#পর্ব ০১
.....................
শৃঙ্খলাই জীবনকে করে তুলে পরিপূর্ন। আর এই শৃঙ্খলা রক্ষা করতে করতে কেউ কেউ বেঁধে নেয় কঠিন শিকল বেড়ি। তেমনি শৃঙ্খলার ম্যারাথন দৌড়কে শিকলবন্দী করতে কারো কারো জীবনে অগত্যা কালো মেঘে ঢেকে যায় রৌদ্রময় দিনগুলো। তদুপরি শৃঙ্খলার নিরেট গতিবিধি মেনে নিয়ে কারো মেঘমালায় আবৃত আকাশে সাহসই কড়া রোদ্দুর ঝকমক করে।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার লোহাগড়ায় এক যৌথ পরিবারের জন্ম মফিজের। প্রায় দেড় যুগ আগে মালিক মিয়া দ্বিতীয় বিয়ে করেন মফিজের মাকে।একে তো সংসারের টানাপোড়েন তার উপর যৌথ পরিবারে ঝগড়া বিবাদ নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। সতীনের সংসারের ঘাত প্রতিঘাত সামলিয়ে মফিজের মা কারো সাথে বিবাদে জড়াতেন না। একত্রে সংসার চালানোর গভীর কর্তব্যবোধ থেকে কখনো পিচপা হতেন না।
মফিজ মায়ের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছে সহনশীলতা ও সম্প্রীতির গুণ। তাই সে যেকোন অবস্থায় কারে সাথে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হতো না। এমনকি তার পাতের ভাত কিংবা তরকারি সৎভাই হাফিজ বা হামিদ নিয়ে নিলে তার মায়ের মন খারাপ হলেও সে তৃপ্তির হাসি হাসতো। তার নিত্য দিনের কাজের রুটিন হলো মাঠে গরুর পাল চড়ানো,গোলায় ধান তোলা,ক্ষেতে খামারে বীজ রোপণ ও সেচ,হাটে আলু,বেগুন ও কাঁচা তরকারি বিক্রি এ-সব কাজ করতে হতো। তার অন্য ভাইয়েরা খেলাধুলা ও লেখাপড়ায় ব্যস্ত সময় কাটাতো।
এদিকে বাড়ির সকল কাজ,ঘর -বাহির,উঠোন পরিস্কার,ধান বানা, রান্না করা,গরুর দুধ দোহানো সহ যাবতীয় গৃহস্থালি কাজ তার মা'কেই সামলাতে হতো। সে যতটুকু সম্ভব সাধ্যমতো মা'কে সাহায্য করতো। ঘরের অন্য সদস্যরা মেহমানের মতো সময় সুযোগে সাহায্য করতো নয়তো বসে বসে খোশগল্প করতো। এত সব কাজের মধ্যেও কারণে অকারণে সৎ ভাইবোন ও সৎমা মফিজকে গালাগালি করতো। মাঝে মাঝে তাকে মারামারি করলে সে কখনো মন খারাপ করতো না। সে এগুলোকে খুবই সহজ ও গাসহা ব্যাপার বলে মনে হতো। আশ্চর্য হ'লে সত্য সে কখনো খুব বেশি দুঃখ পেলে কাঁদত না। যদিও মানসিক চাপ ও ঝক্কি ঝামেলার মাঝে দিশেহারা জীবন প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলতে হচ্ছে তথাপি সকল বৈরী আচরণের মাঝেই পরিশ্রমি ও নিষ্ঠাবান মফিজ বড় হতে থাকে।
মফিজের বয়স যখন তেরো বছর তখন বাবা হারায়। বাবা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর মফিজ ও তার মায়ের জায়গা হয় বাড়ির পর্ব দিকের খড়ের ঘরটায়। যার একপাশে গরু,ছাগল ও অন্য পাশে মফিজদের ঘর। যদিও তার মামা ও পাড়াপ্রতিবেশীরা তার মা'কে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার জন্য বেশ জোরেশোরে কথাবার্তা বলেন। কিন্তু মফিজের মা কিছুতেই রাজী হলেন না। তার মায়ের কথা একটাই মেয়েদের স্বামী হয় একজন যার সাথে জান্নাত হবে। স্বামী মারা যাওয়ার পর অন্য কাউকে বিয়ে করলে ছেলের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতে নষ্ট করে মা তার সুখের জন্য কোনক্রমেই দ্বিতীয় বিয়েতে রাজি হলেন না। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বাকি জীবন একা কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
মা অপরের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাবে আর মফিজ স্কুলে গিয়ে পড়ালেখা করে কতদূরই বা যেতে পারবে ? আর লেখাপড়ার এত খরচ কিভাবে যোগাবে? এমতাবস্থায় মা পাগলা মফিজ কাজ শুরু করলো স্হানীয় ইসহাক গাজী 'গ্যারেজ এন্ড পেট্রোল স্টেশনে। প্রতিদিন সকালে মফিজের সৎ ভাইবোন যেখানে ছুটে যায় স্কুলে সেখানে মফিজ যায় গ্যারেজে। একি পরিবারের শিশুদের এই বিপরীতমুখী ছবির মূলে কি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈরিতা দায়ী! নাকি মানবিকতা বিবর্জিত নীতি হীন কিছু মানুষ দায়ী সেটা মফিজের কচি মনে কখনো রেখাপাত করে নাই। আর এরজন্য তার কোন অনুতাপ বা বিরাগ নেই। মায়ের হাসিমাখা মুখটাই আসল বাকি সব অর্থহীন। যেকোন মূল্যে মাকে সুখে রাখাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দিনশেষে বাড়ি ফিরে মায়ের সাথে পেটভরে খেতে পারাটাই জীবনের সার্থকতা আর এটাই তার সুখের পৃথিবী। এভাবেই মা ছেলের ভাঙাচোরা জীবন বেশ চলছিল।
হঠাৎ একদিন ডাকপিয়ন মফিজের নামে একটা চিঠি নিয়ে এলো। যেহেতু মফিজ কাজে ছিলো তাই মফিজের পক্ষে তার কলেজ পড়ুয়া সৎ ভাই হাফিজ চিঠিটা গ্রহণ করে। চিঠিটি পড়ে হাফিজ তার সৎ মাকে বললো, যদি ছেলেকে হারাতে না চাও তবে দু দিনের মধ্যেই এলাকা ছেড়ে চলে যাও। এই একটি চিঠির জন্য মফিজের সামান্য যা সুখ ছিলো তা তাসের ঘরের মতো লন্ডভন্ড হয়ে উড়ে গেলো। আজানা আশংকা গ্রাস করলো তাদের ছোট্ট সংসারে।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৫৪