রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এর গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন স্যারের লিখা একটা সময়োপযোগী লিখা.. শেয়ার না করে পারলাম না
"" এ তো রীতিমতো অরাজকতা। খোদ রাজধানী থেকে রাজনীতি/রাজ-তন্ত্র উঠে গেল নাকি? রাজার অনুমতি, রাজার পুলিশ-পেয়াদা-বরকন্দাজদের লিখিত পারমিশন ছাড়া সমাবেশ হচ্ছে দিব্যি। রাস্তা বন্ধ করে সমাবেশ। মানুষের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করা। সর্বনাশের কথা। উপরন্তু শাহবাগের সমাবেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজনীতিকেরা সেখানে বক্তৃতা করতে পারবেন না। সাহারা খাতুন, হানিফরা বক্তৃতা করতে গিয়ে অপদস্ত হয়েছেন এরই মধ্যে। এই সমাবেশ তার মানে রাজনীতিবিরোধী। অরাজকতা ছাড়া কী?
‘অরাজকতা’ মানে ‘রাজা’বিহীন বন্দোবস্ত। রাজা-রাজনীতি-হুজুর-হোমরাচোমড়া ছাড়াই নিজেরা নিজেদেরকে পরিচালনা করার স্বকৃত বিন্যাস। এরই তো নাম অরাজকতা। এই সমাবেশের রাজনীতিবিরোধিতার ভেতরে সুপ্তভাবে হলেও আছে ‘অরাজ’-এর ধারণা: অরাজনীতি, অরাজতন্ত্র। অন্য ভাষায় একেই বলে নৈরাজ্য। নৈরাজ্য মানে স্বাধীনতা। নৈরাজ্য মানে স্বনিয়ন্ত্রণ, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মকর্তৃত্ব। নৈরাজ্য মানে ‘আমরা সবাই রাজা’। সুপ্ত এই উপাদানগুলো ক্রমশ স্পষ্ট ভাষায় যত বেশি প্রকাশিত হয়ে উঠবে, শাহবাগ-সমাবেশ তত বেশি এগিয়ে যাবে তাহরির স্কয়ারের দিকে। আরবিতে ‘তাহরির’ মানে কিন্তু ‘স্বাধীনতা’ই বটে। শাহবাগ-চত্বর এ পথেই এগিয়ে যাবে স্বাধীনতা-চত্বরের দিকে।
নব্বইয়ের শুরুতে আরম্ভ হওয়া আইনের শাসনের অগোছালো বোলচাল ১/১১-তে আইনের বিভিষীকাপন্থার দাঁত দেখিয়েছিল। তারই অনুরাগে (কিছু আগে কিছু পরে) কর্তৃপক্ষীয়, চাপিয়ে-দেওয়া, শাসন প্রতিষ্ঠার প্রচারণামাধ্যমে এতদিন শুনে এলাম: ‘আইন তার নিজের গতিতে চলবে’! এখন দেখছি খোদ ‘আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল’-এর আদেশ লোকে মানছে না। আদালতের জন্য লজ্জার কথা। এ তো রীতিমতো আদালত অবমাননা। এই কদিন আগেও যে-হাইকোর্টের হাইথট-ওয়ালা সব রুল জারির কথা শুনছিলাম, রেডিওতে কীভাবে বাংলা বলা হবে, হুমায়ূন আহমেদ কীভাবে উপন্যাস লিখবেন ইত্যাদি প্রভৃতি কিছুই বাদ যাচ্ছিল না আইনের সুদীর্ঘ হাতের নাগাল থেকে, সেই হাইকোর্ট এখন চুপচাপ। তাজ্জব বটে।
রাস্তায় সমাবেশ নাকি অবৈধ! রাস্তায় সমাবেশ করলে গাড়ি চলতে অসুবিধা হয়, পণ্য-পরিবহনে বিঘ্ন ঘটে। সেই রাস্তা অধিকার করে সমাবেশ চলছে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা, লাগাতার। আশ্চর্য ব্যাপার। অধিক আশ্চর্যের ব্যাপার: বেয়াদব জনসাধারণ এই রাস্তা-অধিকার-করা আন্দোলন নিয়ে বিরক্ত হচ্ছেন না, মিডিয়ার কাছে নালিশ করছেন না, উল্টো বাড়ি থেকে ভাত এনে ছেলেমেয়েদের খেতে দিচ্ছেন। বাবা এগিয়ে দিচ্ছেন তাঁর মেয়েকে। মা দোয়া করছেন ছেলের জন্য। বান্ধবী বন্ধুকে ফেসবুকে মেসেজ পাঠাচ্ছে: ‘বাড়ি ছেড়ে পালালাম; শাহবাগে যাচ্ছি।’
আইনের শাসন তাহলে উধাও! যেকোনো সমাবেশ করার জন্য মেট্রেপালিটন পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত আবেদন পেশ করতে হবে। তারপর তাঁরা দয়া করে অনুমতি দেবেন (আদৌ যদি দেন)। কোথায় গেল সেইসব কর্তৃপক্ষীয়, চাপানো আইনকানুন? আওয়ামী লীগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী না হয় এই আন্দোলনে লাভবান হবেন ভেবে সৌজন্যবশত এর ওপরে মরিচের গুঁড়া ছিটাচ্ছেন না। কিন্তু ‘জনদুর্ভোগ’! কোথায় ‘প্রথম আলো’? কোথায় গেল তাদের এতদিনকার প্রিয় এজেন্ডা? মানুষ এত নির্লজ্জ হয়! হয় না। মানুষ এত নির্লজ্জ হয় না: কিন্তু পুঁজি হয়; ক্ষমতা হয়; সার্কুলেশন হয়। ওগুলো আসলে মানুষ নয়, মনুষ্যোচিত নয়, মনুষ্যবান্ধব নয়। শাহবাগের সমাবেশ যতদিন এসবের দিকে মন না দেবে ততদিন আমাদেরকে কর্মময় অপেক্ষার উপাসনা করতে হবে বৈকি। মিডিয়ার অতি-তেলে তৈলাক্ত হওয়ার বিপদ সম্পর্কে আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে কিন্তু।
