প্রথমাংশ১-৩
৪
৫
৬
৭
(৮)
সোয়নসি( Swanse) থেকে ইস্ট লন্ডনে যাবার সময় ট্রেনে বসে বাহিরের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে মজনুর নিজেকে বড় বেহায়া ও নির্লজ্জ মনে হলো।দীর্ঘ সময় ধরে অনুতপ্তের জটলা মাথার ওপর ঘুর্ণিঝড়েের কুন্ডলী পাঁকিয়ে সবকিছু মাড়িয়ে দিলো।পৃথিবীর তাবৎ স্বার্থের কাছে যে বন্ধু ছিলে পাহাড় সমান বিশ্বস্ততায় অনড়। প্রবল ঝড়ের কবলে পড়া পথহীন-দেশহীন জাহাজের যে ছিলো নিরাপদ কেপ্টেন।যে বন্ধু পৃথিবীর সমগ্র জটিলতার মাঝেই নিঃস্বার্থভাবে এত ভালোবাসে সে বন্ধুকে এভাবে আঘাত দেয়াটা মোটেই ঠিক হয়নি। এসব ভেবে ভেবে চোখের কোনে নোনা জল চলে এলো।
আজকের ট্রেন জার্নিটা বেশ লম্বা মনে হচ্ছে। লন্ডন যাবার রাস্তা যেন শেষই হচ্ছে না।মায়ের কথা খুব বেশি মনে পড়ছে।কতদিন মায়ের মুখটি দেখা হয় নাই।অবুঝ মনটা এখনি ছুটে যেতে চায় মায়ের কাছে। লুটায়ে পড়তে চায় মায়ের শীতল আঁচলের মাঝে।ব্যবসা ভিসায় আবেদন করার পর এখনো ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার অবসান হয়নি এমতাবস্থায় চাইলেও দেশে যেতে পারছে না। মাথাটা ঝিম ধরে আছে।তাবৎ পৃথিবীটাকে কেবলি বোঝা মনে হচ্ছে। তার কোন কিছুতেই ভালো লাগছে না।
একটু পরে ট্রেন গিয়ে থামবে চেমসফোর্ড তার মানে পরবর্তী স্টপ লন্ডনের লিভারপুল স্টিট হবে ফাইনাল স্টপ।ট্রেনটি চেমসফোর্ডে এসে থামলে মজনু সেখানেই নেমে গেলো।তার সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সহ পুরো স্বত্ত্বাকে হ্যামিলিওনের বাঁশির মতো ডাকছে জুয়ার ঘর।পকেটের টাকাটা যদি কোনভাবে ডাবল হয়ে যায় তবে এবার একেবারে দেশে চলে যাবে।আর এদেশে থাকবে না।মায়ের মুখ দেখতে পারবে।এই ভাবনা নিয়ে বেলা আনুমানিক সকাল দশটায় বীরদর্পে জুায়ার ঘরে ঢুকলো।একের পর এক বাজী ধরে চলছে। কাস্টমার সার্ভিসের সাদা চামড়ার মেয়েটা এরিমধ্যে তিনবার চা দিয়ে গেছে মজনুকে৷বেলা পৌনে চারটার দিকে হোয়াইট মেয়েটা আবারো এসে মজনুকে তাদের এখান থেকে চলে যেতে বললো,
মজনু বেশ রাগান্বিত স্বরে বললে,
- Why? What happened?
- Sir,We have a strict policy to follows.
- You have to be gamble responsibly.
-As you have playing since long so we think you are addicted and irresponsible so you have to leave now!
