(১)
কেউ কেউ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির সমীকরণ মিলাতে গিয়ে,কদাচিৎ কারো কারো জীবনে প্রত্যাশা পুরণ হয়ে যায় আবার কারো কারো বিশাল অধ্যায় জুড়ে হতাশা ছেয়ে যায় হৃদয়ের ক্যানভাসে। সময়ের অন্তহীন পথ চলাতে হিসাবের গড়মিল সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে যায় জীবন নামক গ্রন্থে।
মজনু,বন্ধু ও আত্মীয় মহলে সবার অতি প্রিয় একটি নাম।খুব ছোটবেলা থেকে সবাইকে আপন করে নেওয়ার এক স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে বিরাজমান। সদা হাস্যোজ্জ্বল ও ভালো চিন্তা চেতনার যাদুকরী ভালোবাসা দিয়ে শত্রুুকেও সে বশ মানাতে পারে। সেই সাথে আদব ও শিষ্টাচারের সমন্বয়ে ধর্মীয় মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা পোষণ করার জন্যবাবা-মা থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন পাড়া পড়শীদের কাছে একটি আদর্শ ছেলে হিসাবেই পরিচিত পায়।
পড়াশোনায় আগাগোড়া সে খুব ভালো ছেলে। স্কুল থেকে শুরু করে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত জীবনের সব পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ভালো নম্বর নিয়ে বা গ্রেড পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে।সেই সাথে স্হানীয় মসজিদ কুরআন শরীফের উপর তামিল নিয়ে ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করেছে। প্রাত্যহিক জীবনের গুণীজনদের বাহবা ও অনুপ্রেরণায় নির্ভুল অঙ্কের সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে যায় উপরে।
মজনু,১৯৯৪ সালে সিলেটের সিলেটের অদূরে কোম্পানিগঞ্জ কলেজ থেকে এইচ,এস,সি পাস করে।দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান 'মঙ্গল চাঁদ কলেজে' ইংলিশ অনার্সে ভর্তি হয়। ইংলিশ ভাষা শিক্ষা দেওয়ার নামকরা ও শত বছরের পুরানো এই কলেজে মজনুর আগে কোন ছাত্র ইংরেজি অনার্সে প্রথম স্থান অধিকার করে নাই।সে দিক দিয়ে মজনু কলেজের জন্য একটি ইতিহাস সৃষ্টি করলো।চারিদিকে থেকে বাহবা শুরু হলো।লোকাল মিডিয়া ও জাতীয় দৈনিকে তাকে নিয়ে শিরোনাম হলো।এতদিন যে সকল শিক্ষকেদের বদ্ধমূল ধারণা ছিলো মফস্বলের কোন ছাত্র ইংরেজি বিভাগে প্রথম হতে পারবে না,কিন্তু মজনু তার দক্ষতায় ও অক্লান্ত পরিশ্রমে তা ভূল প্রমাণ করে দিলো।পরিশেষে শিক্ষকেরাও সুর পাল্টে আওড়াতে লাগলেন,মজনুর মতো পড়াশোনা করলে বিদেশি ভাষায়ও কৃতিত্বের সহিত পাশ করা যায়।সিলেট সহ সারা বাংলাদেশে মজনু তার মেধা,দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তা দ্বারা জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে অভিভূত হলো।
(২)
বাংলাদেশে অন্য সবার জন্য চাকুরীর বাজার যতটা না মরীচিকা ঠিক তেমনি ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারদের মতো ইংরেজি বিভাগ থেকে পাশ করা কোন ছাত্রের চাকুরীর জন্য তেমন কাঠখড় পোড়াতে হয়নি,আর মজনুর তো ব্যাপারটা ভিন্ন কারণ তার পাসের মান অন্য সকলের চেয়ে আলাদা।
