পর্ব - ৫
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সোহেল রব বলেতে লাগলো,
-তুমি আজ সময় করে একবার হেন্নার মাকে ফোন করে উনার খবরা-খবর নিও।
- 'ধন্যবাদ' দায়িত্ববোধ থেকে কথাটা বলার জন্য-
--সেটা আমারও মনে আছে,আসলে কাল আসার পর পরই ভাবছিলাম ফোন দিবো কিন্ত মনটা খারাপ হওয়াতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা জানি না। সেজন্য উনাকে ফোনটা করা হয় নাই,তবে একটু পরে ফোন দিবো।
'এই শোন'-আরেকটি কথা--
-- কি? বলো
আমাদের পাশের খোলা মার্কেটে আমার পরিচিত নাইজেরিয়ান এক লোক আছে। আমি প্রায়ই ওর দোকান থেকে ভেরাইটিজ শপিং করি। বেশ ভালো লোক।
----দেখি আমি কাল ওর দোকানে গিয়ে তার সাথে কথা বলবো -
----যদি সে সম্মত হয়ে পুরাতন মালামাল কিনে নেয় তবে হেন্নার মায়ের রুম পরিস্কার করে একটু শান্তিতে উনার ঘুমানোর সুযোগ করে দেয়া যাবে।
- 'প্লিজ'একটু এখনই গিয়ে জেনে এসো না-
- তোমাকে কোন কিছু বললে আর ধৈর্য থাকে না -সকাল নয়টার আগে কি দোকান খুলবে!
- আমি আজই যাবো, "ওকে"
- এবার খুশি তো--
- নাহ খুশি নয় এবার বলো কি সুসংবাদ দিতে চেয়েছিলে --
--অহ, হা"
তোমাকে তো আসল কথাটা বলা হয় নাই ;
-- আমাদের ছোট্ট জমিদার আগামী সপ্তাহে লন্ডন আসছে।সে এক বছরের জন্যে কিংস কলেজে লন্ডনে Teaching English to Speakers of Other Languages (TESOL)কোর্সে ইংলিশ টিচিং কোর্সের উপর মাষ্টার্স করতে এদেশে আসছে।
- আমার খুব খুশি লাগতেছে।
- ছোট জমিদার মানে তোমার মামাতো ভাই সুজনের কথা বলছো?
- আমার তো একটাই ভাই সুজন মল্লিক আর কি কেউ অাছে! --
--"নাহ" তাই তো"--
-- তাহলে তো সুজন ভাইয়ের জন্যে শপিং করে আনতে হবে--
--- তোামর স্টাডি রুমে একটা শোবার বেড আনতে হবে ---
তুমি তো দেখি এখনিই রাজ্যের সব চিন্তা শুরু করে দিলে!!
--- তোমার তো এখন হাত বেশ শক্তিশালী হয়ে গেলো। সুজনকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে হেন্নার মায়ের ঘর পরিস্কার করে দিয়ে আসতে পারে। আমার যেহেতু কাজ থাকে নতুবা আমিই যেতাম।
- ঠিক আছে, আমি একাই পারবো।
-সুজন ভাই নতুন লোক এদেশে আসবে তাকে কি করে বলবো চলো অপরিচিত একজনের ঘর পরিস্কার করে আসি?
'কি যে বলো!
- তুমি তাহলে সুজন সমন্ধে কিছুই জানো না। যদি জানতে তাহলে এমনটা বলতে না।
- আমি তো বিয়ের পর একবার দেখলাম ওকে আমার মনে হলো বয়সের তুলনায় যথেষ্ট মেচিউরড সুজন ভাই -
-- এটা অবশ্য তোমার খুব ভাল ধারণা,সুজন যদিও আমার চেয়ে ছয়-সাত বছরের ছোট তবুও তার কথাবার্তা,আচার আচরণ আমাকে মাঝে মাঝে অবাক করে দেয়।
-মনে হয় যেন যেন সে আমাদের চৌদ্দ গোষ্ঠীর মধ্যে একটাই রত্ন।
- এক কাজ করো,সুজন যেহেতু এদেশে আসবে তাই ওকে আর ফেরৎ যেতে দিবো না।
-নিজের একটা ভাই কাছে থাকলে বিপদ আপদে কাজে আসবে।
- তুমি তার জন্য একটা বৃটিশ পাত্রী দেখার ব্যবস্থা করো, আমিও নিজেও পরিচিত সবাইকে বলবো।
হা হা, এখনি ভাই কে বিয়ে করে সংসারি করানোর সব আয়োজন।
-- আমি কি ঘটক নাকি!! হুম
-- এদিক হেন্নার মা আমাকে বললেন তার মেয়ের জন্য পাত্র দেখতে।
-- আহ এই তো বেশ! তুমি তাহলে হেন্নাকে প্রপোজ করতে পারে আমার সুজনের জন্যে!
- যদিও মেয়েটা এখন কিছুটা এলোমেলো তবে আশাকরি তোমার মতো বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।
- কি আবোল তাবোল বলছে, সুজন ভাইয়ের সাথে হেন্নাকে কি মানাবে?
