পর্ব -৮
----------
পারস্পরিক সম্পর্কের পৌরাণিক প্রলেপ মাখা নিয়মের 'আপন'- 'পর' এই দুই ধারাপাত জপতে জপতে অভ্যস্ত মানুষ আমি। হরহামেশাই ভূলে যেতাম রক্তের বাঁধন ছাড়াও কেউ কেউ ধরণীর বুকে আপন হয়ে যায়। অবশেষে বুঝতে পারলাম সম্পর্ক আসলেই ঐশ্বরিক যা মানব মনে গেঁথে যায় আবেগ আর অনুরাগের মাখামাখিতে। এই যেমন বানেছা বিবি নিজের দু'ছেলেকে খেয়ে না খেয়ে অনেক কাঠগড় পুড়িয়ে লন্ডনে নিয়ে এসেছিলেন তাদের উভয়েই এখন বিয়ে করে মা'কে ছেড়ে আলাদা বাসায় চলে গেছে। বিদেশ বিভূঁইয়ে স্বামীহারা ও সন্তানদের চরম অবহেলার স্বীকার হয়ে যখন বানেছা বিবির চরম দুঃসময় ঠিক সেই সময়ে সন্তানের উপযুক্ত আদর সমাদর থেকে কোনভাবেই এই বঙ্গমাতাকে বঞ্চিত হতে দিলাম না। এই আমি হয়ে উঠলাম বানেছা বিবির একমাত্র ছেলে। একান্ত বাধ্যগত ছেলের মতো বানেছা বিবিকে মা'য়ের মতো আদর,সমাদর, সেবা যত্ন করতে লাগলাম । যদিও বানেছা বিবি কোন ভনিতা ছাড়াই আমার চোখের সামনে মাছের মাথা কিংবা গোশতের বড় টুকরোটি জাহাঙ্গীর ভাইয়ের পাতে তুলে দিতেন। আমি কষ্ট করে রান্না বান্না করে মন যোগাতে একপ্রকারে অপারগ হয়ে গেলাম। মানুষের মন জয় আর এভারেস্ট বিজয় যে একই বিষয় তা সেই সময় হলফ করে বুঝতে পারলাম। চাপা কষ্টের আঘাত সহ্য করেই চলেছে সাধের লন্ডন জীবন ৷ বেয়ারা কষ্টগুলো ভুলিয়ে দিতে মা'কে পেতাম সবসময় অনুপ্রেরণার বাতিঘর হিসাবে।
মা বলতো বিদেশে ভালো না লাগলে দেশে চলে এসো আমাদের যা আছে তা দিয়ে চলে যাবে ৷আর যদি না আসতে চাও তবে ধৈর্য ধরে থাকো একদিন সব হয়ে যাবে ৷সময়মতো সবকিছু হয়ে যাবে। একদিন তুমি লাল পাসপোর্ট পেয়ে যাবে। মায়ের কথামত সময়ের সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বেলে আমি হররোজ বিদেশের অন্ধকার পথে চলতে থাকি। সময়ের সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ তখনই বুঝা যায় যখন শরীরে সঞ্চারিত হয় অসুখের বীজ । সময় গড়ার সাথে সাথে আমার হবু শাশুড়ী বানেছা বিবির শরীর দিন দিন খারাপ হতে লাগলো। একসময় তিনি স্বাভাবিকভাবে চলতে ফিরতে অক্ষম হয়ে গেলেন। বেনিফিটের টাকায় সংসার চলে না। আমি যা রোজগার করি তা বানেছা বিবির সংসার, বাঁধনের জন্য সলিসিটর ও ইউকে তে আবেদন, নিজের কেইসের এ্যাপিলের জন্য সলিসিটরের ফিস। আর তার উপর প্রতিমাসে হবু স্ত্রীর হাত খরচের টাকা পাঠানো যেমন একটা নিয়ম ঠিক তেমনি শাশুড়ীকে ডাক্তারে নিয়ে যাওয়া, ঔষধ পথ্য খাওয়ানো, এছাড়া আমার শাশুড়ীর জন্য প্রতিদিন রান্না করা, কাপড়চোপড় ধোয়া এইসব রুটিনের দৈর্ঘ্য প্রস্ত শুধু বাড়তেই থাকলো। রুটিনমাফিক মানব সেবা দিতে দিতে যাদের হাত ধরে পৃথিবীর বুকে মানব হয়ে বেড়ে ওঠলাম সেই সাত রাজার ধন নিজের মা বাবাকে নূন্যতম খরচের টাকা পাঠানোর সামর্থ্য হতো না !
