বেশ কিছুদিন আগে শেষ করেছিলাম প্রখ্যাত লেখক হাসান আজিজুল হক এর একমাত্র উপন্যাস আগুনপাখি- যার মূল আলেখ্য ছিল দেশ ভাগ। কিছুদিন পর এক বন্ধের দিনে নীলক্ষেতের মোস্তফা মামার দোকানে বই খুঁজতে গিয়ে পেয়ে যাই বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত- “উপমহাদেশের দাঙ্গার গল্প” যা প্রখ্যাত উর্দু লেখকদের দেশভাগ নিয়ে লেখা গল্পের সাবলীল বাংলা অনুবাদ।
৪৭ এ দ্বিজাতি তত্ত্ব এর ভিত্তিতে বিভক্ত হয় বিশাল ভারতীয় উপমহাদেশ। ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্তান নামক পৃথক দুটি দেশের। লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষ তাদের সাত পুরুষের ভিটে মাটি ছেড়ে এপার থেকে ওপার এবং ওপার থেকে এপার চলে আসতে বাধ্য হয়। দেশ ভাগের বলি হয় লক্ষ লক্ষ নারী, পুরুষ ও শিশু। দু দেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ বাস্তুহারা হয়। ধর্ষিত হয় অসংখ্য নারী।
কিন্তু এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী প্রগতিশীল লেখকদের বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছিলো। তারই মধ্যে একজন লেখক হচ্ছেন কৃষন চন্দর যিনি তার ছোটগল্প “পেশোয়ার এক্সপ্রেস” এর জন্য বহুল পরিচিত।
কৃষন চন্দর এর লেখার সাথে আমার পরিচয় তার বিখ্যাত উপন্যাস “গাদ্দার” এর মাধ্যমে। তবে পেশোয়ার এক্সপ্রেস গল্পের ছোট পরিসরে লেখক দেশভাগ, সাম্প্রদায়িকতার যে ভয়াবহতা একটি বোবা যন্ত্রদানব ট্রেন এর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন- তা ছোটগল্পে অতুলনীয়।
উদ্বাস্তুদের বহনকারী ট্রেন পেশোয়ার এক্সপ্রেস পাঠকদের বলে যায়-
………হঠাৎ এই দেশ, গ্রাম তাদের কাছে অপরিচিত হয়ে গেলো। শরণার্থীরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাড়ি জমালো এক নতুন দেশে। তাদের জানমাল এবং মেয়েদের ইজ্জত বাঁচিয়ে কোনরকমে যে চলে আসতে পেরেছে সে জন্য ভগবানের কাছে তারা কৃতজ্ঞ। কিন্তু দুঃখে এবং রাগে তাদের হৃদয়ে যেন রক্ত ঝরছিল। তাদের সাত পুরুষের ভিটে মাটি ছেড়ে আসতে বুকে যেন গ্রানাইট বিদ্ধ হচ্ছিলো আর তারা অভিযোগ করছিলো- মাগো, কেন নিজের সন্তানদের এভাবে তাড়িয়ে দিচ্ছ? তোমার বুকের উষ্ণ আশ্রয় থেকে কেন এভাবে মেয়েদের বঞ্চিত করলে? এসব নিরপরাধ কুমারী মেয়েরা তোমার শরীরে আঙ্গুর লতার মত জড়িয়ে ছিল এতদিন। কেন হঠাৎ তাদের টেনে হিঁচড়ে ছিঁড়ে ফেললে। মাগো !!! মা!!!”
