ধৈর্যের মিষ্টি শিক্ষা
------------মূল- নিউইয়র্কের এক ট্যাক্সি ড্রাইভার,( অনুবাদঃ রহমান লতিফ)
আমি নিদিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে হর্ণ বাজালাম। কয়েক মিনিটের অপেক্ষায় পর আবারো হর্ণ দিলাম। যেহেতু আমার শিফট শেষ হতে চলেছিল তাই গাড়িটিকে না থামিয়ে শুধু চালানোর কথাই ভাবছিলাম, কিন্তু একটু পরে গাড়ীটিকে পার্ক করে দরজার কাছে গিয়ে নক দিলাম।
'মাত্র এক মিনিট', একটা দুর্বল, বৃদ্ধ কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম, আমি ঘরের মেঝে জুড়ে টানা ছেঁচারা হচ্ছে এমন কিছু শব্দ শুনতে পেলাম।
একটি দীর্ঘ বিরতির পরে, নব্বই বছর বয়সী ছোট্ট মহিলা দরজা খোলে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার পরনে একটি প্রিন্ট পোষাক এবং একটি পিলবক্স টুপি যাতে একটি পর্দা, মনে হলো যেন 1940 সালের চলচ্চিত্রের কোন অভিনেত্রী। তার পাশে একটি ছোট নাইলন স্যুটকেস ছিল। অ্যাপার্টমেন্ট দেখে মনে হলো, এখানে কয়েক বছর ধরে কোন মানুষের বসবাস নেই । সমস্ত আসবাবপত্র প্লাস্টিকের শীট দিয়ে আবৃত ছিল।দেয়ালের উপর কোন ঘড়ি ছিল না, কোন পাত্র ছিল না। শুধু ঘরের কোণায় একটি পিচবোর্ড বক্স যাতে কিছু ছবি এবং কাঁচের পাত্র দিয়ে ভর্তি করা।
'তুমি কি আমার ব্যাগটি গাড়ীতে নিয়ে যাবে?'
-আমি টেক্সি ক্যাব-এ স্যুটকেস রেখে, তারপর মহিলাটিকে সাহায্য করার জন্য ফিরে এলাম। তিনি আমার হাত ধরলেন এবং আমরা রাস্তার কিনারা দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে গাড়িতে উঠলাম। তিনি এই উদারতা জন্য আমাকে ধন্যবাদ দিতেই থাকলেন। আমি তাকে বললাম, 'এটা কিছুই না', 'আমি যাত্রীদের প্রতি, আমার মায়ের সাথে আচরণের মতোই আচরণ করার চেষ্টা করি। ওহ, তুমি এত ভালো ছেলে, ভদ্রমহিলা বললেন।
আমরা যখন ক্যাব উঠলাম,তিনি আমাকে একটা ঠিকানা দিলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন,
'তুমি কি শহরের মধ্য দিয়ে ড্রাইভ করতে পারবে?
'এটা কোন ছোট রুট নয়,' আমি দ্রুত উত্তর দিলাম।
'ওহ, আমি কিছু মনে করি না,' 'আমার খুব তাড়া নেই । আমি একটি বৃদ্ধাশ্রমে যাচ্ছি ।
আমি পিছনের আয়নায় দেখছিলাম তার চোখ চকচক করছিল। 'আমার কোন পরিবার বেঁচে নেই,' তিনি একটি কাতর কণ্ঠে বললেন । 'ডাক্তার বলছেন যে আমার সময় খুব দীর্ঘ নয়।'আমি গাড়ির মিটার বন্ধ করে আস্তে আস্তে ড্রাইভ করতে লাগলাম।
'তুমি কোন রুটে আমাকে নিতে চাও?' আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম.
