রতিদিন ৩,০০০ টাকা করে পড়বে। আমি বাংলাদেশ থেকেই ওয়াটসঅ্যাপ এ বালির একজনের সাথে কথা বলে নিয়েছিলাম ( ইয়ান ডি- +6282237002223/+6285935123723)। এই ভদ্রলোক আমাদের ৭ দিনের জন্য সারাদিন গাড়ি, সাইট সিইং,নুসা পেনিদা আর গিলি আইল্যান্ড এর ফাস্ট বোট এর যাবার এবং আসবার টিকেট আর আমাদের বাংলাদেশে ফেরার দিন এয়ারপোর্ট এ ফেরা পর্যন্ত সাথে ছিল।
৫। কারেন্সি এক্সচেনজ এবং লোকাল কারেন্সিঃ
এক্ষেত্রে শুধু বলব যে- যখনই ডলার এক্সচেঞ্জ করবেন অবশ্যই অবশ্যই অথরাইজড এক্সচেঞ্জ হাউজ থেকে করবেন। অথরাইজড এক্সচেঞ্জ হাউজ গুলো সাধারণত বড় রাস্তার উপর মোটামুটি গোছান এবং দেখলেই বুঝতে পারবেন। এরা ডলার এক্সচেঞ্জ এর পর আপনাকে স্লিপ দিবে।
বালির মুদ্রার নাম রুপিয়াহ। আমরা ১০০ ডলার ভাঙ্গিয়ে- ১৪,০০,০০০ এর কিছু বেশি রুপিয়াহ পেয়েছিলাম। টাকার হিসাবটা একটু গোলমেলে লাগতে পারে যেহেতু সব কিছু লাখ টাকায় হিসাব। শুধু মনে রাখবেন, শেষের তিন শুন্য বাদ দিয়ে ছয় দিয়ে গুন দিলে আনুমানিক/কাছাকাছি বাংলাদেশি টাকায় কত তা বুঝতে পারবেন। ধরুন কোন জিনিশের দাম ২,০০,০০০ রুপিয়াহ হলে বাংলাদেশি টাকায় জিনিশটির দাম- ২০০*৬= ১,২০০ টাকা (প্রায়)।
সবচেয়ে ভালো হয়- http://www.oanda.com থেকে বালি কারেন্সি চিট সিট (Travelers Cheat Sheet)প্রিন্ট করে নিজের কাছে রাখা। খুবই কাজের আর টাকার হিসাব করবার সময় কোন ভুল হবে না।
প্রতিদিনের খরচ গুলো একটা ডায়েরিতে নোট করে রাখতে ভুলবেন না। আর তা না হলে দেখবেন কখন কি খরচ হয়েছে কোন কিছুই হিসাব করতে পারবেন না।
৬। হোটেল বুকিংঃ
ক্রেডিট কার্ড দিয়ে আগেই বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। হোটেল ভাড়া তুলনামূলক ভাবে বেশ কম। আমাদের হোটেল ছিল-
v অ্যালরন হোটেল- (কুটা)
v গিলি ফ্ল্যাশ হারমনি (গিলি টি আইল্যান্ড)
v আয়ানাস হোম স্টে (উবুদ)
v তামান সারি কটেজ (কুটা)
৬। ঘোরাঘুরিঃ
আমরা বালিতে পুরো এক সপ্তাহ ছিলাম (২৪-৩০ সেপ্টেম্বর)। মুলত কুটা, উবুদ, নুসা পেনিদা আইল্যান্ড আর গিলি ত্রাওয়ানগান আইল্যান্ড ঘুরি আমরা। বালির বিশেষত্ব হল এর অসাধারণ সুন্দর দ্বীপ, অসাধারণ সুন্দর সৈকত, নাইটলাইফ, বালিনিজ স্থাপত্য গড়ে তোলা মন্দির। আমরা এই সাত দিনে অনেক জায়গায় ঘুরেছি-
-ড্রিমল্যান্ড বিচ
-উলুয়াতু টেম্পল (সূর্যাস্ত টা মিস করবেন না। অদ্ভুত সুন্দর)
-নুসা দুয়া বিচ
-পান্তাই পান্দাওয়া বিচ (খুব সুন্দর, মোটামুটি ভিড় থাকে। এখানে আমরা কায়াকিং করি)
-তানাহ লট টেম্পল। (এখানকার সূর্যাস্তের দৃশ্যটাও অদ্ভুত সুন্দর)
