পর্ব- ১১
********
মানুষের মনের মাঝে চেপে থাকা কষ্টের মানসিক চাপ বিষের যন্ত্রণার চেয়েও ভয়াবহ। মনের ভেতর চাপা রাখা কথাগুলো প্রতিনিয়ত চাপাতির কোপ দেয়। কারো কারো জীবন জুড়ে এমন অসহনীয় কুপানোর হাজারো কুচিকুচি ক্ষত হৃদয়ে বয়ে বেড়ানো ছাড়া করার কিছুই নেই। যদিও কেউ কেউ ভাগ্যবশত অদৃশ্য শক্তির ফলে তা থেকে মুক্তি পেয়ে যায়। আমি মানসিক চাপ সইতে না পেরে কিভাবে আমার স্ত্রীকে আমাদের বাড়িতে রেখে আসতে পারি তার উপযুক্ত সমাধানের জন্য আমি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে শাশুড়ী বানেছা বিবির দারস্থ হলাম।বানেছা বিবি আমাকে আস্বস্ত করলেন যে, তার মেয়েকে বুঝিয়ে লন্ডনে আসার আগ পযর্ন্ত আমার মা বাবার সাথে একসাথে থাকার ব্যবস্হা করবেন। শাশুড়ীর কথায় বেশ হালকা হলাম মনে হলো এবং বিশাল টেনশন থেকে সাময়িক মুক্তি পেলাম। সেদিন রাতে একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়লাম। গভীর রাতের শুনশান নীরবতায় দুটি মানুষের তুমুলঝগড়ার শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুমের ঘোরে আমি যা শুনলাম তাতে পুরো ঘটনাই সিনেমার লোমহর্ষক কাহিনি বলে মনে হলো। যদিও একদিকের কথা শুনে সবকিছুর পরিস্কার চিত্র পাওয়া যায় না তবে কে কোন পরিকল্পিত পথে ধরে হাঁটছে তা বুঝতে পারা যায়। আমি অনেকটাই অবাক হলাম মা- মেয়ের ঝগড়া নাকি দুই কিরনবালা বান্ধবীর মধ্যে ঝগড়া তা মেলাতে গিয়ে। আমার স্ত্রী স্পষ্টতই মাকে বলছে, সবকিছুতে তুমি কেন জাহাঙ্গীরকে নিয়ে আসো? তার সাথে তোমার কি সম্পর্ক তা কি আমাকে বুঝাতে হবে? একটি মেয়ে মায়ের চরিত্র নিয়ে এভাবে বয়ান করছে শুনে সাথে সাথে শরীরের সব লোমকূপ জেগে ওঠে। মনে হলো যেন দুজন মালী একজন আরেকজনের উদ্দেশ্য বলছে আমার বাগানে আমি কি ফুল লাগাবো তা আমি জানি! আর কোন ফুলকে গলার মালা হিসাবে গাঁথবো আর কোনটাকে ছিঁড়ে ফেলবো তা আমার নিজস্ব বাপার তা নিয়ে কথা বলত এসো না ! পুরো রাত মা মেয়ের ঝগড়া চললো আর আমি কানের ও মনের পর্দায় বড় তালা মেরে শুয়ে থাকি। সকালবেলা বাঁধন নিজ থেকে আমাকে বললো,
- তোমাকে একটা অনুরোধ করবো
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম হ্যাঁ বলো -
- আমাদের সংসারে যেকোন সমস্যা যদি দুজনের মধ্যে যদি সীমিত রাখি তাহলে সমস্যা কমবে নতুবা নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হতে থাকবে।
বুঝতে পারছিনা কি বলছো?
