পর্ব -৬
বিকাল ছয়টায় বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে সুজন আসার কথা।এখন প্রায় সাতটা বাজে কিন্ত ফ্লাইট আরো ঘন্টাখানেক দেরী হবে এমন ঘোষণাই শুনা গেলো।
-রোজী বললো,
তোমাকে যেদিন রিসিভ করতে আসি সেদিনে এই সমস্যা ছিলো।নির্ধারিত সময়ের প্রায় দেড় ঘন্টা পড়ে ফ্লাইট এসে পৌঁছে ছিলো।
-পৃথিবীর অন্যান্য এয়ারলাইন্স যেখানে সময়ের খুব গুরুত্ব দেয় এবং যাত্রীসেবার মানও ভালো সেই তুলনায় বাংলাদেশ বিমানে অনেক বেশি ভাড়া নেয় কিন্ত জটিলতা প্রকট।
'এটা আমাদের আমলাতান্ত্রিক সমস্যা'
- আবার খবরে দেখি বছরের পর বছর বাংলাদেশ বিমান লোকসান দিচ্ছে। এই সব আমলারা কি সারা জীবন লোকসানের জন্য কাজ করে!
-আসলে কি জানো?
--না তো! কি!!
- বাংলাদেশ যদিও রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে,ভাষার জন্যে যুদ্ধ করেছে কিন্ত বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম ও ভাষা প্রেম নেই।
- এত চিন্তা তুমি বাংলাদেশ নিয়ে করো কিভাবে। আমি তো কখনো এভাবে চিন্তা করি নাই।
- তোমার তো টাকা পয়সার চিন্তা আর এখন নতুন সংযোজন ভাইকে বিয়ে করানোর। অবাক করার কিছু নয় যতদুর দেখলাম এই চিন্তা মনে হয় নিত্যকার সব বাংলাদেশীর মাথায় আসে।
- কি আসে?
- এই যে কি বলো তুমি'নিজে বাঁচলে বাপের নাম'
-- হা হা তাহলে কি করতে হবে বলো!
-- -- দেশের ও ভাষার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করতে হবে আর তা হতে হবে মনেপ্রাণে।
-বাবাকে প্রায় বলতে শুনতাম টাকা হলে নাকি বাংলাদেশে বাঘের চোখও পাওয়া যায়।এই টাকা টাকা করে কি সবাই টাকাগুলো কবরে নিয়ে যাবে!বা কেউ কি নিয়ে গেছে!
-- তা অবশ্য ঠিক বলছো।দেশের খুব কম লোকই তোমার মতো পজেটিভ চিন্তা করে।
- একটা কথা বলি,এদেশে একটা বৃটিশ পাসপোর্ট কেউ গ্রহন করতে হলে তাকে শপথ করতে হয়,যা তুমি নিজেও করেছো,মনে আছে কি শপথ করেছো!
- হ্যাঁ মনে আছে--
সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের শপথ যে, একজন ব্রিটিশ নাগরিক হয়ে, আমি বিশ্বস্ততার সহিত মহিমান্বিত রানী এলিজাবেথ দ্বিতীয়,তার উত্তরাধিকারী এবং উত্তরাধিকারী আইন অনুযায়ী সত্য আনুগত্য বহন অঙ্গীকার রাখবো ।আমি যুক্তরাজ্যকে আমার আনুগত্য দেব এবং দেশের অধিকার ও স্বাধীনতার সম্মান করব।
-- বেশ এটা এখনো মুখস্থ! বাংলাদেশে শুনতে পাই পাসপোর্ট টাকা দিয়ে যে কেউ নিতে পারে আবার সময় মতো নাম,ঠিকানা পরিচয় সব গোপন করে আবার নতুন পাসপোর্ট করে নিতে পারে। এটা কি দেশের প্রতি কোন দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়ে।
-তোমার দেশের প্রতি ভাষার প্রতি শপথের কথা কিছু বলো।
--- কি হলো!! তুৃমিও তো খুব শিক্ষিত ছেলে এবার বোকার মতো হাসছো।
-- এটা আসল শিক্ষা নয় সোহেল,অথচ দেখো ইংল্যান্ড একটি ইমিগ্র্যান্টদের দেশ,পৃথিবীর সব দেশ থেকে মানুষ এসে এখানে আবাস গড়েছে আী বাংলাদেশ এক টুকরো মানচিত্র পেয়েছে দীর্ঘ সংগ্রাম আর আত্মা ত্যাগের বিনিময়ে।
- তুমি তো দেখি বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ হিসেবে অভিভূত হলে। বাংলাদেশ নিয়ে অনেক ইতিহাস পড়া হচ্ছে আজকাল!! এগুলো সুজনের সাথে আলাপ করো। সে তোমারই মতো দেশপ্রেমিক।