আইনত এখনও মাঘ মাস, শীতের রাজত্ব। তবু বেআইনত যে ফাল্গুনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বোঝা যাচ্ছে, মানুষ রাস্তায় নামলে সব কিছু বদলে যায়। বিচারবিভাগ দুশ্চিন্তায় পড়ে। পুলিশবিভাগ রুটিন দায়িত্বের বাইরে বেরুনোর আগে ভাবে। মিডিয়া একটা অরাজক আন্দোলনকে কাভার করার জন্য রাত জাগে। আর রাজনীতিবিদেরা ভাবতে থাকেন: আমাদের দিন কি ফুরিয়ে যাবে? এইসব বাচ্চাকাচ্চারা সময়মতো দুধভাত খেতে ঘরে ফিরবে তো?
হ্যাঁ, যেকোনো প্রকৃত গণআন্দোলন ঘিরে সব ধরনের ক্ষমতাশীল মহল প্যাঁচ কষতে থাকেন। তবু যে বালিকারা বালকদের সঙ্গে ক্রোধের আনন্দে নাচছেন তাতে আমি আনন্দিতই বটে। এই সাক্ষাৎ, নারীর সঙ্গে পুরুষের, বড়দের সঙ্গে ছোটদের, শিক্ষিতদের সঙ্গে রিকশাওয়ালাদের, এ আমাদের সমাজের যাবতীয় অসামাজিক ব্যাধি-বালা-মুসিবত কমাবে, বাড়াবে সমাজের স্বাধীনতার সীমা: রাষ্ট্র-রাজনীতির একচ্ছত্র রাক্ষস-ক্ষমতার বিপরীতে। সুসমাচার বৈকি।
আসলে দশচক্রে ভগবান ভূত। দশ যেখানে, ভগবানও সেখানে। বহুমত আর বৈচিত্র্যই এই আন্দোলনের শক্তি। সেজন্যেই এর মধ্যে রাজনীতিকরা ঢোকার চেষ্টা করছেন। একটু-আধটু ঢুকেও পড়ছেন রাষ্ট্রক্ষমতার জোরে। তাঁরা নিজেরা যদি এই সমাবেশ ডাকতেন, দলীয় কর্মীরা ছাড়া কেউই আসতেন না, সে কথা সবারই জানা। সেইজন্যই তরুণদের প্রাণবন্ত সমাবেশে সরিসৃপের মতো ঢুকছে রাজনীতি। ঢুকছে ষড়যন্ত্রও। ষড়যন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে হলে শাহবাগ-সমাবেশকে ইতোমধ্যে বিদ্যমান বহুমত-বৈচিত্র্য-রাজনীতিবিরোধিতা ধরে রাখার পাশাপাশি আনুভূমিক-ও-গণতান্ত্রিক নতুন সাংগঠনিক কাঠামো এবং নতুন ভাষা সৃজন করতে পারতে হবে। এটাই তাঁদের জন্য আসল চ্যালেঞ্জ।
রাস্তায় এতদিন শুধু জামায়াত ছিল। তাদের পেট্রোডলারের দাপট ছিল। কালো টাকায় কেনা, কালো টাকায় ভাড়া করা অস্ত্র এবং অস্ত্রধারী ছিল। কাঁচের শিশির পেট্রোলবোমা ছিল। এখন নিরস্ত্র-কিন্তু-স্বপ্নসশস্ত্র মানুষও রাস্তায় নেমেছেন। আনন্দ সংবাদ।
“রিক্লেইম দ্য স্ট্রিট!”: আমাদের ইঙ্গ-মার্কিন-ইউরোপীয় লড়াকু বন্ধুদের বহুদিনের আদরের স্লোগান। ষাট-সত্তরের দশকের ইউরোপ-জোড়া প্যারিস-বসন্ত থেকে শুরু করে শ্রমচোষা-রক্তচোষা মালিকদের হাত থেকে শিক্ষার্থী-শ্রমিকদের কারখানা-পুনর্দখল-আন্দোলন আর প্রশাসক-প্রফেসরদের হাত থেকে ক্যাম্পাস কব্জা করার আন্দোলন; বর্ণবাদ-পুরুষতন্ত্র-শ্রেণিবৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, প্রকৃতি পুনরুদ্ধারের আন্দোলন; আশির দশকের যুদ্ধবিরোধী-আগ্রাসনবিরোধী-পরমাণুঅস্ত্রবিরোধী আন্দোলন; নব্বইয়ে এবং তার পরের দশকে পুঁজির বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে সিয়াটল-জেনোয়া-কানকুনের আন্দোলন আর আফগানিস্তান-ইরাক-যুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলন; এবং তারপর এই একুশ শতকে এসে লন্ডনে ছাত্রবেতনবিরোধী শিক্ষার্থী-আন্দোলন ও ইঙ্গ-মার্কিন-ইউরোপ-জোড়া পুঁজিবাদবিরোধী অকুপাই-মহাআন্দোলন: এই সমস্ত আন্দোলনের প্রধানতম আইডিয়া এবং স্লোগান ছিল “রিক্লেইম দ্য স্ট্রিট!”
