(৭)
বহুদিনের চেনাজানা শহর ছেড়ে নতুন জায়গায় এসে মজনুর মনে হলো,যেন গভীর অন্ধকার ভেদ করে এক চিলতে আলোর রেখা পথ দেখাচ্ছে যে পথিক হারিয়েছে চেনা পথ।বন্ধু শাহীন যেন এক চিলতে আলোর মাঝে চকচক করা মূল্যবান হীরক খন্ড।শাহীনের শর্ত হলো সপ্তাহিক বেতনের দুই তৃতীয়াংশ তার কাছে জমা থাকবে।মায়ের মাসিক খরচ ও মজনুর হাত খরচের জন্য বাকী এক অংশ নিতে পারবে। বন্ধুর কথা সে বাধ্য ছেলের মতো মেনে নিল।মনে মনে খুব খুশি হয়ে ভাবলো যাক এই স্বার্থপর বসুধার বুকে কেউ একজন অন্তত এ দূরদ্বীপে আলোর সহযাত্রী হয়ে পাশে আছে।
মজনু আপাদমস্তক একজন সমুদ্র প্রেমী।তার কাছে সমুদ্র নিঃসন্দেহে এক কিশলয় যা ভাবনা ও কল্পনাশক্তি সম্পন্ন মানুষকে শিক্ষা দেয় অহমিকা ত্যাগ করে মনের ভেতরের বোধের ঢেউ কে জাগ্রত করে সময়ের সাথে বয়ে চলা। আজ কতদিন তার সমুদ্র দেখা ও সমুদ্রের সাথে কথা বলা হয় নাই। এখন কাজের জায়গা থেকে সমুদ্র পাঁচ মিনিটের দুরত্বে অবস্থিত। তাই প্রতিদিনকার কাজের অবসরে সমুদ্রের পাশে বসে আনমনে একা একা ফেলে আসা অতীত,দুঃসহ বর্তমান ও বড্ড ভয়াবহ ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে থাকে।বড় অসময়ে পিতা হারানোর দুঃসহ ব্যথা,মায়ের কান্না,বোনের আহাজারি আর মনোহরণ করা মেয়ে রোমি বিশ্বাসের কথা ভাবতে থাকলো।এখন কাঁচাপাকা চুলের সাথে মুখের লাবণ্য হারিয়ে গেছে।বিয়ে মনে হয় এ জীবনে তার ভাগ্যে আর হবে না।অথচ এমন একদিন ছিলো কত সুন্দরী মেয়েরা তাকে বিয়ে করতে উদগ্রীব ছিলো।তাদের একজন ছিলো রোমি।এই প্রবাস জীবনে রোমির কথা যতবার ভেবেছে,ততবার যদি বাবাকে ভাবতো তবে অকালে বাবাকে হারাতে হতো না।ততবার যদি ঈশ্বর কে ভাবতো তবে মৃত্যুর পর নিশ্চিত বেহেশত পেয়ে যতো।এই ভেবে মোবাইলের নোট পেডে ব্যাদনা ছাড়ানে ক'টি দুঃসহ স্মৃতি- বিস্মৃতি রোমন্থন করে লেখলো,
#হয়তোবা একদিন
'হয়তোবা' একদিন আমি তোমায় আর ভাববোনা ...
'হয়তোবা' তুমিও আনমনে ভাববেনা আমায় অকারণ
'হয়তোবা' এ জীবনে আমাদের কথা হবেনা,,,,
'হয়তোবা' সময়ের ভেলায় চড়ে দেখা হবেনা তোমাতে আমাতে-----
'হয়তোবা' দুজনে নানান কাজে ব্যস্ত থাকবো ...