মাষ্টার্স শেষ করে সিলেটের নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম প্রতিষ্ঠান 'পাইওনি্য়ার মহিলা কলেজে' ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে কাজ শুরু করে।আচার আচরণের দিক দিয়ে অসম্ভব অমায়িক ও কর্মযজ্ঞে গতানুগতিকতা চেয়ে ভিন্নতা তাকে অল্প দিনের মধ্যে এনে দেয় সাফল্য।
কলেজের নিয়মিত ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি প্রাইভেট টিউশনি শুরু করতে লাগলো।দ্রুত তার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো এবং অল্প দিনের মধ্যে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা মজনুর কাছে দলে দলে টিউশনি পড়তে শুরু করলো।
কলেজের বেতন ও টিউশনির টাকা মিলিয়ে মজনুর মাস শেষে প্রায় লাখ দেড়েক টাকা রোজগার।মা-বাবাকে নিত্যনৈমিত্তিক খরচ ওষুধপত্র ও একমাত্র ছোট বোনের পড়াশোনার যাবতীয় খরচ খরচা বহন করতে হতো। সঙ্গে বড় ভাইকে স্থানীয় বাজারে মুদির দোকান খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা,মা বাবাকে তার সাথে শহরে নিয়ে আসতে চেয়েছিলো কিন্ত বাঁধা সাধলেন মা।তার মায়ের কথা হলো গ্রামের বাড়িতে থেকে বিশুদ্ধ বাতাস পাওয়া যাবে আর শহরে পাওয়া যাবে বিষাক্ত বাতাস।তাই গ্রাম ছেড়ে তিনি কিছুতেই শহরে আসতে রাজী হলেন না।তাই প্রতি সপ্তাহের ছুটির দিনে মজনু ছুটে যায় মায়ের কাছে আর বাড়ি যাওয়ার সময় মায়ের জন্য নিয়ে যায় একহালি জারা লেবু। মায়ের প্রিয় জারা লেবু নিয়ে আসাটা তার কাছে খুব আকর্ষনীয় ছিল।আর মাও ছেলের আগমনের অপেক্ষায় থাকতেন দুবেলা দু'মুঠো ভাতের সঙ্গে এক ফালি লেবুর সুঘ্রাণে পরম তৃপ্তি করে খাবেন বলে।মায়ের জন্য আর যা হোক সে যেমন করে হোক প্রতি সপ্তাহে লেবু নিয়ে হাজির হয়।এইসবের মধ্যে দিয়ে বছর শেষে তার সঞ্চয়ের খাতায়ও বড় একটা অংশ জমা হতে থাকে।
''সবার প্রিয় শিক্ষক মজনু স্যারকে প্রায়ই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ছাত্রীরা প্রেম নিবেদন করতো আবার কখনো কখনো মোবাইলে টেক্সট ম্যাসেজ ও চিরকুট দিয়েও ভালোবাসা নিবেদন করতেও দ্বিধাবোধ করতো না।কিন্তু একজন আদর্শবান শিক্ষক হিসাবে মজনু তাদেরকে নীতিকথা শুনিয়ে দিয়ে সুচতুরভাবে বিপত্তি এড়িয়ে চলতো।ঠিক এইরকম এক বিব্রতকর পরিস্থিতি সে মুখোমুখি হয়েছিল যা তার মনে হলে এখনো ভয় হয়।
-কোন এক মাঘ মাসে বিকাল সাড়ে পাঁচ ঘটিকার সময় সে যখন টিউশনির ক্লাসে লেকচার দিতেছিলো।সেদিন আচমকা আকাশ ঘন কালো আকার ধারণ করে সবকিছু অন্ধকারে হারিয়ে যাবে এমন অবস্থায় মজনু সব ছাত্রছাত্রীদের নির্ধারিত সময়ের বিশ মিনিট আগেই ক্লাস শেষ করে দিয়ে সবাইকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যেতে বললো।
-সব ছেলেমেয়েরা যার যার মতো চলে গেলেও রয়ে গেলো রোমি বিশ্বাস নামের মেয়েটি।
মজনু মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
----তুমি কি যাবে না?
