হাসান আজিজুল হক, শক্তিমান এ লেখকের সাথে পরিচয় তার বহুল পঠিত গল্পগ্রন্থ “আত্মজা এবং একটি করবী গাছ” পড়বার মাধ্যমে। তার একমাত্র উপন্যাস আগুনপাখি অনেক দিন সংগ্রহে থাকলেও পড়া হয় নি কোন কারনে! অথচ কত দেরিই না করে ফেললাম এ অসাধারণ উপন্যাসটি পড়তে। সেইদিন এক বন্ধের অলস দুপুরে অবসরে তুলে নিলাম আর যখন শেষ করলাম পুরো উপন্যাস- এক ঘোর লাগা অনুভুতিতে আচ্ছন্ন ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ- ঠিক যেন আমিও হারিয়ে গিয়েছিলাম সেই বিভাগ পূর্ব এই বাংলার কোন এক সচ্ছল গেরস্থ বাড়িতে- যে বাড়ির এক অতি সাধারণ অশিক্ষিত গেরস্থ রমণী আঞ্চলিক ভাষায় বলে গিয়েছে- সেই সময়ের সমৃদ্ধ “সুজলা-সুফলা” বাংলার কথা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা, সংসারের সমৃদ্ধির কথা, অলা বিবি আর মা শেতলার গ্রামকে গ্রাম উজার করে যাবার কথা, যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, স্বদেশী আন্দোলন, দেশভাগ, তার একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙ্গন, যুদ্ধের ভয়াবহতায় সমৃদ্ধিতে ভরপুর গ্রামটির দৈন্যদশা… সেই নাম না জানা অতি সাধারণ গেরস্ত বউটি যেন মহাকাল হয়ে বলে যেতে থাকে সবকিছু
সংসারের সমৃদ্ধির কথা বলে যেতে থাকেন … “পাঁচ কামরার কোঠাঘরের একটো ঘরের মেজেয় পেঁয়াজ রাখা হয়েছে। সব পচে বাড়ি একদম দুগগন্ধে ভরে গ…খানা রাঁধার বিরাট তামার হাড়িতে গুড় রাখা হয়ছচে…ঘরে রাখার জায়গা নাই। একদিন দেখে এই বড়ো একজোড়া ইঁদুর তার মদ্যো পড়ে রয়েছে। সেই গুড় ফেলে দিলে গুড়ের ঢল বয়ে গেলো গোটা এগনে জুড়ে... “
ঘনিয়ে এল যুদ্ধ… তিনি বলে যান- “যুদ্ধের ফল এই বোধহয় শুরু হলো। ঘরে ঘরে সব তাঁত বন্ধ। সুতো নাই, তাঁতিরা সব পেটে কাপড় বেঁধে বসে আছে।“
“কি ভয়ানক দিন এল! এমন খরানি বাপের জন্মে দেখেছি বলে মনে হয় না। আকাশের দিকে চাইলে চোখ পুড়ে যেচে, আসমানের নীল রঙ লাল হয়ে গেয়েছে। এক একটো দিন যেন পাহাড়ের মতন বুকে চেপে থাকছে- কিছুতেই পেরুইতে পারা যেচে না। সাথে আছে আবার যুদ্ধ আর আকাল। গেরস্তর নিত্যদিনের যা যা লাগে, তা যি শুদু আক্রা তাই লয়, পাওয়াই যেচে না। পেদনের কাপড়ের কথা আর কি বলব, সি তো পাওয়াই যেচে না। কেরোসিন নাই… কয়লাটো এতদিন পাওয়াও যেছিল, সেই কয়লাও একন আর পাওয়া যেচে না… নুন নাই, চিনি নাই…
ভরা সংসারে যুদ্ধের আকালে ঘনিয়ে আসে অভাব… মহাকাল বলে যেতে থাকেন- “ঘরের কোনের ঐ বেরাট পয়ার ভেতরে আদার দিন দিন ঘোনো হচে…স্যারদুয়েক চাল বার করে ঘরের বাইরে এসে দোপরের রোদে এগনের মাঝেখানে দাঁড়িয়ে কেঁদে বললে- আর একটি দানাও নাই। বাছারা আজ রেতে আর কেউ খেতে পাবে না।“
ভরা সংসারের ভাঙ্গন তিনি বর্ণনা করেন ব্যাথিত হৃদয়ে- “ঐ রেতেই যেমন কথা হলো সেইভাবে সব ভাগ হলো, ঝগড়াঝাঁটি হলো না, পাড়াপড়শি, গাঁয়ের লোকদের ডাকতে হলো না। তবে সব ঠিকঠাক হতে, আলেদা আলেদা হাড়ি হতে দিনকতক সময় গেল। বুকে পাষাণ বেঁধে চুপচাপ নিজের কাজ করতে লাগলাম।“
“তেলের শিশি ভাঙলো বলে
খুকুর ‘পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙ্গে ভাগ করো
তার বেলা ?”
মহাকাল বলে যান... “আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না ক্যানে আলাদা একটো দ্যাশ হয়েছে গোঁজামিল দিয়ে িযখানে শুদু মোসলমানরা থাকবে কিন্তুক হিঁদু কেরেস্তানও আবার থাকতে পারবে। তাইলে আলাদা কিসের ? আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না িয সেই দ্যাশটো আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটি আমার লয়। “ দেশ ভাগের অসারতা এই সরল নাম না জানা গেরস্ত বউটি উপলব্ধি করতে পারলেও পারেননি তখনকার দেশের হর্তা কর্তারা।
আগুনপাখি হাসান আজিজুল হক এর একমাত্র উপন্যাস- এবং আমার মতে একজন লেখকের সারা জীবনে এরকম একটা উপন্যাসই যথেষ্ঠ। অসাধারণ উপভোগ্য একটি উপন্যাস এবং আমার প্রিয় উপন্যাসের তালিকায় এই বইটি সমসময়েই শীর্ষে থাকবে।