(৫)
পরদিন পড়ন্ত বিকালবেলা ক্লাস শেষ করে মজনু নতুন কাজে যোগ দিলো।এই মদের বারে সপ্তাহে সাতদিন বিভিন্ন দেশের খাবার বিক্রি করা হয় তন্মধ্যে ইংলিশ,ইন্ডিয়ান,চাইনিজ,থাই,জাপানিজ,ইতালী ও ক্যারিবিয়ান কিচেনের রেসিপি পরিবেশন করা হয়।মজনুর জব রুল হলো ওয়েটারি।বিভিন্ন ধরনের কাস্টমারদের ফুড ও সাথে মদ পরিবেশন করা।প্রথমদিন এ কাজে নিজেকে তার বেশ ছোট মনে হলো।কোথায় তাকে দেখলে সবাই চেয়ার টেনে বসতে দিতো।সবাই তাকে কত সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদশর্ন করতো।আজ সে কিনা সামান্য একজন ওয়েটার।এসব ভেবে তার মনটা অনেক ভারী হয়ে গেলো।সেই সাথে বাবার কথা মনে পড়ে হৃদয়ের ঈশান কোনে কালবৈশাখীর ঝড়ের আঘাত শুরু হয়ে গেলো।
কাজ শেষে মিঃ হাওলাদারকে বললো তার আসলে মনটা অনেক ভারী।কোন কিছু ভালো লাগছে না,কোন কিছু খেতে মন চাচ্ছে না।শেষেমেষ মিঃ হাওলাদার বললেন, শোন বাবা আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। তোমার মতো আমিও একদিন আবোলতাবোল কত কিছু ভাবছি।যেহেতু বিদেশে চলে আসছো তাই তোমাকে বুঝতে হবে এটা পরবাস এবং এই পরিবেশে মানিয়ে নিতে হবে। মানিয়ে নেয়াটাই হচ্ছে আসল আর অযতা চিন্তা করে শরীর মন নষ্ট করা হচ্ছে কাপুরুষতা। এদেশে বলা হয় "নো জব টু স্মল"(No job too small) কোন কাজকে ছোট করে দেখতে নেই আর সপ্তাহের শেষে বেতন পেলে মনটা ভালো হয়ে যাবে।এখানে টিপসের টাকাটা ওয়েটার ও ওয়েট্রেস পেয়ে থাকে তাই বেতনের সমান টিপস হয়ে যাবে।
আংকেলর কথা শুনে বেশ হালকা লাগলো সে খেয়েদেয়ে সোজা রুমে চলে গেলো।
- কিছুদিনের মধ্যে কাজটা তার কাছে সহজতর হয়ে ওঠে এবং আংকেলের সাথে মদ বারের উপরে থাকতে শুরু করে।যেহেতু তাকে রুম ভাড়া,খাবারের কোন বিল দিতে হয় না তাই সপ্তাহিক বেতন তিনশো পাউন্ড আর টিপস আরো আড়াইশো পাউন্ড মিলে তার সঞ্চয় বেশ ভালো হয়ে গেলো।এত তাড়াতাড়ি বেশ ভালো অবস্থায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরে পুলকিত হলো।এভাবে তার দিনগুলো বেশ সুখেই কাটতে থাকলো।
প্রতিমাসে বাড়িতে টাকা প্রেরণ,বাবা-মায়ের খেদমতের যেন কোন ঘাটতি না হয় সেজন্য ভাই ও বোনকে তাগিদ দেয়াসহ সব গুরুদায়িত্ব যথাযতভাবে পালন করে চলছে।এমনি করে নয় মাস অতিবাহিত হয়ে গেলো।
যদিও তার রুমে মিঃ হাওলাদারের একটা বেড আছে কিন্তু বলতে গেলে রুমে সে একাই থাকে।মিঃ হাওলাদার দিনে কখনো আসেন না। প্রায়দিন রাতে দুইটা বা তিনটার দিকে এসে ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে বেলা মজনু ঘুম থেকে জেগে ওঠার আগেই আবার কোথায় যেন চলে যান। কাজের সময়টা ছাড়া ওনার সাথে তেমন দেখা হয় না। মাঝে মাঝে ইংরেজী প্রত্রিকা নিয়ে এসে মজনুকে দিয়ে আজব কিছু জীবনবৃত্তান্ত শুনে যান।
প্রথম যেদিন মজনুকে বলেছিলেন কোপারফিল্ডের জীবনকীর্তিটা আমাকে বলে দাও।মজনু ভেবেছিলো মনে হয় বিখ্যাত যাদুকর ডেভিড কোপরফিল্ডের জীবনী কিন্তু সে দেখলো সেটা একটি ঘোড়ার কাহিনি,ঘোড়ার বয়স থেকে শুরু করে জীবনব্যাপী কতটা রেসে অংশগ্রহণ করে কতটাতে হারলো,কতটাতে জিতলো,কতটুকু স্পিডে দৌড়াতে সক্ষম এগুলোর বিশদ বর্ণনা।এভাবে প্রায়ই টমি,টনি, কার্লোস,রামোস সহ বিভিন্ন নামের কুকুর ও ঘোড়ার তথ্য শুনে যান মজনুর কাছ থেকে। যদিও মজনু এসবের কিছুই মিঃ হাওলাদারেের কাছে কখনো জানতে চায়নি এবং উনিও কিছু খুলে বলেন নি।
হাতে কিছু টাকা পয়সা জমা হওয়ার পর এবার মজনুর মনে হলো,বাবা কত কষ্ট করে তাদেরকে বড় করে তুলেছেন।বৈশাখ মাসে ঈষাণকোন থেকে দমকা হাওয়া এলে মনে হতো তাদের বাড়িসুদ্ধ উড়িয়ে নিয়ে যাবে।এখনো মাঘ মাসে কুয়াসায় ঢাকা পড়ে যায় হাওরের কুলঘেষে থাকা তাদের বাড়িটি।শীতে ও বৈশাখে বাবার অনেক কষ্ট হয়।একটা ঘর আর সাথে শানবাঁধানো পুকুর দিয়ে দেশে অবস্থানরত মা-বাবা, ভাই-বোনদের সুন্দর সম্মানজনক জীবন যাপন নিশ্চিত করার মনে তাগদা পেলো।তাই বড় ভাইকে বললো,বাড়িতে দু'তলা পাকা ঘর ও চারপাশে দেয়াল দেওয়ার জন্য কত খরচ হয় তা জানানোর জন্য।ইন্জিনিয়ারের হিসাব মতো মোট খরচের ষোল লাখ টাকার মধ্যে দশ লাখ টাকা পাঠিয়ে দিয়ে ঘরের কাজ শুরু করতে বললে।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১০:৫৯