পর্ব- ৬
পর্ব - ০১-০২
পর্ব ০৩-০৪
পর্ব -০৫
অধীবাসী জীবনের শুরুতেই যার পরিবার পরিজন নেই তাকে প্রচন্ড বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। আর যার এক্কেবারে প্রথম পর্বে থাকে একটি যুৎসই ঠিকানার ব্যবস্থা করা। বাস্তব অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, দুবেলা খাবার যোগানো বা ছোটখাটো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা কথাটা এখানে যতটা না ঝঞ্ঝাটের তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দুশ্চিন্তার হল অফিসিয়ালি চিঠিপত্র আদান প্রদানের জন্য নিরাপদ স্থানের ব্যবস্থা করা।অনেক সময় দরকারী চিঠি আসার জন্য একটা ঠিকানা খুঁজে পাওয়া আর গভীর প্রবালে নুড়ি পাওয়ার সমান হয়ে যায়। এ দেশে পদার্পণের পূর্বে বিষয়টি অবগত থাকায় অহেতুক হয়রানি না হয়ে একদম শুরুতে সে দেশে অবস্থানরত আমার ফুফুতো ভাই জাহাঙ্গীর কবিরের শরণাপন্ন হই। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ও দুই সন্তানের জনক জাহাঙ্গীর কবির ভাই অবশ্য আমাকে নিরাশ করেননি। ফলে ফুফুতো ভাইয়ের মাধ্যমে আমি প্রাথমিক সংকট থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছিলাম। যদিও বিয়ের পর আমি আমার ঠিকানা বদল করি।শাশুড়ি মায়ের ঠিকানাকেই আমি স্থায়ী ঠিকানায় পরিণত করি। এহেন পুরানো ঠিকানাতে ব্যাংক থেকে একটি চিঠি এলে ভাই চিঠিটি হস্তান্তরিত করতে আমার বর্তমান ঠিকানার উদ্দেশ্যে আসেন। তিনি একটা ছোটখাটো ভ্রমণ সংস্থা দেখাশোনা করেন। উল্লেখ্য আমার বিয়ের সময় ভাই পেশাগত ব্যস্ততার কারণে উপস্থিত থাকতে পারেননি। কাজেই আজি শাশুড়িমা বানেছা বিবির সঙ্গে ভাইয়ের পরিচয় করিয়ে দিলাম। কথা প্রসঙ্গে শাশুড়ি মা উল্লেখ করলেন কিছুদিন আগে উনি একটি ভ্রমণ সংস্থা থেকে এয়ার টিকিট কিনেছিলেন। আজ প্রসঙ্গক্রমে বেরিয়ে এল সেদিনের সেই ভ্রমণ সংস্থাটি আমার ভাইয়ের, যার প্রোপাইটার এখন শাশুড়ি মায়ের সামনে দণ্ডায়মান।দুজন দুজনাকে আবিষ্কার করে রহস্যময় হাসি বিনিময় করলেন। আমি মূর্তির মতো পাশে দাঁড়িয়ে বিষয়টি বেশ উপভোগ করলাম। ভাইয়ের সঙ্গে আমার শাশুড়ি এমন আন্তরিক ও হৃদগত ব্যবহারে মুগ্ধতার পাশাপাশি কিছুটা আশ্চর্য হলাম। আমার শাশুড়ি ডিনারের জন্য উনাকে বেশ করে অনুরোধ জানালেও ভাইয়ের পক্ষে আর সময় দেওয়া সম্ভব ছিল না। অন্য একদিন এসে ডিনার করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চা- পর্ব শেষ করেই উনি বিদায় নিলেন।
