পর্ব - ০১-০২
পর্ব ০৩-০৪
পর্ব -০৫
পর্ব-0৬
পর্ব -০৭
অস্বাভাবিক কোন কিছু স্বাভাবিক ব্যাপার হিসাবে মেনে নেয়া একটি আর্ট আর সেক্ষেত্রে আমি মনে হয় একজন দক্ষ আর্টিস্ট। মানব চরিত্রের একটা মস্ত বড় গুণ হলো পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নেওয়া। যদিও কাজটি সবাই সমানভাবে করতে পারে তা নয়। এ প্রসঙ্গে নিজের কথা বলতে একটু ইতস্তত লাগছে। তবুও বলি ছোট থেকে বাবার মুখে কথাটি এত বেশি বার শুনে এসেছি যে যেকোন প্রতিবন্ধকতাকে মানিয়ে নিতে আমার তেমন কোন অসুবিধা হয় না। সময়ের সাথে বেড়ে ওঠা আমার এই পরিবর্তন নিজে থেকেই অনুধাবন করি। বাবা প্রায়ই বলতেন আমি আজ আছি তো কাল নেই, কাজেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে সংগ্রামশীল ও সহিষ্ণু হতেই হবে।লন্ডনে শাশুড়ির বাড়িতে যে কারণে ফুফাতো ভাই জাহাঙ্গীর সাহেবকে কারণে-অকারণে আসতে দেখে আমার মধ্যে কোন দিন কোন প্রশ্ন বোধ জাগে নি। তাই বলে ওনার আগমনের উদ্দেশ্য যে আমি বুঝতাম না, তা নয়। সামনাসামনি হঠাৎ দেখা হলে চূড়ান্ত ব্যস্ততা দেখিয়ে মুখে এক ঝলক হাসি প্রদান করে গন্তব্যস্থানের লক্ষ্যে পা বাড়াতাম। কিন্তু সেদিন সময়টি পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ঠিক উপযুক্ত ছিলনা। একটা বিশেষ কাজে আমিও গেছিলাম শাশুড়ির সঙ্গে দেখা করতে। গিয়ে দেখি জাহাঙ্গীর ভাই সোফায় বসে আছেন। জাহাঙ্গীর ভাইকে অগত্যা আমার শাশুড়ীর সাথে গল্প করতে দেখে মনে মনে ভিরমি খেলেও স্বভাবসুলভ গম্ভীর কণ্ঠে সালাম দিলাম। কুশলাদি বিনিময় করে নিজে উপযাচক হয়ে বলতে লাগলেন,
- তোর শাশুড়ি কয়েকদিন আগে দেশে টাকা পাঠানোর জন্য আমাকে ডেকেছিলেন। এই মুহূর্তে একটু চাপ কম থাকায় ভাবলাম আজই টাকাটা নিয়ে আসি। উনি অসুস্থ মানুষ আমার অফিস কষ্ট করে যাওয়ার কি দরকার !
- তবে তো ভালোই হলো। আপনার মাধ্যম টাকা পাঠালে তো কোন ঝামেলা হবে না।
তা এক হিসেবে ঠিক বলেছিস।তো তোর খবর কি বল? একা একা সময় কাটছে কিভাবে?
-না না একা থাকলেও যথেষ্ট কাজ আছে। কাজ নিয়েই সময় কেটে যায়।
-আরে! বিয়ে করলেও তুই হলি ব্যাচেলর মানুষ। সময় পেলেই তো আমার বাসায় চলে আসতে পারিস। সেদিন তোর ভাবি তোর কথাই জিজ্ঞেস করছিল। বলছিল ছেলেটা সেই যে গেল তারপর থেকে আর কোনো খোঁজ নেই। আমি কোনো খোঁজখবর নিয়েছি কিনা ও আবার আমার কাছে সেটা জানতে চাইছিল।
-তাই ?ভাবি আমার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন? ধন্যবাদ ভাবিকে। আমার সালাম পৌঁছে দেবেন।
-তো বল কবে আসছিস আমার বাসায়?