- আমি তোমার মা বাবাকে প্রতি সপ্তাহে দেখে আসবো কিন্তু আমাকে তোমাদের বাড়িতে থাকার জন্য অনুরোধ করো না।
আমি কথা না বাড়িয়ে শুধু মাথা নাড়ালাম,, আচ্ছা , যা তুমি ভালো মনে করো।
ছুটি শেষে লন্ডনে ফিরে আসার দু মাসের মাথায় দেশে থেকে যে খবর এলো তারজন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমার প্রাণের প্রিয় মা ইহজগৎ ছেড়ে পারাপারে চলে গেছেন। মায়ের জন্য মনটা হাহাকার করে উঠলো। তেরটি বছর পর মাকে কাছে পেয়েও ভালো করে কথা না বলতে পারারা স্পৃহা ও তৃষ্ণা আমাকে পোড়াতে লাগলো। মনের তীব্র দোহন থেকে মাস খানেক পর মায়ের মৃত্যুর চল্লিশ দিন উপলক্ষে দোয়ার জন্য দেশের উদ্দেশ্য আবারো রওয়ানা হলাম।
বাংলাদেশ বিমানের টকটি ফ্লাইটে সকাল দশটায় দেশে গিয়ে পৌঁছে যাই। বাবা, ভাই ও বাঁধন আমাকে নিতে এয়ারপোর্টে আসেন। আজ মা নেই আর সবি'ই আছে কিন্তু মা ছাড়া এই ভূবন কতটা ফাঁকা তা মনে হওয়াতে শুধু কেঁদেই চললাম। আগের মতোই দিনে শহরতলীতে আমাদের বাসায় আর রাতে বাঁধনের বাসায় আমার থাকা। মায়ের চল্লিশার আগের রাতে বাঁধনকে বললাম,
যেহেতু কাল মায়ের কুলখানি উপলক্ষে দোয়া হবে তাই আজ আমরা দু'জন আমাদের বাড়িতে থাকবো।
- তুমি থাকবে থাকো। আমিতো আর বাড়িতে থাকতে পারবো না।
এটা কোন কথা হলো অনেক আত্নীয় স্বজন আসবে তুমি থাকলে ভালো হয়।
- আমি কি কাজের মেয়ে নাকি তোমার আত্নীয় স্বজনকে রান্না করে খাওয়াবো। নাকি আমি কোন মিসকিনের মেয়ে তুমি আমাকে কুলখানিতে থাকতে বলছো।
কি বলছো এসব? তুমি এ বাড়ির স্ত্রী। তোমার একটা দায়িত্ব আছে না।
- তুমি আসলেই একটা ছোটলোক। তোমার মতে ছোটলোককে বিয়ে করাটাই ভুল ছিলো নইলে এভাবে কুলখানিতে নিয়ে তোমার আত্মীয় স্বজনকে রান্না করে খাবানোর মতো কথা বলার সাহস পেতে না।
ছিঃ, বাঁধন এগুলো কি বলছে? তুমি কি ঠিক আছো?
- নাহ আমি ঠিক নাই ! আমাকে কি কাজের মেয়ে ভাবছো? তোমার মত ছোটলোকের স্পর্ধা আমি দেখিয়ে ছাড়বো।
- ববি..তুই কই? জলদি করে বাসায় আয়, এই ছোটলোককে একটা শাস্তি দিতে হবে। দশমিনিট নয়। এক্ষুনি আয়।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে পাথরের মতো দাড়িয়ে থাকলাম। দাড়াও দেখাচ্ছি ! বাঁধন একাধারে বলেই যাচ্ছে। রাত তখন দুইটা বাজে। আশেপাশের কেউ কথা শুনলেও আসবে বলে মনে হয় না। কিছুক্ষণ পর বাঁধনের ছোট ভাই আমার শালা 'ববি' ঘরে ঢুকলো।
কোন কিছু না জেনেই উচ্চস্বরে গালি দিয়ে বলতে থাকলো,
-শালাকে লাথি দিমু নাকি আপা? নাকি গুলি করে নিচে ফেলে দেবো?
