ইউ আর এ পাকি বয়
*******************
২০০৯ সালের ঘটনা, একদিন রাত আনুমানিক সাড়ে সাতটা বা আটটার দিকে কেন্টের চ্যাটাম (Chatham)এলাকা থেকে লন্ডন যাচ্ছি। চ্যাটাম থেকে লন্ডন গাড়িতে আসতে পয়তাল্লিশ মিনিট বা একঘন্টা এই রকম সময় লাগে। যাইহোক রওয়ানা দেওয়ার প্রায় পনের মিনিট পর আবাসিক( Residential) এলাকায় ঢুকার ফলে সেখানে স্টিট লাইট থাকলেও সরু রাস্তার দু পাশে গাড়ি পাকিং থাকায় ভালো করে চারিদিকে দেখা যাচ্ছিলো না।তাই স্পিড লিমিট ত্রিশ হলেও অন্ধকারের জন্যএকটু সতর্ক হয়ে ড্রাইভিং করছিলাম।হঠাৎ বিপরীতমুখী একটি গাড়ি মনে হয় চল্লিশ মাইল স্পিডে এসে আমার ড্রাইভার সাইডের আয়নার (Drier side mirror) সাথে টাং শব্দ লেগে সাইডের আয়না চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ঝরঝর করে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে গেলো।খেয়াল করে দেখলাম একটা পিচ্চি মেয়ে ড্রাইভ করছে। আমি হাত তুলে গাড়ি থামাতে বললাম এবং নিজেও বাম পাশে গাড়ি দাঁড় করালাম। মেয়েটা গাড়ি না থামিয়ে কিছুদুরে একটা ঘরের সামনে গ্যারেজে গাড়িটি পার্ক করে দিলো। আমি ভাবলাম মেয়েটা হিট এন্ড রান করছে তো পুলিশ কল করে বিষয়টা জানাই। যখন পুলিশ কল করবো এমন সময় ঐ মেয়েটা আরেকজন মহিলা কে নিয়ে হাজির।আমি কিছু বলার আগেই মহিলাটা বললো,"ইউ আর এ পাকি বয়" ( উল্লেখ পাকি একটা গালি সাধারণত এশিয়ানদেরকে পাকিস্তানের মানুষ বলে গালি দেওয়া) আমার মেয়েকে হিট করেছিস।তোর লাইসেন্স আছে নাকি! পাহাড়ি মহিলার মতো যা বকা শুরু করলো তা শুনে রীতিমতো নিয়ন্ত্রণ হারানোর কথা।
আমি বিনয়ের সহিত বললাম,তুমি ড্রাইভার নাকি তোমার মেয়ে? এত অভদ্রতা করছো কেন? অযথা কেন গালাগালি করছো?
আমি পুলিশ কল করতেছি তখন দেখা যাবে কে সঠিক। কথা শেষ করার আগেই দেখি দু'গাড়ি পুলিশ এসে হাজির। তার এসেই আমার লাইসেন্স চেক, বডি চেক,যতপ্রকার চেক ছিলো সব শেষ করে বলে আসলে এটা উইন উইন সিচুয়েশন( Win-win situation) কে দোষ করছে তা সঠিক বলা যাচ্ছে না কারণ দুজনের ড্রাইভার সাইডের আয়না ভেঙে গেছে। আমি বললাম তা ঠিক আছে কিন্তু সে তো আইন অনুযায়ী গাড়িটি না থামিয়ে বাড়ি চলে গেলো আর তার মা এসে আমাকে গালাগালি করলো। এটা কোন কথা। যে পুলিশ আমাকে চেক করছিলো সে মনে হয় মুসলিম ছিলো। কারণ তার কথাবার্তা ও দাড়ি দেখে তাই মনে হয়েছিল। সে আমাকে বললো তোমার কি এদেশে জন্ম? আমি বললাম না।আমি মেইড ইন বাংলাদেশ। প্রোডাক্ট অব বাংলাদেশ। সে হাসি দিয়ে বললো তোমার কথা বলার ধরনটা খুব ভালো। তার সাথে কথা বলা অবস্থায় দেখি আরো দু'গাড়ি পুলিশ এসে হাজির। তাকে বললাম কি অবস্থা আরো পুলিশ কেনো এলো? সে জানালো উনি সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব মিডওয়ে পুলিশ আর যে এক্সিডেন করেছে সে তার মেয়ে যে কিনা কিছুদিন আগে ড্রাইভিং পাশ করেছে।
মেয়ের বাবা দৈত্য মার্কা চেহারা নিয়ে এসে বললো তুমি কি চাও এখন? ইনসুরেন্সে ক্লেইম করবে নাকি নিজেদের মধ্যে শেষ করে ফেলবে? আয়না লাগানোতে আর বেশি খরচ হবে না! আমি বললাম এত ছোটখাটো বিষয়ে আমি ইনসুরেন্সে ক্লেইম করবো না।
কথাটা বলার পর লোকটার দৈত্য চেহারায় মানুষের হাসি দেখলাম। দাড়িওয়ালা পুলিশ বললো তাহলে তো এখানেই শেষ যার যার মতো করে চলে যাও। (এদেশে একবার ইনসুরেন্সে ক্লেইম করলে নতুন ড্রাইভারদের প্রিমিয়াম বেড়ে যায় অনেক সময় পরবর্তীতে ইনসুরেন্সে পাওয়া যায় না। তাই নতুন ড্রাইভার এক্সিডেন্টের কবলে পড়লে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন)
আমি বললাম না শেষ না ইনসুরেন্সে ক্লেইম না করি কিন্তু রেসিজম কেইস করবো।এই মহিলা আমাকে কেন 'পাকি'বলে গালি দিলো কারণ আমি তো পাকিস্তানি না, কিংবা সে তো ড্রাইভার না।আর ঘরের পাশে থাকায় আমাকে এসে গালি দিতে পারছে যদি দূরে কোথাও হতো তবে কি গালি দিতে পারতো।পুলিশ হেসে বলে রেসিজম প্রমাণ করা যায় না। আমি বেশ ভঙ্গি করে বললাম সেটা কোর্টে দেখা যাবে, তবে মেয়ের মা আমাকে সরি বললে আমি মাফ করে দিতে পারি। সবাই আমার মুখের দিকে হ্যাঁ করে তাকায়। শেষমেশ সুপারিন্টেনডেন্ট হেন্ডশ্যাক করে স'রি বললো। তারপর ভাঙা আয়না তবুও সজীব প্রাণে বিজয়ীর হাসি হেসে চলে আসলাম।
নোট--
১) পশ্চিমাা বিশ্বে যতই গলা ফেটে সাম্যবাদের ফাঁকা বুলি দেয়,আসলে দেশে দেশে সমাজে সমাজে রেসিজম Racisms বা বর্ণবাদ বিদ্যমান যা কোন অবস্থায় নির্মূল হবে বলে মনে হয় না।
২) কবিতা, গল্প,উপন্যাসের মতো বাস্তবেও যে যত সুন্দর করে উপস্থাপন করতে পারে ততই ভালো ফলাফল উপভোগ করতে পারে। উপস্থাপনা গুণের জন্য অনেক সময় বড় বিপত্তি ছাড়াই সমস্যা উত্তরণ সম্ভব।
৩) বেয়াদব নারীর জন্য তার আশেপাশের মানুষকে অনেক সময় খাটো বা বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।
(প্রথম অভিজ্ঞতার লেখাটিতে সব গুণীজনদের মন্তব্য ও লাইকের অনুপ্রেরণা থেকে লেখাটা কন্টিনিউ করার চিন্তা)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৮:০২