-জ্বি ভাই যাব। নিশ্চয়ই একদিন যাব।
- আজ আমাদের একাকার ছেলে তমিজ উদ্দিন কে পেলাম সোতো বিরাট মৌলানা হয়ে গেছে।
- এদেশে তোর মতো সবাই এক কাজ নিয়ে বসে নেই। তুই তো চাইলে অন্য কিছু করতে পারছ।
- আমিতো একসময় গান করতাম ! আবার কি গান শুরু করবো?
- গুড গুড, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, তুই গানটা আবারো শুরু কর।
- তুই তো ভালো করে জানার কথা এদেশ বাঙালী গায়কের অভাব।
- তাহলে কি তমিজ মৌলভীর মতো আমিও গায়ক বুলবুল হয়ে যাবো !
এরপর জাহাঙ্গীর ভাই যেন আমার কাছে দৈব আশীর্বাদ হয়ে এলেন। কোন কারণে, কোন সাধে আমাকে এতে সময় দিতে লাগলেন মাথায় এলো না। প্রতিদিন আমার রুমে এসে বন্ধুর মতো রিহার্সেলে সহযোগিতা করেন। আমাকে নিজ টাকায় একটা হারমোনিয়াম ও গিটার কিনে দিলেন। তার পরিচিত সবাইকে ফোন দিয়ে আমার পরিচয় তুলে ধরলেন। এমনি করে সময় গড়ার সাথে সাথে পরিচিত, অপরিচিত কেউ কেউ ঘরোয়া পার্টি, বিয়ে শাদি, ষ্টেজ শো, অডিও, ভিডিও সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পারফরম্যান্সের জন্য ডাক পরতে লাগলো। আধুনিক ও ফোক গানে আমার জনপ্রিয়তা শুরু হয়ে গেলো। এরিমধ্যে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের মাধ্যম একটি টিভি চ্যানেল থেকে ডাক পেলাম। প্রথম গানেই হিট হয়ে গেলাম। নিজের লেখা ও সুর করা গানটি বিলেতে মুখে মুখে রটে গেলো। আমি হয়ে গেলাম বিলেতের গানের জগতের বাদশা বুলবুল। সবাই আমাকে দেখলেই আমার জনপ্রিয় গানের কলি বলে ---
সবিতা.......অহঅ সবিতা.....
এ জীবনটা যেন কষ্টের গীতিকবিতা!!
পাহাড়ি ঢল বয়ে চলে দু'চোখের পাতা
সর্বনাশা এ স্রোত হায় বাঁধা মানে না....
হৃদয়ে জমা রয় না-বলা কষ্টের শ্লোক গাঁথা ....
সবিতা,অহহ সবিতা....
এ জীবনটা যেন কষ্টের গীতিকবিতা!!(ঐ)
সবিতা... অহহ সবিতা... এ জীবন যেন কষ্টের গীতিকবিতা!!
হীরা জহরতে মোড়া তোমার শহর জানি অনেক দামী,
আমার শহরে বয়ে চলে বেদনার সুনামী...
যে দিকে তাকাই দেখি শুধু ঘোর শূণ্যতা.....
মন মনজিলে পুষে রাখি হায় যত ব্যাথা.......
সবিতা অহ সবিতা... এ জীবন যেন কষ্টের গীতিকবিতা!!
পাথর চাপা বুকে এ পথচলা যে বড়ই সকরুণ...
নিয়তি বরণ করে জীর্ণদশা চলছে নিদারুণ ...
ভুল করে পৌঁছাবে কি এই আরাধনা.. ওগো দেবী প্রতিমা.. ..
আসবে কি আবার কভু নিয়ে সুখের সুবার্তা...
সবিতা অহ সবিতা... এ জীবন যেন কষ্টের গীতিকবিতা!
জাহাঙ্গীর ভাই পরিবারের সদস্যের মতো বানেছা বিবি ও আমার কাছে অতি আপন হয়ে গেলেন। একসাথে খাবার থেকে শুরু করে গান বাজনা সবিই চলে। আমি বাসায় না থাকলেও বানেছা বিবির সাথে গল্প করেন। আমি চোখ ও কানকে শিকল পড়িয়ে রাখি। কি কি করলো তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। যা দেখি তার সবটাই দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় না, যা শুনি তার সবটাতে মনোযোগ দেই না।.......
