পর্ব -০৫
বানেছা বিবির রুমে ঢুকে আমার চোখ ছানাবড়া! পেল্লাই আকারের ঘরের ভিতরটা সুন্দরভাবে পরিপাটি করে সাজানো। কিছুটা ইতস্তত করে ভিতরে ঢুকছি দেখে নিজেই বলতে লাগলেন,
-গৃহসজ্জা আমার হবি। কোথাও ঘুরতে গেলে আমি আগে দেখি সেখানে অন্দরসজ্জার কি কি উপকরণ আছে।
আমি অনেক কথা শুনতে শুনতে উনার কথা ও কাজের মিল খুঁজে পেলাম। চোখ জুড়িয়ে চারপাশটা দেখতে লাগলাম। কি নেই ঘরের মধ্যে! ছিমছাম ডাবল বেডের খাটটি জানালার কাছে স্থাপন করা। একেবারে ডানদিকে দেওয়াল জোড়া ওয়ারড্রব মাঝে একটি টি সেট, দুদিকে দুটি সিংহের হাতলের চেয়ার। বাম দিকে দেওয়াল লাগোয়া সোফা কাম বেড।বেডের উপর আবৃত সুদৃশ্য ভেলভেটের কভারটি দেখে মনে হল আজই যেন বাজার থেকে আনা হয়েছে। এরকম সুসজ্জিত ঘরে ঢোকার সৌভাগ্য আগে কখনো আমার হয়নি। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কোন স্থানে গিয়ে বসবো। আমার মনের দ্বিধাগ্রস্ততা বানেছা বিবির চোখে ধরা পরলো। ঈষৎ গলা পরিষ্কার করাতে চোখাচোখি হতেই সোফার দিকে ইশারা করে,
-ওখানে বস।
আমি বাধ্য ছেলের মতন মুশকিল আসান পেয়ে সোফাতে গিয়ে বসে পড়লাম। অনেকদিন আগে কোন এক ফিল্মে দেখেছিলাম সোফার উপর বসে এক অ্যাক্ট্রেস পায়ের উপর পা দিয়ে অপরের সঙ্গে কথা বলছেন। চোখের সামনে সেই চিত্রটি ভেসে উঠলো। এক্ষেত্রে আমার বাসায় ভঙ্গিমাটি কেমন হবে তা ভেবে বেশ সংশয়ে পড়লাম।বানেছা বিবির সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসা সংগত হবে কিনা যখন ভাবছি তখনই হঠাৎ উনি বলে উঠলেন,
-কি ব্যাপার! এমন গুটিসুটি মেরে বসে আছো কেন? আমি আড়াল থেকে দেখেছি তুমি বেশ সপ্রতিভ।
-না না এইতো আমি ঠিকই বসেছি, বললেও বেশ লজ্জা পেয়ে বসে ভঙ্গিমাটি বদলালাম।এবার অবশ্য উনি মুখে কিছু আর বললেন না। কিন্তু উনার চোখে মুখের ভঙ্গিমা বলে দিয়েছিল যে আমার বসার ধরনটি এবারও ওনার কাছে স্বাভাবিক লাগেনি। একসময় দেখতে পেলাম বানেছা বিবি তার বেডসাইড ক্যাবিনেট থেকে একটা প্লাস্টিকে মোড়ানো প্যাকেট বাহির করলেন। আমি ভাবলাম রুমে ডেকে মনে হয় কোন গিফটের বক্স আমাকে উপহার দিবেন। কিন্তু পরক্ষণেই দেখি ভ্রম,পুরো বাক্সেটি ঔষধের ডোজ দিয়ে সাজানো। তিনি আমাকে এসব দেখিয়ে বলতে লাগলেন, তার শরীরে কি কি অসুখ বাসা বেঁধে আছে ? কিভাবে তার স্বামী বিয়ের পর বছরের পর বছর তাকে দেশে একাকী কষ্টে ফেলে রেখেছিলো ? আর এখন তার দেশে থাকো একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তার যত দুশ্চিন্তা ! অনেক টাকা ইতিমধ্যে খরচ করেছে ফেলেছেন ছেলেমেয়েদেরকে বিলেতে নিয়ে আসার জন্য। যদিও বড় দুই ছেলের ভিসা হয়, কিন্তু মেয়েটাকে এ্যাপিলে দেওয়াতে দুশ্চিন্তা বেড়ে গেছে। হাজারটি কারণের বড় কারণ হলো মেয়েটা যে বড় হচ্ছে। তবে, তিনি শতভাগ আশাবাদী মেয়েটার ভিসা হয়ে যাবে। একসময় তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন, দেশে আত্নীয় স্বজনের অনেকেই মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু তিনি তার মনের মতো একটা ছেলের কাছে মেয়েকে তুলে দিতে চান। তার নিজের জীবনের মতো যেন মেয়েটার জীবন দূর্বিষহ না হয়। তার মতে,আমিই নাকি তার দেখা সবচেয়ে উপযুক্ত ছেলে