- নুসা পেনিদা দ্বীপ
v নুসা পেনিদা দ্বীপ এ যাবার জন্য আপনাকে আসতে হবে সানুর হারবার এ। এখান থেকে ফাস্ট বোট (আমাদের ফাস্ট বোট এর নাম ছিল – নুসা জায়া ক্রজ) এ মাত্র ৩০ মিনিট এর মধ্যেই পৌঁছে গেলাম নুসা পেনিদা দ্বীপ এ। এখানে আমরা ঘুরে বেরিয়েছি-
-ক্লিং ক্লিং বিচ (ডায়নাসর বীচ ও বলে কেউ কেউ)
-ব্রোকেন বিচ
-ক্রিস্টাল বিচ
-এঞ্জেল বিলাবং বিচ এ
- গিলি ত্রাওয়ানগান দ্বীপ
v অবশ্যই এবং অবশ্যই এই দ্বীপ এ আসবেন এবং থাকবেন। বালির সবচেয়ে সুন্দর দ্বীপ। গিলি এয়ার এবং গিলি মেনো নামে আরও দুটি ছোট ছোট দ্বীপ আছে এই দ্বীপের পাশেই। তবে গিলি ত্রাওয়ানগান
স্বনামধন্য এর নাইট লাইফ এর জন্য। সন্ধ্যার পরেই যেন জেগে উঠে এ দ্বীপ আর সারারাত ধরে চলে উদ্দাম পার্টি। এই দ্বীপ এ যাবার জন্য আপনাকে আসতে হবে পাদাং বাই হারবর এ। আমাদের ফাস্ট বোট এখান থেকে গিলির উদ্দেশ্য রওনা দেয় (ফাস্ট বোট এর নাম অস্টিনা-৩)। পাদাং বাই থেকে গিলি ত্রাওয়ানগান যেতে প্রায় ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট এর মত লাগবে। আমরা ১ দিন ছিলাম এই দ্বীপ এ আর সারাদিন হেটেই ঘরাঘুরি করেছি। আমি সাইক্লিং করে সানসেট পয়েন্ট এ গিয়েছিলাম। সন্ধ্যা ৬ টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত ওদের একটা নাইট মার্কেট বসে যেখানে অনেক সি ফুড পাওয়া যায়। রাতে আমরা ওখানে খাওয়া দাওয়া করি। (নাইট মার্কেট টা কেউ মিস করবেন না। অনেক মজাদার সি ফুড পাওয়া যায় খুব কম দামে)। আমরা এক দিন থেকে পরেরদিন ফিরে আসি উবুদ এ।
- আলাস হারুম কফি প্ল্যানটেশন (এখানে আমরা লুয়াক কফি খাই। এরা আপনাকে ১৪ ধরনের কফি টেস্ট করতে দিবে।)
- তেগাল্লাল্লাং রাইস টেরেস
- আলোহা উবুদ সুইং (অসম্ভব সুন্দর একটা জায়গা। এখানে সবাই সুইং একটিভিটি করবার জন্য যায়)
- উবুদ আর্ট মার্কেট
- তেগেনুঙ্গান ওয়াটারফল
- কেমেনুহ বাটারফ্লাই পার্ক
- তানাহ লট টেম্পল ( এখানে দ্বিতীয়বার যাই সকালে। এখানে সকালের সৌন্দর্যও অন্যরকম। সমুদ্রের বিশাল ঢেউ উপর থেকে বসে বসে দুজন অনেক্ষন দেখি- অসম্ভব সুন্দর)
- বজ্রসন্ধি মনুমেন্ট (ডাচ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে বালিনিজদের সংগ্রাম কে উৎসর্গ করে এ মনুমেন্টটি যা প্রতিষ্ঠিত হয় বালির ডেনপাসার এ ১৯৮৭ সালে।)
- আই অ্যাম বালি থ্রি ডি আর্ট মিউজিয়াম (খুব মজার একটা জায়গা।)