মেয়েটার ধমক খেয়ে মজনু Leadbrook জুয়ার ঘর থেকে বের হয় স্টেশনের দিকে হাঁটা শুরু করলো।এবার পকেটে দেখলো সাতাশ শত পঞ্চাশ টাকা আছে। মেয়েটিকে মনে মনে ধন্যবাদ দিয়ে ভাবলো যাক এই টাকাটা অন্তত মায়ের জন্য পাঠিয়ে দিবে। এদেশের সিস্টেমটা আসলেই ভালো, নিজের টাকা দিয়ে জুয়া খেলবো,সেখানেও আইনের লাল চোখ।যাক ভালোই হলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবুলের কাছে থেকে গিয়ে পকেটের টাকাটা মায়ের চিকিৎসার জন্য পাঠানোর ব্যবস্হা করলেই বাঁচি।
কিছুদূর হাঁটার পর আরেকটা জুয়ার ঘর Betfred তার চোখে পড়লো।মলিন মুখটা এবার কিছুটা স্বস্তি ফিরিয়ে এলো।এই জুয়ার ঘরটা তার জন্য অনেক আশীর্বাদের। বছর দুয়েক আগে এই ঘর থেকেই তিনশো পাউন্ড দিয়ে ছয় হাজার পাউন্ড এসেছিলো।যদিও পাউন্ডগুলো ধরে রাখতে পারে নি।এবার অন্তত আর সেই রকম বোকামি হবে না।কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সোজা চলে গেলো ব্রেটফ্রেড নামক জুয়ার ঘরটিতে। এবার জয় হবেই কোন কথা নেই। আবারো খেলা শুরু করলো। এক মগ্ন হয়ে খেলা চালিয়ে গেলো।পকেটের সবগুলো টাকা শেষ হয়ে ব্যলেন্স যখন শূন্য হয়ে এলো তখন রাত সাড়ে সাতটা।
টাকা পয়সা যা ছিলো সব হারিয়ে উদভ্রান্তের মতো মজনু বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
হায় কপাল! কি যে পাপে আমাকে ধরেছে!
এতগুলো টাকা নিয়ে লন্ডন পযর্ন্ত পৌঁছানো হলো না তার আগেই শেষ করে দিলাম?
আহ, আমার মায়ের অপারেশনের টাকার কি হবে?
এবার যাবোই বা কোথায়?
পাগল হতে তো আর দেরী নাই নাকি আত্মা হত্যার মতো মহাপাপের রাস্তা বেছে নেবো!
হাতের ফোনটা দিয়ে আবুলকে আবারো ফোন করে রাতে থাকার ব্যাপারে আস্বস্ততা পাওয়ার পর স্হানীয় একটি মোবাইলের দোকানে গিয়ে হাতের আই ফোন সেভেন প্লাস ফোনটি তিনশ পাউন্ডে বিক্রি করে ছুটে চললো আবুলের কাছে ইস্ট লন্ডনে।
এদিকে মজনুর মা স্বপ্নে দেখছিলেন তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় সন্তান মজনু দু'টি বিশাল কালো সাপের সাথে দিনভর বিরতিহীন লড়াই করে চলছে।কোন অবস্থায় সাপের হাত থেকে উদ্ধার হতে পারছে না।কেউ তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছে না।এরপর থেকে মজনুর সাথে শুধু একবার কথা বলতে চেয়েছিলেন। মায়ের কথা একটাই ছিলো,শুধু একবার মজনুর মুখের হ্যালো শব্দটা শুনতে পেলেই তিনি শান্তি পাবেন। দেশ থেকে একের পর এক ফোন এলো,কিন্তু যোগাযেগের একমাত্র ও অতীব জরুরী বাহন ফোনটি বন্ধ থাকায় মজনুর বন্ধু শাহীনসহ চেনা জানা কেউ মজনুর কোন খবর নিতে পারলো না।
দীর্ঘ আটটি বসন্ত শেষে মজুনর হিসাবের ঝুলিতে নিঃসীম কষ্টের দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই নেই।এই প্রবাস জীবনে সুখের বদলে বিষাক্ত নীল বিষ শরীরে সঞ্চারিত হয়ে চলছে যার ক্ষয় আছে কি না সে জানে না! সাজানো জীবন ফেলে বিদেশে এসেছিলো ভাবনা এমন ছিলো যে একটা ডিগ্রি করে দেশে ফেরত গিয়ে অধ্যাপক হয়ে যেতে পারবে এখন সে কিনা হয়ে গেলো প্রফেসার অব গাম্বলিং।কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার সাজানো সব স্বপ্ন ভস্মিভূত হয়ে গেলো।
মজনু রাত প্রায় পৌনে নয়টার দিকে শুকনো মুখে হাঁপাতে হাঁপাতে আবুলের কাছে এসে পৌঁছালো।সে আর নরকের কীট হয়ে বেঁচে থাকতে চায় না।যত প্রতিকূলতা আসুক না কেন, এইবার তার শরীর ও মন থেকে সব বিষ ঝেড়ে ফেলে স্হায়ী একটি সমাধানের ইস্পাত কঠিন শপথ।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১:০৯