(বয়োবৃদ্ধ ও বয়োকনিষ্ঠদের পোস্টটি এড়িয়ে যাবার অনুরোধ )
(গল্প)
পর্ব -০১
নাটকের শেষ দৃশ্য...... জীবনে কতই না অপেক্ষা,টানটান উত্তেজনা, বিরক্তি, আসক্তি, উম্মাদনা আর কতইনা খিস্তিখেউর করেছি নাটকের শেষ দৃশ্য দেখবো বলে। সেই আলিফ লায়লা,সিন্দাবাদ, ম্যাকগাইভার, বাকের ভাই কত্ত কিছু আর বাস্তব জীবনে যখন নিজের জীবন নাটকের শেষ দৃশ্য আর শুরুর শেষ নিজেকে উপভোগ আর উপহাসের সম্মুখীন হতে হয় তখন হয়তো কেউ জানে না। নিজের জীবন নাটকের অনেক ঘটনাই ক্ষত সৃষ্টি করে হৃদয়ে অনেকটা ভোরের শিশির বিন্দুর মতো ফোঁটা ফোঁটা রক্ত কণিকা গলিয়ে পড়ে হৃদয় থেকে অবিরাম কেউ দেখে না। কেউ জানে না।
ঠিক এমনি একটি রক্তস্নাত অধ্যায় আমার জীবন নাটকে প্রদর্শিত হয়েছিল যা কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। কাউকে জানতে দেইনি কতটা ভয়াবহ ছিলো সেই মুহূর্ত। দুলোক- ভূলোক কি যাতনাকে লঘুচিত্তে বহন করেছি কেউ শুনে নি। আর সেই যাতনার কারিগর যখন সেই রূপবান যাকে তিলে তিলে সঞ্চিত করে রেখেছিলাম হৃদবন্দরে, যাকে দিয়েছিলাম যৌবনের তেরটি বছরের নিস্পাপ ভালোবাসার ষোলকলা।বিংশ শতাব্দীর শেষে যখন বূহ্যভেদ আশায় বিদেশে পাড়ি জমাই ঠিক তখন আমার ছিলো বয়সী বিশের রসালো যৌবন। কাউকে ভালোবাসা আর ভালোলাগা কি সে বয়সে যতটা বুঝতাম তা ছিলো ঠিক আম,জাম,ডুমুর ফলের গাছের দিকে ফল তাকিয়ে দেখার মতো। কখনো হাত বাড়িয়ে বা কখনো গাছের ডালে চড়ে বোটা থেকে জোটা হতো না। সেটা হয়তো বয়ঃসন্ধিতে নিজের তেমনি গড়ে উঠা আত্মা যা ছিলো সফেদ আর নিখাঁদ। কিন্তু কে জানে সেই খাঁটি অন্তরীক্ষে কোন বাজীকর দিয়ে দিবে দাবার চাল যা বুঝতে পেরে ওটা সম্ভব হয়নি এই সরলমনে। ২০০০ সালে লন্ডন আসার পর অনেক মেয়ের সাথে পরিচয় হলো। আমার সবুজ মনটাকে অনেকেই অবুঝ ভেবে নাড়া দিতে থাকলো। তাদের কেউ হাত বাড়িয়ে নয় বরং বুক বাড়িয়ে জড়িয়ে নিতে চাইতো। আর আমি তো নাদান ষষ্ঠী মধুর অপেক্ষায় থাকা ঋষি হয়েই থাকতে চাইলাম।
পর্ব -০২
সময় কখনো চোরাবালিতে আটকায় না। সে চলে যায় বহতা নদীর মতো কলকল- ছলছল নৃত্যের কলতানে। কখন যে দিন চলে গিয়ে রাত আসে আর কিভাবে যে ফুরিয়ে যায় প্রভাতরাগ কিংবা সন্ধ্যা মালতীর সুর তাতো কেবলি অধরাই কিংবা বেখেয়ালি থেকে যায়। মাঝেমধ্যে সময়ের এই গতিরেখা কি সবজায়গায় একি সমানতালে সরলরেখায় চলে নাকি বক্ররেখায় আঁকা বাঁকা চলে তা নিয়ে বিশদভাবে জানতে ইচ্ছে করে! তবে বিদেশে বিভূঁইয়ে এসে জানতে পারলাম সময় কতনা বিদ্যুৎতিক বেগে চলে যায়। দেশে থাকতে সময় যেন বাঁশের সাঁকোর মতো পরিপাটি ও জড়োসড়ো হয়ে আটকে থাকতো। সামনে আগাতে অনেক বেগ পেতে হয় কতনা অলস দুপুর হাই ভলিয়মে ক্যাসেট প্লেয়ারে হিন্দি গান আজা নাচলে, মাহিরে কিংবা বাংলার হারানো দিনের গানের মধ্যে চলতো সতীনাথ থেকে মান্না দে, শ্রীকান্ত কিংবা হাসনরাজা থেকে রথীন্দ্র নাথ শুনে শুনে তবুও যেন দুপুর গড়িয়ে রাত আসতো না। আর নিশুতি রাতের আকাশের পানে চেয়ে চেয়ে কখনোবা কাঁথা মুড়িয়ে জীবনানন্দ থেকে মাসুদ রানা কিংবা কাশেম বীন আবুবকরের ইসলামি রীতিগত সুড়সুড়ি দেয়া গল্প পড়তে পড়তে। তবুও সময় যেন দেশের কাদামাটির মতো কর্দমাক্ত ও পিচ্চিল হয়ে চলেতো। কখন হোঁচট খেলাম কখন আঘাত পেলাম তা ক্ষণে ক্ষণে মনে জেগে থাকতো।