তার মেয়ের জন্যে। আর আমি যদি রাজী থাকি তবে শীঘ্রই ফোনে সবকিছু ঠিক করে দিবেন। মেয়ের ভিসা হয়ে এদেশে চলে আসলে আমারও লিগ্যাল হওয়ার পাকাপোক্ত ব্যবস্হা হয়ে যাবে। বানেছা বিবির কান্নাজড়িত কন্ঠে এসব শুনে নিজেকে সামলে নিতে কষ্ট হলো। একদিকে বানেছা বিবির দুঃখে বেশ দুঃখবোধ জাগলো অন্যদিকে নিজের কথা ভেবে বেশ সুখী লাগলো। বানেছা বিবি অবস্থা দেখে ভাবলাম ,পৃথিবীতে মানুষকে বাহ্যিক সৌন্দর্য অবলোকন করে তার ভেতরের তীব্র দাবানল কেউ কি কখনো অনুধাবন করতে পারে ! সবকিছু শুনে বানেছা বিবিকে এক সম্মানিত ও মহীয়সী নারী হিসাবে হৃদয়ে স্থান দিলাম। তার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে গেলো । শরীরের খাঁড়া লোমগুলো কখন যেন হিমায়িত চিংড়ির ন্যায় মুচড়ে গেলো তা বুঝলাম না শুধু বরফের শীতলতা অনুভব করলাম।
বানেছা বিবির কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে, কোন প্রকার ভাবনা চিন্তা ছাড়াই বাংলাদেশে থাকা বানেছা বিবির কলিজার ধন, একমাত্র আদরের দুলালি, বাঁধনকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেলাম। আবেগপ্রবণ আমি কিছুতেই আর দ্বিমত করতে পারলাম না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম,যা আছে নসিবে, আল্লাহ যা করে তাই হবে। এমনকি মা-বাবাকে না জানিয়েই বানেছা বিবির কথামতো হাসিমুখে কবুল বলে ফেললাম। আমার হ্যাঁ সূচক কথা তার কাছে অম্লমধুর মনে হলো। তিনি আকাশ পাওয়া’র মতো বিশাল হাসি হাসলেন। এমনিতেই কারো হাসি দেখলে নিজের কাছে বেশ প্রশান্তি লাগে আর তা যদি হয় আমার জন্যে! তাই নিজেকে বেশ ভাগ্যবান মনে করলাম। ভাবখানা এমন যেন রাণী ও রাজ্য দুটো পেয়ে গেছি ! বানেছা বিবি আবারো অভয় দিয়ে বললেন এটা শতভাগ নিশ্চিত তার মেয়ের ভিসা হয়ে বৃটেনে আসবে। সলিসিটর বলেছে তার মেয়ে 'মা-বাবার' রাইটে বৃটেনে আজ হোক কাল হোক আসতে পারবে। আর বাঁধন এদেশে চলে আসার পর আমিও লিগ্যাল হয়ে গেলে তিনি শান্তি পাবেন। এ যেন মায়ের আচলে মুখ রেখে সবচেয়ে কঠিন সময়ে পরম বিশ্বস্ততায় জড়িয়ে ধরে চুমু দেওয়ার মতো, আমিও লাল পাসপোর্টর আশায় আকাশ সমান বুকের ছাতি নিয়ে স্বপ্নসাগরে ভাসলাম ! কিন্তু তা কি সত্যি না লাটাই ছাড়া ঘুড়ি তা'কে জানে ! এবার বাঁধন চলে আসলে আমিও একটি লাল পাসপোর্টের মালিক হয়ে যাবো ! আমার মা'কে সবকিছু বলার পর তিনি জানালেন,'বাবা রে ' তুই যা ভালো মনে করো তাই করো, মায়ের দোয়া তো সবসময় সাথে রইলো। আর বাবা তো রাগান্বিত হয়ে 'এটম বোমা' নিক্ষেপ করলেন, তার কথা হলো, বৃটেনে আর কোন মেয়ে পেলো না ? এই মেয়ের কখনই বা ভিসা হবে ? সে কবে বৃটেনে যাবে আর কখন আমাকে লিগ্যাল করবে? সিলেটের ভাষায় জোরে জোরে বলতে থাকলেন (অইবো ডাইল আর খাইবায় কাইল) আজ ডাল রান্না হবে আর কাল খাবে। মায়ের অনেক মিনতি শেষে বাবা শেষমেশ নিমরাজি হলেন। তারপর এক নতুন অধ্যায়ের শুরু বললে ভুল হবে যেন এক বিরল ও বিচিত্র ইতিহাসের সূচনালগ্ন, আর ইতিহাস সৃষ্টিকারী নিজেই জানলো না কতটা ভয়াবহ ভবিষ্যতের ভিত সে রচনা করতে চললো,,,,
চলবে....
(ভুল ত্রুটির সম্পাদনা সময় করে দেয়া হবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০১৯ রাত ৯:৪৩