-- ঘোষণা শুনতে পাচ্ছি 'বোয়িং ০০৭ কিছু ক্ষণের মধ্যে এসে পৌঁছে যাবে'
-- দেখ আসার কথা ছয়টা ত্রিশ মিনিটের সময় আর এখন আট টা বেজে দশ মিনিট।
-- কফি খেতে খেতে আর তোমার বাংলাদেশ বিষয়ক লেকচার শুনতে শুনতে সময় কিভাবে চলে গেলে। অপেক্ষা যদিও কষ্টের তবুও আজ আমার একদম খারাপ লাগে নি।তোমার সবগুলো কথায় যুক্তি আছে শুনতে মোটেই মন্দ লাগেনি।
" " " মেয়কে কাঁধে করে নিয়ে সোহেল যাত্রী আগমনের লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। একে একে বাংলাদেশ বিমান থেকে লোকজন এসে আত্মীয় স্বজনদের জড়িয়ে আবেগ আর ভালোবাসা বিনিময়ে করছে।এয়ারপোর্টে আসলে দেখা যায় কেউ প্রিয়জনের কাছ থেকে অশ্রুসজল চোখে বিদায় নিচ্ছে আর কেউ প্রিয়জনকে কাছে পেয়ে নিবিড় ভালেবাসা বিনিময়ে করছে। কাউকে পাওয়ার দূশ্য আর বিদায়ের মূহুর্তের কথা যদি মনে রেখে মানুষের প্রতি মানুষ সবসময় ভালো আচরণ করতো তাহলে হয়তো সমাজে এত অশান্তি বিরাজ করতো না। হারানোর বেদনা ও পাওয়ার সুখ ভুলে যাই বলেই জীবন এত বেদনাময়।
" " " অবশেষে সবার পিছনে সুজনের দেখা মিললো। সোহেল হাত তুলে ইশারা দিয়ে ভাই কে সম্ভাষণ জানালো। সুজন ভাইয়ের সাথে কোলাকুলি ও ভাবিকে সালাম বিনিময় করলো। সোহেল মেয়েকে সুজনের কাছে দিয়ে তার ব্যাগগুলো নিজে হাতে করে নিয়ে গাড়ির দিকে ছুটলো আর সুজন তার ভাতিজি 'রোহী'কে কোলে করে নিয়ে সোহেল কে অনুসরণ করে হাঁটতে লাগলো।
" " " রোজী দেখলো সুজন আসলেই একটা সোনার ছেলে। তাকে সালাম করার পর লাজুক মুখটা নিচু করে রাখলো। কখনো চোখে চোখ রাখেনি। কি শালীনতা ছেলেটার মধ্যে সত্যি প্রশংসনীয়।এমন ছেলেই সব মেয়েদের স্বপ্নের পুরুষ।এমন ছেলে সব মায়ের মুখ উজ্জ্বল করে।
" " "রোজী ড্রাইভ করছে কিন্ত মিউজিক দিতে পারতেছে না।দু ভাই রাষ্ট্রের সকল বিষয়ে কথা বলছে তো বলছে। যেন মনে হয় দুজন পুরনো বন্ধু যেন দূই যুগ পর একে অন্যকে পেয়ে আনন্দ আত্মহারা। মনেই হয় না যেন এরা ছোট-বড় দুই ভাই। এক ভাইয়ের প্রতি অন্য ভাইয়ে এমন আন্তরিকতা, এমন উচ্ছলতা, রাজীকে বিমুগ্ধ করে তুললো।
- রোজী আড়মোড় ভেঙে বললো -
দু ভাই যেভাবে পৃথিবীর সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করছো মনে হয় দুজন বিশ্ব পন্ডিত কথা বলতেছে আর শ্রোতা মাত্র আমি একজন।
- আচ্ছা তোমরা দুই ভাই আমার একটি কথার জবাব দাও না!
-- দূু ভাই একি স্বরে বললো, কি কথা!
- এই যে বিশ্ব রাজনীতি আর ধর্মনীতি নিয়ে এত আলোচনা করছো তাতে নিজেদের কি লাভ!
- হা হা, দুজন হাসি দিয়ে বলে।
-- এটা কি এমন কথা হলো!!
সোহেল বললো বুঝেছি,গাড়ি ড্রাইভ করার সময় তোমার মিউজিক শুনতে ভালো লাগে।'আচ্ছা'টপিক ভালো না লাগলো তুমি মিউজিক দিতে পারো
-- ভাবি মিউজিক দিতে পারেন।
রোজীর গাড়ির সিডিতে মিউজিক বেজে ওঠে ---
"মিছে এই দুনিয়ায়;কেন বেঁচে থাকার এত আয়োজন!!
পোড়া মন বুঝে নারে;বৃথাই রচে যাই মায়ার-ই- বন্ধন----
দিবানিশি ভাবি শুধু;সুখ পাখিটার আজ বড় প্রয়োজন--- ---
হায় কেন বেঁচে থাকার এত আয়োজন!!!