-আর এই বিদেশের মাটিতে সময় যেন সহস্র মাইল বেগে চলে যায় কখন যে ছয় মাসের ভিজিট ভিসার সময় কেটে গিয়ে অবৈধ অভিবাসীর তকমা গায়ে লাগিয়ে গেলো তা কোনভাবেই টেরই পেলাম না।
- হায় ঈশ্বর মানুষ আমি হয়ে গেলাম নৈসর্গের বুকে এক আজব, জটিল, অবৈধ নাগরিক।
দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট্ট হওয়াতে পরিবারের বৈরীভাব কখনো আঁচ করতে পারিনি। বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা হওয়াতে হয়তো অন্যরকম বাবা বলে আমার কাছে মনে হতো। বাবার কাছে দেশ,মানুষ ও পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধ আমাকে মুগ্ধ করতো আর তাই ছেলে হিসাবে যখন যা চাইতাম তাই সাধ্যমত এনে দিতেন ৷সিলেট শহরের সুরমা নদীর কুল ঘেষা দক্ষিণ সুরমায় আমাদের পারিবারিক বাসস্থান। শহরে আসতে মাঝে মধ্যে বেগ পেতে হতো। ঝামেলার অন্যতম কারণ ছিলো এই সুরমা নদী। নদী পারাপারের জন্য ব্রিজ যাকে বলে কীন ব্রিজ তা পারাপারে রিক্সার সাথে আরেকজন সহযোগী লাগতো রিক্সার পিছনে ঠেলে দেওয়ার জন্য। এমতাবস্থায় বাবাকে আবদার করতেই একটা সুযোকি হোন্ডা আমাকে কিনে দিলেন। হোন্ডা পেয়ে মনের আনন্দে সকাল- বিকাল সবসময় শহরমুখী হতাম। আড্ডা আর হৈ-হুল্লোড়ের কেটে যেতে মধুর সময়৷ কখনো বৈষম্য চোখে পড়তো না। কখনো আজেবাজে কাজে নিজেকে জড়াতাম না ৷মাঝে মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সংগঠনে যুক্ত হতাম। টুকটাক গান বাজনা, শারীরিক কসরতের জন্য কুংফু এগুলো শিখতে লাগলাম। মেয়েদের সাথে মিশেলও একটা দুরত্ব বজায় রাখতাম। নিজেকে কোন বৈধ কিংবা অবৈধ, বা অনৈতিক সম্পর্কে জড়াতাম না। সবসময় নিজেকে ভার্জিন রাখার মানষে নৈতিকতাকে সবকিছুর উর্ধে রাখতাম। বৈধ আর অবৈধ সম্পর্ক কি তা ঠিকই বুঝতাম তবে বিদেশে এসে এই বৈধ আর অবৈধের বৈষম্য মারাত্মকভাবে বুঝতে পারলাম। আদম সন্তান মানুষও যে অবৈধ হয় তা কখনো বুঝতাম না। এবার বিদেশে এসে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম অবৈধ কি আর কেনইবা বলা হয় নিজগৃহে একবেলা খেয়ে বাঁচা শতগুণ ভালো এই নিদারুণ নিষ্ঠুর পরবাস থেকে।
দেশে আমাদের পাঁচ বেডরুমের ঘর। অনেকদিন নিজের ঘরের এক রুমে থেকে আরেকটি রুমে যাওয়া হয়না। অযত্নে থেকে যায় ঘর, আসবাবপত্র, রুম আর বিদেশে একটু মাথা গুঁজে থাকার জন্য কত কক্ষপথ অতিক্রম করতে হয় কত আসীম পেরিয়ে পাওয়া যায় সসীমের দেখা তা কেবল ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানবে না। অবৈধ হওয়ার পর থেকে নিজের মাথা গুঁজার ঠাঁই, কাজের ব্যবস্হা, বৈধ হওয়ার সাধনা এগুলো নিয়ে তছবিহ জপতে থাকলাম।
(চলবে নাকি)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০১৯ রাত ৯:২১