'হয়তোবা' দুজনের হবে দুটি সরল অথবা বক্র পথ ---
'হয়তোবা' দেখা হবে না নদীর জলে গভীরতা কতটুকু
জানা হবে না চায়ের সঙ্গে কতটুকু পানি দিলে--
সারারাত জোছনা দেখা যাবে এক কেটলি উঞ্চ পানিতে চুমুকে চুমুকে,,
স্বপ্নের বাসর হয়তো সলিলসমাধি হবে --
অকালবর্ষণ এসে ভিজিয়ে দিবে অতৃপ্ত বদন--
চেনা বারান্দায়,চেনা জানালার পর্দায় হয়তো ধূলোর দাগ জমবে---
তবুও ;;;
পৃথিবীর বয়সী দুঃখ নিয়ে------
সূর্যের বয়সী তেজস্ক্রিয় জৌলুস নিয়ে----
তুমি থাকবে আমার মনের গভীরে।
পেছনের ফেলে আসা দুঃসহ অতীতকে ভুলে যাবার মানসে সমুদ্রের তটে বসে কবিতা লেখা আর নিবিষ্ট মনে কাজ করে সময় বেশ ভালো কাটতে থাকলো।এভাবে প্রায় কয়েক মাস কেটে গেলে।একদিন বাড়ি থেকে ফোন এলো তার মায়ের শরীরের অবস্থা খুব খারাপ।সদর হাসপাতালে তাকে ভর্তি দেওয়া হয়েছে এখন অ্যাবডোমিনাল হিস্টেরেক্টমি অপারেশন লাগবে।
মজনু খুব সকালে শাহীনের দ্বারস্থ হলো,
- মায়ের অপারেশনের জন্য বেতনের জমাকৃত টাকাটা আমার লাগবে।
- আমিও দেশ থেকে ফোন পেয়েছি।তুই কোন চিন্তা করিস না আমি দেখছি।
-যত টাকা মায়ের অপারেশনের জন্য প্রয়োজন আমি তা দেশে পাঠানোর ব্যবস্হা করছি।
- আশ্চর্য! আমার টাকা তুই আমাকে দিবে।তুই পাঠিয়ে দেবে এটা কেমন কথা?
- আমার টাকা আজ এবং এখনি চাই।
- ওকে,আমি এখনি টাকাটা তোর একাউন্টে ট্রান্সফার করে দিচ্ছি।
- টাকাটা আমি ক্যাশ চাই।
-এত টাকা তো ক্যাশ নেই তবে কাল সকালে ব্যাংক থেকে উঠিয়ে দিয়ে দেবো।
মজনু এতক্ষণ বেশ রাগান্বিত স্বরে কথা বলছিলে,যেন পারলে শক্ত করে একটা ঘুষি বসিয়ে দেয়।আর শাহীন যতটুকু সম্ভব মজনুর অস্বাভাবিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে শান্ত গলায় শালীনতা বজায় রেখে কথা বলছিলো।
পরদিন ভোর বেলা মজনুর বেতনের বকেয়া পুরো সাত হাজার ছয়শত টাকা শাহীন বুঝিয়ে দিলো।মজনু ধন্যবাদ না দিয়ে বললো আজ থেকে সে অন্য জায়গায় কাজে চলে যাবে। বেশ অবাক হয়ে শাহীন বললো,কোথায়ও যদি ভালো বেতন ও সুযোগ সুবিধা পেয়ে যাস,তবে যেতে মানা করবো না আর কোন কারণে রাগ করে চলে যেতে চাইলে আমি দুঃখিত,আমাকে মাফ করে দিস।
মজনু ফোন দিলো তার পরিচিত ছাত্র আবুলকে।আবুলের ট্রাভেলস ও মানি ট্রান্সফার কোম্পানি আছে ইস্ট লন্ডনে সেখান থেকে মায়ের অপারেশনের জন্য পুরো টাকাটা দেশে পাঠিয়ে দিতে চায়।দুপুরে কাজের জায়গার সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কোন রকম ভান ভনিতা না করে মজনু রওয়ানা দিলো বাঙালির প্রাণকেন্দ্র ইষ্ট লন্ডন পানে।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৯:১৩