বইয়ের নাম- সূর্যতামসী
লেখক- কৌশিক মজুমদার
জনরা- ডিটেকটিভ থ্রিলার
প্রথম প্রকাশ- জুন ২০২০
প্রকাশনী- বুকফার্ম
প্রচ্ছদ মূল্য- ২৯৫ টাকা
একসময় গোয়েন্দা উপন্যাসের প্রতি একটা ঝোঁক ছিল। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ, আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস কিংবা রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা পড়ে গোয়েন্দা হওয়ার ইচ্ছা জাগেনি এমন কিশোর পাওয়া দুষ্কর। এসব বই পড়ার লোভে টিফিনের ঘণ্টা কিংবা স্কুলের শেষ ঘণ্টার জন্য যে অপেক্ষা, সেটা ছিল জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সময়। প্রায় অনেকদিন পর একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়তে গিয়ে পুরোনো কথাগুলো মনে পড়ে গেল। শার্লক কিংবা ব্যোমকেশের সাথে তুলনা করব না, কিন্তু বেশ ভাল একটা সময় কেটেছে "সূর্যতামসী" বইয়ের সাথে।
ফ্ল্যাপ থেকে-
“বইতে ব্যবহৃত সকল স্থান, স্থানিক ইতিহাস, গুপ্ত সমিতি, গোপন চিহ্ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও জাদুবিদ্যা সংক্রান্ত তথ্যসমূহ লেখকের জ্ঞানমতে সত্য। বইতে বর্ণিত বেশ কিছু চরিত্র সম্পূর্ণ বাস্তব এবং কয়েকটি ঘটনা সরাসরি সমকালীন সংবাদপত্র থেকে নেওয়া। মূল কাহিনি কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে মিল পেলে লেখক দায়ী নন।“
উপন্যাসের সারসংক্ষেপ -
১২ ডিসেম্বর, ১৮৯২, কলকাতার চিনাপাড়ায় পাওয়া যায় এক অদ্ভুত ধরনের লাশ। লাশের বুকের পাঁজরের নিচে থেকে লম্বালম্বি কেটে পেটটা চিরে দুফালা করা, পুরুষাঙ্গ কেটে নেওয়া। দেখে মনে হচ্ছে কেও সিরিঞ্জ দিয়ে লাশের শরীরের সব রক্ত টেনে নিয়েছে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয়, রক্ত দিয়ে বুকে আঁকা হয়েছে বিচিত্র এক চিহ্ন। এই চিহ্নটা চীনাদের গুপ্ত চিহ্ন, নাম ই-চিং। মোট আট ধরনের চিহ্নের মধ্যে এই চিহ্নের অর্থ হচ্ছে স্বর্গ আর পৃথিবীর মিলন। এই চিহ্নের আরেকটা অর্থ আছে, এক হাজার বাধার মধ্যেও সঠিক পথ।
তার ঠিক পাঁচদিন পরে ঘটে যায় আরো দুইটি খুন। করিন্থিয়ান হলে ম্যাজিক দেখানোর সময় মারা গেলেন চিন-সু-লিন, আত্মহত্যা করলেন প্রধান ম্যাজিশিয়ান কার্টার। সেসময় দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে খুন তিনটি। খুনের ইনভেস্টিগেশনের দায়িত্ব গিয়ে পড়ল প্রিয়নাথ মুখার্জীর হাতে। তার সাথে যোগ দিলেন প্রথম বাঙালি প্রাইভেট ডিটেকটিভ তারিণীচরণ, জাদুকর গণপতি এবং একজন ব্রিটিশ যুবক। চারজন মিলে খুনের আলামত খুঁজতে গিয়ে খুলতে থাকে নানা জট, বের হয়ে আসে চীনাদের গুপ্ত সমিতি, গোপন চিহ্ন সহ চিকিৎসাবিজ্ঞান ও জাদুবিদ্যা সংক্রান্ত চাঞ্চল্যকর তথ্য।
২০ জুন, ২০১৮, তুর্বসু রায়কে খুনের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করল পুলিশ। তিনি পেশায় একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। দেবাশিস নামক এক যুবক মৃত্যুর আগে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন তুর্বসুকে। মেসেজটা কিছুটা ধাঁধার মতন। দেবাশিষের শেষ মেসেজ-
“প্রিয়নাথের শেষ হাড়
মুরের কাব্যগাথা
গণপতির ভূতের বাক্স
তারিণীর ছেঁড়া খাতা
তুর্বসু জানে”
দেবাশিসকে খুন করা হয়েছে সেই ১৮৯২ সালের খুনের প্যাটার্নে। এই হত্যার পদ্ধতির নাম লিং-চি। এর অর্থ সহস্র আঘাতে মৃত্যু। মানুষ জীবিত থাকতেই সারা শরীর থেকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। তারপর তার শরীর থেকে পুরুষাঙ্গ কেটে তার বুকে ছোড়া ঢুকিয়ে তার ভবলীলা সাঙ্গ করা হয়।
উপন্যাসের এই অংশে যুক্ত হয় দুইটা ভিন্ন সময়ের ঘটনা, ব্যবধান প্রায় ১২৬ বছর। দেবাশিসের শেষ মেসেজ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় সে কোনোভাবে ১৮৯২ সালের কেসের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। “তুর্বসু জানে,” কিন্তু তুর্বসু কি জানে! মারা যাবার আগে পুলিশে একটা ফোন না দিয়ে কেন তিনি মেসেজ পাঠালেন তুর্বসুর কাছে? জেনে রাখা ভালো, তারিণীচরণ ছিলেন তুর্বসু রায়ের ঠাকুরদার বাবা। তাহলে কি এই ঘটনার সাথে ১৮৯২ এর হত্যাকাণ্ডের কোনো যোগসূত্র আছে!
পাঠ প্রতিক্রিয়া: বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখকের প্যাঁচানো স্বীকারোক্তি দেখে প্রিয়নাথ, গণপতি, তারিণিচরণ লিখে গুগলে সার্চ দিয়েছিলাম। যারা টুকটাক বই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি তাদের কাছে “প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়” নামটা বেশ পরিচিত “দারোগার দপ্তর” বইয়ের লেখক হিসেবে। তিনি ছিলেন কলকাতা পুলিশের লালবাজার থানার গোয়েন্দা বিভাগের দারোগা। অন্যদিকে “গণপতি চক্রবর্তী” ছিলেন একজন বিখ্যাত জাদুকর। তিনি ছিলেন পি সি সরকার এবং কে লালের পরামর্শদাতা। এইটুকু অংশ জানার পরে ইন্টারেস্ট বাড়তে থাকে বইটার প্রতি। লেখক আরেকটা মাইন্ড গেম খেলেছেন সাইগারসন নামক যুবকের আসল পরিচয় নিয়ে। একের পর এক মাইন্ড গেম আর কিছু সত্য কিছু কাল্পনিকের খেলায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম উপন্যাসটি পড়ার সময়।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০২৩ সকাল ১০:১৬