- এই মেয়েকে তো আমি চিনি তাছাড়া বয়সের একটা ব্যাপার তো আছে! সুজন ভাই কম করে হলেও তার পাঁচ বছরের ছোট হবে।
-- হা হা বয়সের ফারাক ইসলাম ধর্মে কোন সমস্যা নাই। রাসুল (সাঃ) পঁচিশ বছর বয়সে চল্লিশ বছরের বিধবা খাদিজা (রা) কে বিয়ে করেছেন।
- কিছু মনে করো না, আগের দিনের মানুষের মতো তুমিও নিজের স্বার্থের সময় ইসলামকে টেনে আনার অভ্যাসটা বাদ দেও।
- রাসুলুল্লাহ (সাঃ)প্রতিটি বিয়ের পিছনে বিশদ কারণ ছিলো সেটা নিশ্চয়ই জানো!
-- ওকে" সরি - বাদ দাও ইসলামের কথা!!
---তুমিও তো আমার দু বছরের বড়! কোথায় কোন সমস্যা!
-দেখ কথা বলে,যতদূর মনে হয় সে তো তোমার কথা শুনে।
- জানিনা কি বলবে,সে তো দেশের কোন ছেলে পছন্দ করে না।
- সুজন দেশের ছেলে হলে কি হবে,আরেকটা কথা তোমার হয়তো জানা নেই!
- সুজন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যাল থেকে এই বৎসর ইংলিশ সাহিত্যে অনার্স সম্পন্ন করেছে সেই সাথে সে যথেষ্ট প্রগতিশীল একটা যুবক যে এই বয়সেই রোটারিয়ান ক্লাব,ব্লাড ডোনার,চ্যারিটি অর্গেনাইজার,দক্ষ ডিবেটার সহ অনেক সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত।
--বাহ,বেশ কাজের ছেলে তো!!
"হুম" জানো--
- আমার মামা বাড়ির জমিদার প্রথা ধ্বংস হয়েছিল শুধু ক্ষমতার অপব্যবহার,মানুষের সাথে জুলুম আর নীতি বিবর্জিত সব অপকর্ম করার জন্য।
- আর সুজন হলো স্রোতের বিপরীতে চলা এক সাহসী মানুষ,এক অনুকরণীয় যুবক।
- সুজন ভাইয়ের কথা যেভাবে বললে!
তাহলে সে কি হেন্নাকে মেনে নিবে! তার ও তো মতামত দরকার!!
- "আরে" আমিই ওর গার্ডিয়ান,যা বলবো তাই মেনে নেবে তুমি প্রপোজ করো।
--"ঠিক আছে "তুমি যেহেতু নাছোড়বান্দা আর এত করে বলছো তবে চেষ্টা করবো।
-- "ধন্যবাদ" তাই করো।
" " " রোজী লক্ষ্য করলে কথাগুলো বলার সময় তার স্বামীর চোখো মুখে এক তৃপ্তি আর গর্বের ছাপ। যা তার খুব ভালো লাগলো। কাল সে দেখলো এমন এক সমাজ যখন মেয়েরা তাদের নিজ মা-বাবা কে সম্মান করে না দেখাশোনা করে না সেখানে মামাতো ভাইয়ের জন্যে এমন ভালোবাসা এমন বুকভরা গর্ব করার জন্য তার নিজের স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় গতকালের শোক পুরোপুরি কেটে গেলো। এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা তার সহজ সরল মনে সজীবতার কোমল পরশ মেখে দিলো। সাথে সাথে সুজন নামক এই সুপারহিরো কে খুব কাছে থেকে দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠলো।
" " " পরের সপ্তাহের শুক্রবারে সুজনের লন্ডন আসার দিন।
দুপুরের খাবারের পর সোহেল রব ও পুরো পরিবার লন্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলো-
'রোজী বললো' আজ আমিই ড্রাইভ করবো!!
- তুমি কেন ড্রাইভিং করবে?
-কেন! মনে নেই তুমি এদেশ প্রথম আসার সময় তোমাকে যদি ড্রাইভিং করে নিয়ে আসতে পারি তবে কেন তোমার ছোট ভাইকে নিয়ে আসতে পারবো না!!
আমি ডাইভিং করলে তুমি বরং তোমার ভাইয়ের সাথে গল্প করে করে আসতে পারবে--
--হা হা তা অবশ্য ঠিক ---'ধন্যবাদ'
" " " সোহেল আনমনে হয়ে ভাবে, সে যেদিন প্রথম লন্ডন আসে তখন রোজী তাকে এভাবে গাড়ি করে বাড়ি নিয়ে এসেছিল,
-আসার সময় রাস্তায় তাকে বলেছিল তোমার পছন্দের একটা গান গাও, আর তখন সে যে গান বলেছিল তা শুনে রোজীর কি মন খারাপ।
-সে সেদিন বলেছিলো এটা কি ভাষায় গান শুনালে! এটা কি রুচি তোমার? তখন নিজের কাছে নিজেকে অসহায় মনে হয়েছিল।
---মনে হয়েছিল তার সারা জীবনের শিক্ষা কেবলই বৃথা!!