কত নদী ঢেউয়ে ঢেউয়ে হারায় য়ে কূল
কত রক্ত তারুণ্যে লুকানো বেহুয়া বাঁশির সুর
মায়াবতীর ব্যর্থ প্রেমের বিষমন্ত্রে;কেঁদে ভাসি সারাক্ষণ।
হায় কেন বেঁচে থাকার এত আয়োজন!!!
প্রেমহীন বুকে কেন এত জ্বালা;বিষাক্ত মুকুল
না পাওয়ার বেদনায় আঁখি-জল করে ছলছল ---
আশাহত মানুষেরা হা-হুতাশ,হাহাকারে;বেঁছে নেয় নির্বাসন?
হায় কেন বেঁচে থাকার এত আয়োজন!!!
বিফল যায় কত পূজা,ঝরে যায় কত ফুল,
ভুল পথে কত জীবন;সুখ-স্বপ্ন আঁধারে ছায়,
কত যে লুকানো ব্যথা পাথর বুকে;বুঝবেনা পাষাণ প্রিয়জন !
হায় কেন বেঁচে থাকার এত আয়োজন!!!
-- মিউজিক শুনে সুজন এক সেকেন্ড হ্যাঁ করে ভাইয়ের দিকে চাইলো।
-- তোর ভাবি বাংলা গান শুনতে আর বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণা করতে পটু এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই!!
""" এভাবেই গল্প ও বিভিন্ন ট্রাকের মিউজিক শুনতে শুনতে দীর্ঘ দেড় ঘন্টার ড্রাইভিং শেষ তারা সবাই বাসায় এসে পৌঁছালো।
সুজন ভাইয়ের বাসায় এসে দেখলো ভাবি তারজন্য রুমের মধ্যে নতুন বালিশ,কম্বল,সহ সবকিছু পরিপাটি করে রেখেছেন।
রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা বাজে দরজায় কলিং বেল শুনে সোহেল দরজা খুলে দিতেই ভেতরে আসলেন রেজীর মা ও ছোট ভাই রায়হান।
এত রাতে তারা এসেছেন সুজনকে দেখতে। এদিক সোহেলর আরেক বন্ধু একাউন্ট হাবিব সাহেব উনিও ফোন দিয়েছেন স্বস্ত্রীক সুজনকে দেখতে আসতেছেন কিছুক্ষণের মধ্যে।
" " " এত মানুষ এত রাত করে সুজনকে দেখতে আসছেন দেখে সপ নিজেকে বেশ সম্মানিত বোধ করলো। সবাই তাকে ইচ্ছামত উপদেশ,লন্ডন লাইফ,কত দিনের ভিসা,একেবারে থেকে যাও এসব নানান কথা বলতে লাগলেন।
-সুজন সবার সাথে আন্তরিকভাবে আলাপ আলোচনা করে পরিচয় পর্ব সারলো।সবাই সুজনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে তাকে ধন্যবাদ দিলেন। চা নাস্তা খাওয়ার পর বিদায় বেলা সুজনের হাতে রোজীর আম্মা পঞ্চাশ পাউন্ড, রায়হান একশ পাউন্ড আর বড় ভাই সোহেলের একাউন্টটেন্ট বন্ধু হাবিব সাহেব দুই শত পাউন্ড গিফট দিলেন।
রোজীর ছোট ভাই বিদায়ের সময় বলে গেলো সে কাল আবার আসবে তাকে সাথে করে লন্ডনের বাংঙালী পাড়া হোয়াইট চ্যাপেল নিয়ে যাবে।
" " " সবার এত এত ভালোবাসা ও আত্মীয়তা সুজনের অনেক ভালে লাগলো।
-সে ভাবলো এই সব টাকা গিফট আবার কেন?
-- তার ভাই কে প্রশ্ন করতে সে বললো লন্ডন কেউ প্রথম আসলে এমন গিফট দেয়া হয়। ভাইয়ের কথার সারবস্তু যা বুঝলো-
বৃটেনে নতুন কোন লোক দেশ থেকে আসলে আত্মীয় স্বজনের এমন খাতিরযত্নকে বাঙালির ট্রেডিশনাল ব্যাপার হিসেবে মনে হলো।
" " "এদেশে এখনো ভালো প্রথাগুলো চালু আছে আর আমরা আমাদের দেশে ভালো দিকগুলোকে প্রথাগত ভুল বলে ভালোটাকে মাটি চাপা দিয়ে যতসব মন্দকে লুফে নিয়ে এক আগাছায় পরিপূর্ণ জাতি হিসাবে বিনষ্ট হচ্ছি।
(চলবে)
পর্ব---১
পর্ব---2
পর্ব ৩/১
পর্ব ৩/২
পর্ব-- ৪
- পর্ব -৫
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১০:৪১