- ইউ সি সিল্ভার মিউজিয়াম (সিল্ভার এর তৈরি বিভিন্ন গহনা আর শো পিস এর বিশাল মিউজিয়াম। আকাশ ছোঁয়া মূল্য। তবে এখানে গেলে এর গেট এর সামনে ছবি তুলতে ভুলবেন না। অদ্ভুত সব কারুকাজ করা অসম্ভব সুন্দর একটা প্রবেশ পথ।)
৬। খাওয়া দাওয়াঃ
আমরা নাসি গরেং (ফ্রাইড রাইস চিকেন আর ডিম দিয়ে) আর মিয়ে গরেং (নুডলস বিভিন্ন সবজি আর ডিম দিয়ে) খেয়েছিলাম বেশির ভাগ সময়। এছাড়াও একবার কে এফ সি আর ডমিনজ পিতজা থেকেও খেয়েছি (অনেক সস্তা বিদেশি চেইন রেস্টুরেন্টগুলো)। প্রতিদিনই ফলের জুস তো ছিলই। আপনারা যদি গিলি যান তবে অবশ্যই ওখানকার বালিনিজ কমলার জুস টা টেস্ট করবেন। অসম্ভব রিফ্রেশিং। অবশ্যই অবশ্যই “জনি টাকোজ- Johnny Tacos” এর টাকো টেস্ট করবেন। আমরা বাংলাদেশে ফেরবার আগের দিন যে হোটেল এ ছিলাম (তামান সারি কটেজ) ওখান থেকে হাটা পথে মাত্র ৫ মিনিটের দূরত্ব। তবে যে খাবারের আগে “বাবি” দেখবেন সেটা খাওয়া থেকে দূরে থাকবেন (বাবি- পর্ক)
৭। কেনাকাটা ঃ
কেনাকাটা এর জন্য চলে যান কৃষ্ণা ওলেহ ওলেহ মার্কেট এ। এখানে সব ধরনের সুভেনির, গিফট আইটেম, কাপড়, জুতা, বালিনিজ ট্র্যাডিশনাল ব্যাগ (গোল ব্যাগ) কিনতে পাওয়া যাবে। এছাড়াও যেতে পারেন আগুং বালি মার্কেট এ। এছাড়াও জনি টাকোজ যেখানে (Jl. Kartika Plaza No.21, Kuta, Badung, Kabupaten Badung, Bali) ওই রোড এর দুই পাশে অসংখ্য লোকাল বালিনিজ দোকান। কেনাকাটা ওখান থেকেও করতে পারেন।
৮। অবশেষে এল ফেরবার দিনঃ
আমাদের ফেরার ফ্লাইট ছিল ১/১০/২০১৯ এ। সকাল ১০ঃ২৫ এ ফ্লাইট তাই সকাল ৭ঃ৩০ এ বের হয়ে যাই। আমাদের হোটেল থেকে এয়ারপোর্ট মাত্র ১০ মিনিটের পথ। আমাদের ড্রাইভার এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইমিগ্রেশন শেষ করে অপেক্ষা করতে থাকি ফ্লাইট এর। আমাদের ফেরার দিন সিঙ্গাপুর এ ৭ ঘণ্টা ট্রানজিট ছিল যা খাওয়া দাওয়া আর চাঙ্গি এয়ারপোর্ট দেখতে দেখতে কখন কেটে গেল বুঝতেই পারি নি। রাত ৮ঃ২৫ এ ঢাকার ফ্লাইট। বাংলাদেশ সময় রাত১১ঃ৩০ এর কিছু পরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করে বিমান। শেষ হল আমাদের ৭ দিনের স্মরণীয় বালি ভ্রমন।
যেখানেই ঘুরতে যান অবশ্যই পরিবেশ এর দিকে নজর রাখবেন। যেখানে শেখানে ময়লা ফেলবেন না।
হ্যাপি ট্র্যাভেলিং!!!
নোটঃ
প্রায় ১ বছর পর ব্লগ এ ফেরত আসলাম। গত বছরের নভেম্বর এ শেষ লিখি এই ব্লগে। এরপর তো সামু প্রায় ৮ মাস মিথ্যা অভিযোগে বন্ধ ছিল। আমি খুব খুশি সত্যর জয় হওয়ায়। আবার ফিরে পেলাম প্রানের সাম হোয়ার ইন ব্লগ। এই বছর সাজেক, শ্রীমঙ্গল ও ভ্রমন করা হয়েছে। ধীরে ধীরে সে সম্পর্কিত ট্র্যাভেলগ দিবো।