না, রাজপথ দখল নয়: রাস্তার গণমালিকানা নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা। রাজপথ তো রাজার। রাজা যায়, রানি যায়, বাঁশি বাজে, পথিক আটকে থাকে, পাজেরো ছোটে প্রাসাদের দিকে। আর রাস্তা মুসাফিরের। রাস্তা পথিকের। রাস্তা অনুসন্ধানের। সেই রাস্তার পুনঃমালিকানা দাবি করেছে শাহবাগের সমাবেশ। সুখের খবর।
বিগত কুড়ি বছর ধরে আমাদেরকে শেখানো হচ্ছে, মিডিয়া-মুখস্ত করানো হচ্ছে: পার্লামেন্টই সকল সমস্যার সমাধানের উৎস। পার্লামেন্টে যে নাই, আইনত সে নাই। সে অস্তিত্বহীন: নন-এগজিস্টেন্ট। পার্লামেন্টারি-রাজনীতির রমরমা এই আইনের শাসনের যুগে শাহবাগে আজকের মহাসমাবেশটির আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠ করা শপথ অনুযায়ী ‘গণমানুষের নেতৃত্বে’ রাস্তায় আন্দোলন। হায় হায়। বাংলাদেশের নিওলিবারাল পুঁজির উচ্ছিষ্টভোজীদের কী হবে? ‘প্রথম আলো’র সুশীল সমাজের কী হবে?
হ্যাঁ, তাঁরা চাইবেন এই সমাবেশ শুধু আওয়ামী ক্যাম্পের সংকীর্ণ দলীয় রাজনৈতিক এজেন্ডা পূরণ করে সুশীল বালক-বালিকার মতো ঘরে ফিরে যাক। তাঁরা চাইবেন এই সমাবেশ শুধু ফাঁসি ফাঁসি করে চিল্লাক। তাঁরা চাইবেন এই সমাবেশ ১৯৭১-এর চেতনায় ‘জনগণের/ জনগণের-জন্য/ জনগণের-দ্বারা’ পরিচালিতব্য বাংলাদেশের রূপরেখা নিয়ে মনোনিবেশ না করুক। কিন্তু সেটুকু না করলে গুটিকয় রাজাকারের ফাঁসি দিতে পারলেই কি একাত্তরের কাক্ষিত বাংলাদেশ পাব আমরা, একাত্তরেরই ঘোষণা মোতাবেক যে বাংলাদেশের মালিক এদেশের জনসাধারণ?
সুতরাং শাহবাগ-সমাবেশকে ভাবতে হবে নতুন ধারার, সত্যিকারের গণমুখী সংগঠন-সংস্থা-সংঘ-সমিতি-প্রতিষ্ঠান-সমাজ-বিন্যাস-কাঠামো নিয়ে। তা নিয়ে অচিরেই কথা তোলা যাবে। আজ শুধু উচ্চারণ করে রাখি: মুখস্ত স্লোগান, গতানুগতিক আইডিয়া আর সংকীর্ণ কথাবার্তার মধ্যে নিজেদেরকে পরিসীমিত করে রাখলে আমরা সরকার-স্পন্সরড, মিডিয়া-তেলে-তৈলাক্ত একটা অসার ফাঁসি-আন্দোলনে পর্যবসিত হবো। তারপর ফাঁসিটাসি শেষ হয়ে গেলে ঘরে ফিরে দেখব আমাদেরই গলায় সেই চিরপুরাতন রাজনীতির ফাঁসটা লেগে আছে: নেতারা পার্লামেন্টের খোঁয়ারে চেঁচাচ্ছেন, পরস্পরকে খুন করছেন, সাগর-রুনির আত্মা হাহাকার করে চলেছে, ক্রসফায়ার-গুম-রিম্যান্ডের বিধান আরও বিকশিত হয়ে উঠছে।
শাহবাগ-সমাবেশকে ঠিক করতে হবে: কী সে চায় আসলে। এর ওপরই আমাদের ভবিষ্যত। ""
ভাল লাগলে মন্তব্য করবেন আশা করি