পরের দুই ঘন্টার জন্য, শহরের ভেতর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ছিলাম। তিনি আমাকে সেই বিল্ডিং দেখিয়েছিলেন যেখানে তিনি একবার লিফট অপারেটর হিসাবে কাজ করেছিলেন।তার স্বামীর সাথে যখন নতুন বিয়ে হয়েছিল,সেই সময় যে এলাকায় বাস করতেন আমরা সেই আশপাশের এলাকা দিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে তিনি আমাকে একটি আসবাবপত্রের গুদামের সামনে দাঁড়াতে বললেন, যা একসময় পানশালা ছিল যেখানে তিনি নৃত্য শিল্পী হিসাবে নেচেছিলেন। কখনও কখনও তিনি আমাকে একটি নির্দিষ্ট বিল্ডিং বা রাস্তার কোণার সামনে ধীরগতিতে যেতে বলেন এবং অন্ধকারের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে থেকে মুখ দিয়ে কোন কিছু বলেন নি।
সূর্যের প্রথম প্রহর দিগন্তরেখা ছুঁয়ে উদিত হচ্ছে, ভদ্রমহিলা হঠাৎ বললেন, 'আমি ক্লান্ত। চল এখন যাই'.
তিনি আমাকে দেওয়া ঠিকানায় খুব নীরবতা অবলম্বন করে গাড়ি চালিয়ে যেতে লাগলাম। একটি গলির ভেতর দিয়ে পুরাতাত্ত্বিক ও নিচু একটি বিল্ডিং প্রবেশ করলাম যার সামনের দিকে সারি সারি ফুলের বাগান লাগানো। গাড়িটি থামার সাথে সাথে দুইজন বৃদ্ধামহিলা কাছে এলেন । তারা ভদ্রমহিলার প্রতি পদক্ষেপে সহায়তা ও পর্যবেক্ষন করছিলেন,মনে হলো তারা তার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন ।
আমি গাড়ির বুট খোলে তার দরজায় ছোট স্যুটকেস দিয়ে আসি। ভদ্রমহিলা ইতিমধ্যে একটি হুইলচেয়ারে বসে ছিলেন।
'আমি তোমার কাছে কত ডলার ঋণী?' তার পার্স মধ্যে হাত ঢুকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
'কিছুই না,'
তিনি বললেন, তোমাকে তো জীবিকা নির্বাহ করতে হবে।
'অন্য যাত্রী আছে,' আমি পুষিয়ে নেবো।
প্রায় কোন চিন্তা ছাড়া, আমি নিচু হয়ে তাকে আলিঙ্গন দেই। তিনি আমার হাত খুব দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে বলেন, তুমি একজন বৃদ্ধ মহিলাকে একটি সামান্য মুহূর্তের জন্য আনন্দ দিয়েছো ,' 'ধন্যবাদ.'
আমি তার হাতটি চেপে ধরলাম, কিছুক্ষণ পর সকালের মৃদু আলোতে হাঁটতে লাগলাম। আমার পিছনে একটা দরজা বন্ধ করে দিল। আমার কাছে এটি একটি জীবন বন্ধ করার শব্দ ছিল .......!!!!
আমি সেদিন আর কোন যাত্রী নেই নি । আমি উদ্দেশ্যহীনভাবে ড্রাইভিং করছিলাম। সারাটি দিন আমি খুব কমই কথা বলতে পেরেছিলাম।
সেই মহিলা যদি রাগী ড্রাইভার পেতো , বা কেউ যদি শেষ শিফটের জন্য অধৈর্য থাকতো ? যদি আমি শিফট নিতে অস্বীকার করতাম, বা একবার হর্ণ দিয়ে চলে যেতাম ? তাহলে....
নিজের সাথে দ্রুত পর্যালোচনায়, জীবনে এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু করেছি বলে মনে হলো না।
আমাদের জীবনের সেরা মুহুর্তেগুলো চারপাশে ঘূর্ণায়মান মনে হয়। হ্যাঁ, সেরা মুহূর্তগুলো প্রায়ই আমাদেরকে অজানা- সৌন্দর্যে আবৃত করে, যা অন্যরা ছোট বলে বিবেচনা করতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১৯ সকাল ৭:৪৮