প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণ- যার অসাধারণ রচনার শ্রেষ্ঠত্বই হল গ্রামীণ প্রকৃতির বর্ণনায়, প্রকৃতির অসাধারণ রূপ বর্ণনায়। যা কিছু আমাদের চলার পথে প্রতিদিন অবহেলিত পড়ে থাকে, বিভূতিভূষণ এগুলো তুলে নিয়েই উপাদান করেছেন তার সাহিত্যর। প্রকৃতির এমন সব রূপ, রস, গন্ধই উঠে এসেছে তাঁর সুবিখ্যাত পথের পাঁচালি, আরণ্যক, আদর্শ হিন্দু হোটেল, ইছামতী, চাঁদের পাহাড় উপন্যাসে এবং তাঁর লেখা অসাধারণ সব ছোটগল্পে যেখানে তিনি রহস্যময় অপরূপ প্রকৃতির ইন্দ্রজালে বিমুগ্ধ করেছেন তাঁর পাঠকদের।
বিভূতিভূষণ এর মনোজগৎ বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর একমাত্র পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন-
“পার্থিব ভোগসুখ এবং মহৎ ক্ষতিকে তুচ্ছ করে দেখতে পাবার নাম যদি দার্শনিকতা হয়, তাহলে বিভূতিভূষণ বর্তমান শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ দার্শনিক।“
আর বিভূতিভূষণ এর সাহিত্য বর্ণনায় উইলিয়াম ব্লেক এর কবিতার এই কয়টি লাইনই যথেষ্ঠ-
“To see the world in a grain of sand,
And heaven in a wild flower.
Hold infinity in the palm of your hand.
And eternity in one hour.”
তুচ্ছ বিষয় থেকে সরল এবং মহৎ জীবনানন্দকে তুলে নেবার কৌশলই বিভূতিভূষণ এর লেখনীর অন্যতম বৈশিষ্ট- তাই মৃত্যুর সাত দশক পড়েও তাঁর সাহিত্য আজও প্রাসঙ্গিক।
মৃত্যু! জীবনের অমোঘ সত্য। সবাইকেই একদিন মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে হবে। মৃত্যু এতটাই সত্য। মৃত্যুর প্রসঙ্গ আসলেই অনেকদিন আগে পড়া- আমার আরেকজন প্রিয় লেখক এরিখ মারিয়া রেমার্ক এর বিখ্যাত উপন্যাস “A Time to Love, A Time to Die” [সেবা অনুবাদঃ স্বপ্ন, মৃত্যু, ভালোবাসা] এর একটি লাইন মনে পড়ে যায়-
“মৃত্যু; ছোট্ট একটি শব্দ, অথচ কি অবিশ্বাস্য ক্ষমতা। এক নিমেষে থমকে দাড়ায় জীবন, হোক সে তুচ্ছ কিংবা অমিত সম্ভাবনাময়। এক মুহূর্ত আগেও যে ছিল উচ্ছল প্রানবন্ত, পরমুহূর্তেই সে নেই। কি অবিশ্বাস্য এই না থাকা।"
রেমার্ক এর কথার মতই, ১৯৫০ এর ১ লা নভেম্বর এই অসাধারণ লেখকের জীবনাবসান ঘটে যিনি পাঠকের মাঝে এখনও বেঁচে আছেন তাঁর ধ্রুপদী উপন্যাস আর ছোটগল্পের জন্য।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই এ সুন্দর প্রকৃতিকে বিদায় জানিয়ে তিনি যাত্রা করেছিলেন মৃত্যুর অজানা ও রহস্যময় ভুবনে। কিন্তু তাঁর এই মৃত্যুর সাথে জড়িত ছিল একটি রহস্যময় ঘটনা, যা আদিভৌতিক বা অলৌকিক বললেও অত্যুক্তি হবে না।
লেখক চিরকাল নির্জনতা পছন্দ করতেন, তাই শেষ জীবনে বিহারের ঘাটশিলায় একটি জনমানবশূন্য, জঙ্গলে ঘেরা বাড়িতেই বসবাস করতেন। কোন একদিন সন্ধ্যায় বনাঞ্চলের পথ ধরে হাটা শেষ করে গোধূলির আলো আধারির মধ্যে ঘরে ফেরবার পথে তিনি দেখতে পান কয়েকজন লোক জঙ্গলের পথে একটি মৃতদেহকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি কৌতূহলের বশে লেখক এগিয়ে যান এবং মৃতদেহ বহনকারীদের জিজ্ঞাসা করেন কে মারা গিয়েছে ? কোন কথা না বলে মৃতদেহ বহনকারীরা মৃতদেহটি কাঁধ থেকে নামান এবং মুখের কাপড় সরিয়ে দেন। প্রচণ্ড বিশ্ময় এবং ভয় নিয়ে বিভূতিভূষণ দেখতে পান- মৃতদেহটি আর কারও নয় বরং তাঁর নিজের। প্রচণ্ড ভয়ে দৌড়ে তিনি বাড়ির সামনে চলে আসেন। এই ঘটনার কিছুদিন পড়েই লেখক অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯৫০ এ মাত্র ৫৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
বিভূতিভূষণ এর মৃত্যুর পর তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন ঃ
"কীর্তিমানের মৃত্যু নেই; কীর্তিমান বিভূতিভূষণ তাঁর সাহিত্যকীর্তির মধ্যে অমৃতময় চিরনবীন রূপে নিত্যনবীন পৃথিবীর মধ্যে অধিষ্ঠিত হইলেন।"
প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি এবং বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার এই যুগেও অলৌকিক ঘটনার দিন শেষ হয়ে যায় নি। সন্দেহবাদিরা যত অবিশ্বাস করুক না কেন এই অলৌকিক ঘটনাগুলোর অস্থিত্ত খুবই বাস্তব যদিও অনেক সময় আমরা এগুলোকে অলৌকিক বলে চিনে নিতে পারি না। এ প্রসঙ্গে জে.বি.এস. হ্যালডেন এর কথা দিয়েই আজকের লেখাটা শেষ করি-
“সত্য যে কল্পনার চেয়েও বিচিত্র শুধু তাই নয়, আমাদের কল্পনা যতদূর পৌছায় সত্য তার চেয়েও অদ্ভুত।“
তথ্যসূত্র ঃ
১। বিভূতিভূষণ এর মৃত্যুর সাথে জড়িত অলৌকিক ঘটনাটি পড়েছি ব্লগার কেমিক্যাল রিয়াদ এর "লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রহস্যজনক মৃত্যু" লেখাটি থেকে । [ হুমায়ুন আহমেদের কোন একটা বইতেও বিভূতিভূষণ এর মৃত্যুর এই ঘটনাটি পড়েছিলাম। অনেক চেষ্টা করেও বইটার নাম মনে করতে পারছি না।]
২। "বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর সুনির্বাচিত শ্রেষ্ঠ গল্প" বই এর ভুমিকায় বিভূতিভূষণ এর ছোটগল্প সম্পর্কে তাঁর একমাত্র পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এর মূল্যায়ন ।