আমি তার হাতে বিদেশি পিস্তল দেখতে পেলাম। তারচোখ আগুনের ফোস্কার মতো লাল হয়ে আছে।
ভাইয়ের কথার মাঝেই বাঁধন বললো এক সেকেন্ড দেরী না করে বের হয়ে যা ? নইলে তোর মৃত্যু নিশ্চিত।
আমি ঘরের মেইন দরজাটা একটু ফাঁকা দেখতে পেলাম। আর পিছনে না তাকিয়ে চোখবুঁজে দৌড় দিলাম। নরকের পিন্ড থেকে রকেট গতিতে বের হয়ে এসে দেখলাম পায়ের গোড়ালি দিয়ে রক্তের স্রোত চলছে। সিলেটের নতুন ব্রীজের আলোয় খেয়াল করে দেখলাম আমার পায়ে কোন জুতা না থাকাতে ইট,পাথরের ঘষায় রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হচ্ছে। মনে মনে বললাম এ এমন কিছুনা সাধের জীবনটা তো রক্ষা হলো। গভীর রাতে হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি এসে দরজায় কড়া নাড়ার আগেই দেখলাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন আমার প্রিয় জন্মদাতা পিতা। বাবাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদতে কাঁদতে কিছুটা হালকা হলাম।
বাবা সবকিছু শুনে মন খারাপ না করে পায়ে বেন্ডেজ দিতে দিতে বললেন তোর মা মৃত্যুর সময় তোর জন্য দোয়া করে গিয়েছে। আমার মনে হয় তোর মায়ের দোয়া কবুল হয়েছে। আর দেরী না করে তুই এখনিই ঢাকায় চলে যা। আর টিকেটের তারিখ পরিবর্তন করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লন্ডন চলে যা। কাল সকাল হওয়ার আগে ওরা থানায় গিয়ে মামলা দিলে পুলিশ তোকে ধরে নিয়ে যাবে। তখন সবই নষ্ট হয়ে যাবে। দেরী না করে চলে যা।
বাবার কথামতো কোন দেরী না করে সকাল হবার আগেই যুদ্ধাবস্হা থেকে ঢাকার পানে রওয়ানা হলাম। ঢাকা পৌঁছে তাড়াতাড়ি করে বাংলাদেশ বিমানের টিকেট অফিসে গিয়ে টিকেটের তারিখ পরিবর্তন করে পরদিন রওয়ানা দিলাম লন্ডনের উদ্দেশ্য। লন্ডন এতদিনের থাকার ঘর শাশুড়ীর ঠিকানা ছেড়ে আবারো 'চিত এন্ড কাত' হোটেলে উঠলাম। লন্ডনে এসে মনে হলো মা কি এমন দোয়া করলো যে বাবা এই কঠিন অবস্থায় এতটা দৃঢ়চেতা মনোভাব নিয়ে অসীম ধৈর্যের সমন্বয়ে সাবলীলভাবে বাঁচার রাস্তা দেখিয়ে দিলেন! বাবা'তো রেগেমেগে আগুন হওয়ার কথা ছিলো ! বাবাকে ফোনে কথাটা কিভাবে জিজ্ঞেস করি? বাবা আবার কি থেকে কি বলে ফেলেন? এইসব চিন্তা থেকে বাবাকে আর কিছু বলিনি। এদিকে লন্ডনে আমার শাশুড়ী বদনাম তুললো আমি নাকি নপুংসক। আমার সেক্সুয়াল ক্যাপাসিটি নেই তাই তার মেয়ের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছি। আমার এবার বুঝতে অসুবিধা হলো না কে এসবের মূলে কলকাঠি নাড়ছে। যে জাহাঙ্গীর ভাই আমাকে সঙ্গীত শিল্পী হতে নিজের সময়, টাকা ব্যয় করলো আজ কোন অজানা কারণে সে আমার ইজ্জত নিয়ে নীরবে কুশীলব হিসাবে ষড়যন্ত্র করে চলছে! একদিকে প্রাণপ্রিয় মা হারানোর অসহ্য যন্ত্রণা তার উপর এইসব নরকের কীটদের যন্ত্রণা আমকে শেষ করেই দিবে। তাদের এখন কথা হলো কাবিনের জন্য যে দশ লাখ দেওয়ার কথা ছিলো তা দিয়ে যেন বিয়ের নিস্পতি করি। যদিও আমার কাছে এই মুহূর্তে কোন টাকা পয়সা নেই তবুও আমাকে এই নরক থেকে বের হয়ে আসতে হবে সেই সাথে আমি যে একজন সক্ষম পুরুষ তা আমাকে প্রমাণ করতেই হবে। এর মধ্যে জাহাঙ্গীর ভাই একদিন আমাকে ফোন করে জানালো আমার সাথে বানেছা বিবির কিছু জরুরি কথা আছে। আমি যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উনার সাথে দেখা করি। আমারও ইচ্ছা একবার দেখা করে আমার নামে রটানো বদনামগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি এবং আমার পাল্টা অভিযোগগুলো বলে চুড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিই। তাই জাহাঙ্গীর ভাইকে বললাম, ঠিক আছে আপনি উপস্থিত থাকবেন আমি আগামী রবিবার বাসায় গিয়ে উনার সাথে দেখা করবো।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:২৫