বছরের পর বছর যায় বাঁধনের ইউকে তে আসার বাঁধা শেষ হয় না। এ্যাপলিকেশন আর সাফল্যের মুখ দেখে না। আশার আলোকবর্তিকায় কাঁচা পয়সার পুঁটলি নিয়ে সলিসিটর ফার্মে আলো জ্বালতে লাগলো আর আমার জীবনে লালবাতি জ্বলতেই থাকলো। বিলেতের মাটিতে পরিচিত অনেকেই আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতে লাগলেন। আমি এমনিতেই এদেশের মেয়েদের পোশাক,চলাফেরা অবাধ মেলামেশা, সিগারেট ও নেশা করা দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। আর অন্যদিকে নিজের প্রতিজ্ঞায় হিমালয় সমান দৃঢ়তা নিয়ে অকুতোভয় দুঃসাহসী বীরের মতো মনে মনে ভাবলাম কোন লোভই ভাঙতে পারবেনা পরমানন্দের এই সম্পর্কে বাঁধন। আশার সলতেতে বাঁধা মঙ্গল দ্বীপ একদিন জ্বলজ্বল করে জ্বলবেই। পরম বিশুদ্ধ বিশ্বাস নিয়ে বাঁধনের জন্য আমার আরাধনা চলতেই লাগলো।
আমার মতো ভার্জিন হবে আমার হবু স্ত্রী বাঁধন। আজ হোক কাল হোক একদিন আমাদের সফল পরিণয় হবেই। আর এভাবেই প্রতিজ্ঞা আর প্রতিক্ষার এক যুগ পরিয়ে গেলো। জীবনের সোনালি হরফে লেখা স্বাদ আহ্লাদের সময়গুলি এভাবেই বছরের পর বছর গড়িয়ে চলছিলো। এভাবেই কেটে যাচ্ছে সময়, কেটে যাচ্ছে পরবাসের বনবাসী আমার মধুর মিলনের অস্হির দিনরাত্রি। এতকিছুর পরও মাঝে মধ্যে কাজ থাকতো না। তখন নতুন কাজ যোগাড় করার জন্য হাহুতাশ শুরু হয়ে যেতো। এদেশে হোম অফিসে কোন আবেদন না থাকলে যেকোনো সময় ইমিগ্রেশন পুলিশ কান ধরে দেশে পাঠিয়ে দিতে পারে এই ভয়ে হিউম্যান রাইটসের এ্যাপলিকেশন কয়েকবার রিফিউজ হওয়ার পরও একটার পর একটা আবেদন করে আছি যাতে থাকার জন্য কোন সমস্যা না হয় ৷আমার শেষবারের আ্যাপিলটি অনেকদিন থেকে ঝুলে আছে। কিছু দিন পর পর সলিসিটর ফোন করে এই কাগজ সেই কাগজ এসব করে পাউন্ড নেওয়ার ফন্দি করে। আমিও কোন উপায়ান্তর না পেয়ে বাধ্য হ'য়েই যেভাবে ম্যানেজ করতে পারি সেভাবে কিছু পাউন্ড সলিসিটরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আসি। আজ হঠাৎ সলিসিটর ফোন দিয়ে খুব জরুরি ভিত্তিতে তার অফিসে যেতে বললেন....
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সকাল ৭:৩১