এদিকে কাজের শেষে বিকাল বেলা বাসায় গিয়ে খাওয়া দাওয়া ও আনুষঙ্গিক কাজ সেরে প্রতিদিন বাঁধনের সাথে ফোনে কথা বলাটা আনার রুটিনের মধ্যে বেঁধে গেলো। সময় শেষ হয় রাত শেষ ভোর হয় কিন্তু বাঁধনের সাথে কথা বলে শেষ হয় না। একজন অচেনা নারী কতটা মায়াবী আর আদর্শবান হয় তা বাঁধনের সাথে কথা না বললে বুঝতে পারতাম না। দূরে থেকেও সে যেন থাকতো হৃদয়ের কাছাকাছি এক অতন্দ্র প্রহরী হিসাবে। সবসময় আমার খবর নেয়া,শরীরের যত্ন নিতে বারবার আদেশ, উপদেশ এগুলো নিত্যকার জীবনের পথে মসৃণতা এনে দিতো। মাঝে মধ্যে অবশ্য মা-বাবা,আত্নীয় স্বজনের খবর নেয়া এভাবেই সময়গুলো চলে যাচ্ছে। বাঁধনের ভিসার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা,তারসাথে স্বপ্ন দেখা এই যেন জীবনের একঘেয়ে রুটিন।
সপ্তাহ দুয়েক পরে ইস্ট লন্ডন মসজিদে মাগরিবের নামাজ শেষ করে বাইরে আসছি পথিমধ্যে কেউ একজন আমাকে পিছন থেকে ডাকার শব্দ পেলাম। আমি প্রথম দেখাতেই চিনতে না পেরে থমকে গেলাম। মাথায় লম্বা টুপি আর গালভরা দাঁড়ি। পরিচয় পর্ব শেষ বুঝলাম সে আমাদের এলাকার তমিজ উদ্দিন। আমি অবশ্য মজা করে তাকে তাবিজ উদ্দিন বলতাম। এলাকায় প্রায় সময় সে তাসের আড্ডা মগ্ন থাকতো। এককালে লোকটি কলেজ পড়ুয়া ছিলো কিন্তু এখন কেউ দেখলে বুঝতে পারবেনা লোকটি কলেজ পড়েছে। এখন কি করছো? তমিজ ভাই আমি বিনয়ের সহিত জানতে চাইলাম। সে উওরে যা বললো তাতে আমার বোধের রাজ্যে কাঁপুনি শুরু হলো। সে নাকি বিভিন্ন বাঙালি ঘরে গিয়ে বৃটিশ বাঙালি ছেলেমেয়েদের আরবী টিউশন দেয়। এতে করে তার মাসে তিন থেকে চার হাজার পাউন্ড আয় হয়। এখন পর্ব দিগন্তে সূর্য ওঠে। কি বলে লোকটি? যে লোক কোনদিন মাদ্রাসায় যায়নি সে এখন পুরোদস্তুর মৌলভী। বিদেশে সবি সম্ভব । আমি কৌতূহল চেপে না রেখে বলেই ফেলললাম-
- জীবনে তো আপনাকে মাদ্রাসায় পড়তে দেখলাম না !
- তো কিভাবে মৌলভী হয়ে শিশুদের ইসলামি মূল্যবোধ,আকিদা, সালাত, সংযম এসবের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পাঠদান করে চলছেন !
- আরে, সময় হলে সবি বুঝবে মিঃ বুলবুল।
- একসময় তো তুমি আমাকে তাবিজ উদ্দিন বলতে তা হয়তো তোমার দোয়া লেগে গেছে।
- কথায় বলে কোন স্থান ও কালে যা অবহেলার অন্য স্থান ও কালে তাই পূজনীয় তাই অহমিকার।
- বৃটেনে ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত লোকের সংখা কম তাই আমার মতো আনখোড়া লোক সহজেই মৌলভীর খেতাব পেতেই পারি।
- কোন দেশ ও স্থানে কোন জিনিসের অভাব বা অপ্রতুলতা হলে তার কদর বেশি আর তাতে সুযোগসন্ধানীরা লাভবান হয় ।
- তমিজ উদ্দিনের কথাটা বেশ মনে ধরলো।
তার মোটিভেশনাল কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ঘরে ফিরে এলাম। ঘরে এসে আমিতো নিতান্তই অবাক। যে ভাই একান্ত জরুরী প্রয়োজন ছাড়া আমার সাথে কথা বলেনা। দেখা করে না। সেই জাহাঙ্গীর ভাই আমার শাশুড়ীর সাথে খোশমেজাজে গল্প করে চলছে। আমাকে দেখে দুজনেই বেশ ইস্তহস্ত বোধ করলো !
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ রাত ১:০৩