কোন জিনিস সহজ নয় আর স্হায়ী হয় না। মানুষের রুপ,যশ, সম্পদ সবকিছু ক্ষণস্থায়ী যা একসময় আপনা আপনি হারিয়ে যায় আর কেউ কেউ অসময়ে সুখগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিতে দ্বিধাবোধ করে না। কোন এক অজানা অদ্ভুত ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া আমি খুব সহজেই নিজের শিল্পী জীবনের রাজ- রাজর্ষী থেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করলাম। একবার লন্ডন থেকে দুরের শহর কার্ডফে যাচ্ছি উদ্দেশ্য সেখানি বাংগালী বৈশাখী মেলায় পারফরম্যান্স করা। একটি প্রাইভেট কারযোগে আমরা পাঁচজনের একটা টিম যাচ্ছি। কিবোর্ড আর্টিষ্ট বাদল ভাই নিজের গাড়ি ড্রাইভ করছিলেন । সিনিয়র আর্টিষ্ট ওবায়দুল ভাই সামনের সিটে বসে আছেন । দুইজন নারী সহশিল্পীর সাথে আমি পিছনে বসলাম। আমার পাশে বসা সুরভী চৌধুরী নামক শিল্পী। তার কড়া পারফিউম সুমিষ্টঘ্রাণ ও রক্তজবা লিপষ্টিকে দুই ঠোঁটের পাড় বেয়ে ফুলেল হাসি খুব সহজেই যেকোন পুরুষ মনে আঘাত দিতে পারে। আমার পাশে বসে টুকটাক কথা বলার পর দেখলাম তার বাহুতে আমার বাহুর সাথে ম্যাগনেটিক কানেকশন চালু হয়ে গেছে ৷ এত কাছাকাছি আর ঘেঁষাঘেঁষিতে আমার অবস্থা বৃষ্টিতে ভেজা শকুনের মতো হয়ে গেছে। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না ? একে'তো সব শিল্পীদের সাথে সম্মান ও চক্ষু লজ্জা তারপর কেউ মুখ ফোটে কিছু বললে কি মনে করে? এসব চিন্তা করতে করতে কোনভাবে যাবার রাস্তা শেষ হলো ৷পারফরম্যান্স করে আসার সময় তারচেয়েও খারাপ অবস্থা। একদিকে মটোরওয়ে ধরে হাইস্পিড গাড়ির শব্দ তার উপর অন্ধকার রাতের জার্নি যা কামুক মনে উঞ্চতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। সুরভি চৌধুরী আমাকে বললেন তার বাসায় যাওয়ার জন্য। তিনি একাই মেয়েকে নিয়ে থাকেন। স্বামী দু বছর হলো সাথে নেই । আমি বিনয়ের সহিত তার পস্তাব ফিরিয়ে দেয় কিন্তু কিছুক্ষণ পর তিনি আমার কাঁধে হেলেন দিয়ে আরামে ঘুমিয়ে পড়লেন। সেদিনের পর থেকে গানের জগতকে ইতি দিলাম ৷এই শিল্পী জীবনে অনেকেই এমন খোলামেলা প্রসৃতবাক্য ছুড়ে দিয়েছিলে কিন্তু সবিই হাসিমুখে ফিরিয়ে দিয়েছে। তার কারণ আমাকে ভালে থাকতে হবে। ভালো থাকতে হবে আমার বাঁধনের জন্য । কিন্তু মনে শংকা আর সংশয় চলে এলো এভাবে চলতে থাকলে একদিন না একদিন আমার প্রাইড নষ্ট হয়ে যাবে। বাঁধনের কাছে ছোট হয়ে যাবো। আমি এসব করলে বাঁধনওতো করতে পারে ! আমার সহাবস্থান হোক সাদার সাথে তাহলেই কালোর সাথে সহবাস থেকে বিরত থাকার শুদ্ধতা চর্চার সুযোগ আসবে। নিজেকে ভালো রাখি ভালো সঙ্গী পাওয়ার জন্য এই মূলমন্ত্র নিয়ে যবনিকা হলো আমার শিল্পী জীবনের।.........
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১৯ রাত ১১:৩২