-- জ্বী স্যার,বাসায় ফোন দিয়েছি,ড্রাইভার আসার আগ পর্যন্ত আমি বরং এখানেই অপেক্ষা করবো।
- ঠিক আছে তুমি অপেক্ষা করো,আমি এই ফাঁকে হাতের কাজটা সেরে নিই।
- তোমার আব্বু কি করেন?.
- জ্বী, জেলা সিভিল সার্জন অফিসার রহিম বিশ্বাস আমার বাবা।
- সিভিল সার্জনের মেয়ে শুনে মজনু মেয়েটির মুখের দিকে তাকালো।
-এই প্রথম চোখ চোখ রেখে মনের মধ্যে বাহিরের গুমোট পরিবেশ মতো তার মনের গভীরে গিয়ে বজ্রপাতের বিশাল শব্দের গর্জন ধ্বনিত হলো।
"মেয়েটির ডাগরডাগর চোখ ও লজ্জাবতীর মত লাজুক মুখ যেন একসাথে কথা বলছে।হৃদয়ে তোলপাড় ঝড় তোলা নেশার আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে মনে মনে ভাবলো এত রূপ কোনও রমণীর হয়?
বিধাতার সৃষ্টি রহস্যের রূপরেখা কত নিপুন হতে পারে তা এই মেয়েটাকে আজ এভাবে না দেখলে হয়তো অজানাই থেকে যেতো।
"মেয়েটি-ই মৌনতা ভেঙে দিয়ে বললো!- কি ভাবছেন স্যার?
- সহসা আড়মোড়া ভেঙে মজনু উত্তর দিলো না মানে ভাবছি তোমার নামটা খুব সুন্দর,একজন বিখ্যাত মুসলিম কবির নামে নাম।
-- তাই বুঝি,কেন বিখ্যাত প্রেমিক জুটি রোমিও - জুলিয়েটের কাহিনী কি আপনার জানা নেই। রোমিও একজন পাগল প্রেমিক ছিলো ঠিক যেমন আপনার নামানুসারে মজনুও একজন নির্ভীক প্রেমিক ছিলো।
--লাইলী মজনু কাহিনি তো যুগ যুগ ধরে প্রেমিক - প্রেমিকার মনে চালক হিসাবে প্রেমের অমূল্য ও অসাধ্য সাধনের চরিত্র নিয়ে সুবাস ছড়াচ্ছে।
হঠাৎ এমন নিরব পরিবেশে মেয়েটির এমন আবেগময় অনুরাগের কথা মজনুর কাছে মনে হলো সুরমা নদীর শান্ত জল শীতল পরশ দিয়ে আত্মাকে প্রশান্তি দিয়ে যাচ্ছে।
বারবার মনে হচ্ছ মেয়েটি যদি না থেমে শুধু বলেই যায় তবে তা শুনে অতৃপ্তির জ্বালা মিটানো যাবে।
- স্যার, আমরা কিন্তু চাইলে তাদের মতো না হোক এই সময়ের দু মেরুর দুটি মন মজনু - রোমি-র দুটি প্রাণ এক হয়ে আজীবন ভালোবাসার পানসী বেয়ে ছোট্ট জীবনটা একসাথে পাড়ি দিতে পারি।
- মজনু কিছুটা দূর্বল হয়ে গেলো,তার পঞ্চইন্দিয় স্তব্ধ হয়ে গেলো।মনে হলো সবকিছু ছুড়ে ফেলে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে মনের তুফান একটু লাঘব করবে।
-আবার পরক্ষণেই ভাবলো! তার মনের ভেতর থেকে কে যেন ডাক দিয়ে বলছে 'মজনু ভুলে যেও না তুমি ওর শিক্ষক।
তোমার 'বোধ আর ক্রোধ' তোমাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে নইলে তুমি কেমন শিক্ষক?তোমাকে ভাবতে হবে নিজের ছাত্রীরা মেয়ে ও বোনের মতো।তারা সাময়িক ভূল করতে পারে যেটা এই বয়সী মেয়েদের হয়ে থাকে,একজন শিক্ষক হিসাবে তোমার জায়গা থেকে ভূল করা চলবে না। যদি কোন শিক্ষক জেনেশুনে এমন মারাত্মক ভূল করে তবে সে মানুষ নয় বরং ভূত হিসাবেই পরিচিত পাবে।এসবের মধ্যে মজনু দখলো তার গায়ের সবগুলো লোম খাঁড়া হয়ে গেছে ও শরীরের রক্ত প্রবাহ শান্ত হয়ে ওঠেছে। