জঙ্গলরাজ্যে সবাই খুব সুখে আছে। সবাই পেট ভরে খেতে পারে। নিরাপদে চলতে পারে। এমনটাই দেখা যায় সেই রাজ্যের পেপার পত্রিকায়। টেলিভিশনগুলো ও সুখের সংবাদ প্রচার করায় ব্যস্ত।্রোজ সংবাদ সংযোগে জানানো হচ্ছে , রাজ্যের উত্তরপ্রান্তে বাতাবীলেবুর ব্যাপক ফলন হয়েছে, পাকা লেবুর সুগন্ধে ম ম করছে পুরো রাজ্য। বছর ঘুরে জঙ্গলরাজ্যের 'মুক্তি দিবস 'কাছে চলে এলো । এবার ব্যাপক তোড়জোড়ের সাথে মুক্তি দিবস পালনের প্রস্তুতি চলছে । মুক্তি দিবস জঙ্গলের পশুদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অনেক অনেক বছর আগে ভিনদেশী মানুষদের কাছ থেকে জঙ্গলের পশুরা মুক্তি পেয়েছিল সম্মিলিত যুদ্ধের মাধ্যমে। পশুদের ইতিহাসে সেই একবারই সব পশুরা সব ভেদাভেদ ভুলে এক হয়েছিল মানুষের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। কয়েকমাসের জন্য ভুলে গিয়েছিল যে সব পশু আসলে আলাদা । কেউ ঘাস খায়, কেউ মাংস খায়, কেউ দুর্বল , কেউ বা ভীষণ শক্তিশালী। বাঘে মহিষে একঘাটে পানি খেয়েছিল। সবাই এক হয়ে নিষ্ঠুর মানুষের লোভী থাবা থেকে মুক্ত করে নেয় এই জঙ্গল- সব পশুর একমাত্র এবং প্রাণপ্রিয় আবাসস্থল। মুক্তি দিবস তাই জঙ্গলের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা আছে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে জঙ্গলরাজ্যের সূচনা হয়েছিল তা আজও পূরণ হয় নি। কথা ছিল সব পশুর জন্য একটা নিরাপদ জঙ্গল গড়ে তোলা হবে। নিরাপদে জীবন যাপন করার জন্য সব পশু সমান সুযোগ পাবে। হোক সে দুর্বল বা শক্তিশালী। কিন্তু তেমনটা আর হয়ে উঠে নি। জঙ্গলের মুক্তির পর থেকেই জঙ্গল চলেছে বাঘ বা সিংহএর রাজত্ব। রাজা যেই হোক জঙ্গলের দুর্বল নিরীহ পশুদের দুঃখ ঘোচেনি। প্রত্যেকবার রাজা নির্বাচনের পর পরই জঙ্গলের নিরীহ , সংখ্যায় কম পশুদের উপর নেমে এসেছে নির্যাতন আর অত্যাচারের খড়গ কৃপাণ। রাজা যেই হোক , নধর হরিণের কচি মাংসের কাবাবে হয়েছে তাদের অভিষেক। আবার যখন পরের বার রাজা নির্বাচনের সময় এসেছে , তাদের সমর্থনের দরকার হয়েছে তখন তারা হরিণদের সবুজপ্রদেশে গিয়ে মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছে। বলেছে এবার মসনদে বসলে হরিণদের রক্ষা করা হবে, মুক্তভাবে তৃণভূমিতে বিচরণে কোন বিঘ্ন সৃষ্টি করা হবে না। কিন্তু জয়ী হবার পরপরই ক্ষমতাসীন বাঘ বা সিংহ ভুলে গেছে তাদের সেই প্রতিশ্রুতি। কচি হরিণের উষ্ণ রক্তে কন্ঠ ভিজিয়ে ল্যাজগুটিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে বসেছে মসনদে। জঙ্গলে যে শুধু হরিণেরাই কষ্টে আছে এমনটা নয়। আসলে বাঘ-সিংহ আর তাদের পাচাটা কিছু হায়েনা-শেয়াল বাদে জঙ্গলের সব পশুই কষ্টে আছে। যখন বাঘ রাজা হয় তখন বাঘেদের অত্যাচারের সীমা -পরিসীমা থাকে না। পুরো বাঘ জাতটাই জঙ্গলের সব সুযোগ সুবিধা কুক্ষিগত করে রাখে। রাজাবাঘ, মেছো বাঘ , চিতাবাঘ , সাদা বাঘ , কালো বাঘ, গেছো বাঘ - যার নামের সামনে বা পেছনে বাঘ শব্দটা আছে তারা সবাই তখন রাজবংশ। অভিজাত শ্রেণী। কেউ তাদের সমালোচনা করতে পারে না। এমনকি বাঘ শব্দটা থাকায় বাঘঢাশ ও তখন খুব গুরুত্ব পায়। কথায় কথায় কাউকে প্রশংসা করতে ' বাঘের বাচ্চা ' শব্দটা ব্যবহার করতে হয়।
সিংহএর সময়টাতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। রাজসিংহীর কেশরের মত দেখতে লোমের স্টাইল খুব পশুপ্রিয় হয়ে যায়। পা চাটা শেয়াল হায়েনারা পর্যন্ত ঘাস লতাপাতা দিয়ে সিংহীর কেশরের মত উইগ বানিয়ে পড়ে। নিজেদের অভিজাত বানানোর কি জঘন্য চেষ্টা! তখন কথায় কথায় জঙ্গলের পশুদের বলতে হয় ' সিংহের মত সাহস' কিংবা ' সিংহহৃদয় ' এসব।
আসছে মুক্তি দিবসেও জঙ্গলরাজ্যে ভীষণ জাঁকজমক হবে, বিশাল বড় পশুসমাবেশ হবে। অনেক ভাল ভালো কথা হবে। সাম্যের কথা হবে, ঐক্যের কথা হবে , ভ্রাতৃত্বের কথা হবে। কিন্তু জঙ্গলের নিরীহ পশুরা ভাবতে পারেনা তাদের এ দুঃখ থেকে কবে মুক্তি মিলবে!