পেশোয়ার এক্সপ্রেস এগিয়ে যায় আর রচিত হতে থাকে সাম্প্রদায়িক ঘৃণায় মেশানো এক একটি মৃত্যুর গল্প-
…………”প্লাটফর্ম এর উপর রক্তের স্রোত গড়িয়ে পড়রেচে…আমার মনে হল যে, আমার নিচের লোহার চাকাগুলো যেন পিছলে যাচ্ছে বার বার। … গাড়ির প্রতিটি বগিতেই মৃত্যুর হিমেল ছোঁয়া স্পর্শ করছে। মৃতদেহগুলো মাঝখানে শোয়ানো আর চারপাশে জীবন্ত মৃতরা বসে আছে ট্রেনের সিটে। কোথাও একটা বাচ্চা কেঁদে উঠেছে। এক কোণায় মা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এক স্ত্রী তার মৃত স্বামীর দেহ আঁকড়চিল…আমি ছুটতে লাগলাম ভয়ে।“
পেশোয়ার এক্সপ্রেস বলে যায়-
“…আমি এগিয়ে যাই। আমার দেহের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘৃণাবোধ হচ্ছিলো। দেহ খুবই অপবিত্র হয়ে গেছে।“
বোবা যন্ত্রদানব অভিশাপ দিয়ে যায় স্বার্থপর নেতাদের যারা দেশভাগের জন্য দায়ী। যাদের খামখেয়ালী আর সঙ্কীর্ণ মানসিকতার জন্য হত্যার এই মহোৎসব-
“ লক্ষ অভিশাপ নেমে আসুক এসব নেতার মাথায় যারা এই সুন্দর মর্যাদাশীল ভূখণ্ডকে অসম্মান ও হত্যার মহোৎসবে এনে হাজির করেছে, যারা এদের শরীরে হত্যা, লুটতরাজ ও ধর্ষণের জীবাণুর বীজ ঢুকিয়েছে।“
অবশেষে পেশোয়ার এক্সপ্রেস এর ভয়ঙ্কর যাত্রা শেষ হয়-
“বোম্বাই এসেছি অনেকদিন পর। এখানে ওরা আমাকে ধুয়ে, পরিষ্কার করে শেডের মধ্যে রেখে দেয়। আমার শরীরে এখন আর রক্তের দাগ নেই। খুনিদের হৈ হুল্লোড় আর স্লোগান নেই। কিন্তু রাতে যখন একলা থাকি, মৃত আত্মারা যেন ভুত হয়ে আবার জেগে উঠে। আহত শরণার্থীরা জোরে চিৎকার করে, নারী ও শিশুরা ভয়ে ককিয়ে উঠে। আর আমি সর্বদা কামনা করি, আমাকে যেন এই ভয়ানক যাত্রায় কেউ নিয়ে না যায়। এই ভয়ানক যাত্রার জন্য আমি এই শেড ছাড়তে রাজি নই। কিন্তু আমি ঠিকই সুন্দর যাত্রার জন্য প্রস্তুত।“
“…আমি একটি সামান্য প্রাণহীন ট্রেন। প্রতিশোধ ও ঘৃণার এমন জঘন্য বোঝা কেউ আমার পিঠে চাপিয়ে দিক তা আমি চাইনা। দুর্ভিক্ষ পীড়িত অঞ্চলে আমাকে দিয়ে খাদ্য বহন করানো হোক, গ্রামে চাষিদের জন্য আমাকে দিয়ে ট্রাক্টর ও সার বহন করে নিয়ে যাওয়া হোক। আমাকে যেখানেই নিয়ে যাওয়া হোক না কেন মৃত্যু ও ধ্বংসের মাঝে যেন না নেয়া হয়।“
……”আমি চাই আমার গাড়ির প্রতিটি বগিতে সুখী চাষি ও শ্রমিকদের দল এবং তাদের স্ত্রীদের কোলে থাকবে পদ্মফুলের মত সুন্দর শিশু। ওরা মৃত্যুকে নয় বরং আগামীদিনের জীবনকে মাথানত করে কুর্নিশ করবে। এইসব শিশুরাই এক নতুন জীবন পদ্ধতি গড়ে তুলবে, যেখানে মানুষ হিন্দু ও মুসলমান হিসেবে পরিচিত হবে না, পরিচিত হবে একমাত্র মানুষ হিসেবে। “
শেষ করবো পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী এবং লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় এর দেশ ভাগ নিয়ে লেখা একটি অসাধারণ ছড়া দিয়ে-
“তেলের শিশি ভাঙলো বলে
খুকুর ‘পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙ্গে ভাগ করো।
তার বেলা?
ভাঙছ প্রদেশ ভাঙছ জেলা
জমিজমা ঘর বাড়ি
পাটের আড়ত ধানের গোলা
কারখানা আর রেলগাড়ি।
তার বেলা?