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো আমি বাইরে গিয়ে দেখি তোমার ড্রাইভার এসে গেলো কি না।এরপর থেকে সে কখনো রোমি নামের মেয়েটিসহ অন্য কোন ছাত্রীর চোখে চোখ রেখে কথা বলে নি।তার পথচলা ছিলো একজন অভিভাবক ও আদর্শ শিক্ষকের মতো।এমনি করে প্রায় সাত বছর সে যথেষ্ট সুনাম ও কৃতিত্বের সহিত সে একি কলেজে শিক্ষকতার মতো গুরু দায়িত্ব যথাযথ মর্যাদায় করতে সক্ষম হলো।
(৩)
২০০৯ সালে,প্রতিদিন কোন না কোন ছাত্র মজনুর কাছ থেকে বিদায় নিতে আসে।তাদের সবার গন্তব্য লন্ডন। সবাই পড়াশোনা করতে লন্ডন যেতে লাগলো। মজনু ভাবলো ব্যাপার কি! সবাই এত সহজে কিভাবে লন্ডন পাড়ি দিতে লাগলো।সে একজনের কাছে থেকে জানতে পারলো যদি ইউ,কে থেকে কোন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় স্পনসর করে তবে বৃটিশ সরকার সহজেই ভিসা দিয়ে দেয়।সে চাইলে চেষ্টা করে দেখতে পারে আর খরচ ও যতসামান্য।
মজনু অনেক কিছু ভেবেচিন্তে অবশেষে ইংল্যান্ডের গার্ডেন খ্যাত কেন্ট Kent (Garden of England) গ্রীণউইচ ও কেন্টাবারী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজে অনলাইনে আবেদন করলো। কিছুদিনের মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে অফার লেটার পেয়ে গেলো। অবশেষে সে কেন্টাবারী বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনের চোরাগলি পেরিয়ে আলোর ইতিহাস গড়ার প্রত্যাশা নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমায়।
লন্ডন যাওয়ার কথা শুনে তার বাবা বলেছিলেন -জীবনে কখনো তোর মতের বিরুদ্ধে আমি কিছু বলিনি কিন্তু আজ শুধু এটুকুই বলবো, বিদেশ কখনোই আনন্দ দিতে পারে না বরং যতটুকু সম্ভব দেশের মাটি ও মানুষের সাথে নিবিড় বন্ধুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকাটাই আনন্দের ও সুখের।
-বাবার কথা শুনে মজনু বলেছিলো,এমন করে বলো না বাবা। এদেশের অনেক বড় বড় লোক বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসে ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে।অনেক সচিব,মন্ত্রী মিনিস্টার লন্ডন থেকে লেখাপড়া করে এসেছে। যখন সুযোগ পেয়েছি তা আমি হাতছাড়া করতে চাই না।
আর মা বলেছিলেন,ছেলের বিদেশ যাওয়া মানেই মায়ের বুকভাঙা করুণ আর্তনাদ তুই যেতে চাস যা বাবা কিন্তু মনে হয় আমার আত্মার আর্তনাদ শুরু হয়ে যাবে আর কখনো তুই তা দেখবি না।
মায়ের কথা শুলে মজনু নরম সুরে বলেছিলো,
- এমন করে বলো না মা 'এমন হতে পারে আমি ডিগ্রী নিয়ে এসে যে কলেজে এখন প্রভাষক আছি সেখানে অথবা অন্য নামীদামী কোন প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করতে পারি।
মা- বাবা সহ পরিবারের সবাইকে বোঝাতে এক প্রকার ব্যর্থ হয়ে অবশেষে 2009 সালে মে মাসে মজনু লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১২:১৯