'কি শিখলো' দু লাইন গান বলতে পারলো না তাও বাংলায়!
" " " রোজী তাকে সেদিন বলেছিল হাসন রাজা,আবদুল করিমের কত সুন্দর গান-- মায়া লাগাইছে, পিরীতি শিখাইছে এই রকম কত গান।
আর তুমি কি ভাষার গান করলে দু একটা শব্দ ছাড়া কিছু বুঝলাম না।
" " " ইঠাৎ মিউজিকের সুরে সোহেলের ইন্দ্রিয় সজাগ হলো -- এইত সেই চেনা সুর যা সে এদেশে আসার সময় রোজীকে শুনিয়েছিলো।
আর যে মেয়ে এই গানটি শুনে তাকে তিরস্কার করেছিলো সেই আজ সেই গান তার গাড়ির সিডিতে শুনছে! --
--তার নিজেকে বিশ্বাস হলো না--
বাহিরের দিকে চেয়ে দেখলো রাস্তার চারিদিকে সবুজ প্রকৃতির মাঝে গাছগুলো হাসছে আর যান-চলাচলের শব্দগুলো যেন নৃত্যর সুরে তাল মিলাচ্ছে।
-- না তাহলে এখনো মানসিক অবস্থা ঠিক আছে।
রোজীই মৌনতা ভেঙে বললো,
'মনে পড়ে এই গানের কথা'
-- আমি আসলে খুব অনুতপ্ত,
--তোমাকে না বুঝে সেদিন এমন কঠিন কথা বলা ঠিক হয়নি!
আমি এখন বুঝতে পারছি কতটা বোকা ছিলাম তখন।
- তোমার গাওয়া গানটি আমি বেশ কিছুদিন আগে অনুবাদ করে শুনার পর এত ভালো লেগেছিল যে এমন একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্যে।
-- আশাকরি তুমি কিছু মনে করো নাই!
-- সোহেল পরিতৃপ্তির হাসি হেসে খোদাকে ধন্যবাদ দেয়। তার স্ত্রীর এমন পরিবর্তন তাকে সাগর থকে নুড়ি খুঁজে পাওয়ার আনন্দে ভাসিয়ে দেয়।
" " " সোহেল রিমিক্স গানের মাঝে চোখ বন্ধ করে যেন শীতল জলের পরশ তার কোমলপ্রাণ মনে প্রবাহিত হলো --- গান চললো---
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে তোমায় পাইনি ওগো ----
বাহির-পানে চোখ মেলেছি,
আমার হৃদয়-পানে চাই নি ॥
You were hidden inside my heart
I did not see you baby
I looked at outside of me
I did not look inside my heart
আমার সকল ভালোবাসায়,সকল আঘাত সকল আশায়তুমি ছিলে আমার কাছে,তোমার কাছে যাই নি ॥
In all my love
In all my pain and hope too
You were with me
But I did not go to you ,,,,
তুমি মোর আনন্দ হয়ে ছিলে আমার খেলায়--
আনন্দে তাই ভুলেছিলেম,কেটেছে দিন হেলায়।
By becoming my joy
You were in my truth
I forgot due to joy
How to spend my youth
গোপন রহি গভীর প্রাণে,আমার দুঃখসুখের গানে
সুর দিয়েছ তুমি,আমি তোমার গান তো গাই নি ॥
By staying deep in my heart
You gave music to my songs
But I did not sing your songs----
" " " এভাবে মন ভুলানো হৃদয়ের গানে স্মৃতি রোমাঞ্চ করে নষ্টালজিক সোহেল ভাবে--
-জীবনে সংসার এক আলো আঁধারীর খেলা। মাঝে মাঝে রুদ্ধ হয়ে য়ায় কল্পনার চোখ।
এই দূর পরবাসে কখনো কখনো প্রিয় সংস্কৃতি, প্রিয় সুর,প্রিয় সংগীত জাগিয়ে তোলে বুক-পকেটে জমানো শত সহস্র বিবর্ণ কষ্টমাখা এক খণ্ড বিরহী প্রেম।
" " আর এভাবেই যখন সোহেলদের গাড়িটি থেমে যাওয়ার সাথে সাথে গানটি বন্ধ হলো। তখন সোহেল ঝাপসা চোখটি খুলে দেখলো তারা এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছে গেছে।
(চলবে)
(হেন্না কি তার বিয়ের জন্য মেনে নেবে রোজীর পস্তাব?জানতে সাথে থাকুন আগামী রবিবার।)
পাদটীকাঃ--- সোহেলের মামাতো ভাই জুয়েলের নাম আকীকা ছাড়া বদল করে 'সুজন' রাখলাম। আমার গল্পের নায়কের মতো প্রগতিশীল আমার প্রিয় অনূজ "সুজনের" নামানুসারে।@নজসু
নাহ কোন উৎসর্গ নয়!! আজীবনের জন্যে গল্পের বুকপকেটের ভেতরে রেখে দিলাম প্রিয় ভাই টিকে।ভালোবাসা বেঁচে থাক।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:০৮