পর্ব--৪
******-
রাত প্রায় আট টার সময় রোজী বাসায় ফিরলো তখন পূর্বাকাশে মেঘের তর্জন গর্জন। মেঘের আওয়াজের সাথে তার মনোজগতে শুরু হলো ভয়ঙ্কর তাবৎ অশান্তির গর্জন আর হৃদয়ে ভর করলো কালো মেঘের মতো অচেনা-অজানা কালো ভয়।
একজন মা'কে এমন পরিবেশে আর তার এমন পরিণতি দেখে,বাসায় ফিরে এসে তার হাঁফ ছেড়ে বাঁচা নয় বরং কলিজা ছেঁড়া আর্তনাদ শুরু হলো।
রোজী নিশ্চুপ হয়ে সোফায় বসে একমনে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার স্বামী নিজের জন্যে এবং রোজীর জন্যে পরিপক্ব হাতে কাপড় ইস্ত্রী করে চলছে।
রোজীর মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হচ্ছে না,শুধু ভাবনার অতলে হারিয়ে যায় তার অবুঝ মন। আনমনে বসে শুধু আজকের আজব দিনটার কথা ভাবছে!
স্ত্রীর এমন মনমরা অবস্থা দেখে সোহেল বলতে লাগলো-
কি হলো! তুমি ঠিক আছো তো!
--কেউ কোন অনুষ্ঠানে গেলে মন ভালো করে আসে আর 'তুমি তার উল্টো'!
--- কি হলো আমাকে খুলে বলো?
---আমি যেতে পারি নাই বলে মন খারাপ?
--অন্যমনস্ক হয়ে রোজি কি যেন ভাবছে দেখে, সোহেল খুক খুক করে কাশি দিয়ে রোজির দৃস্টি আকর্ষন করে আবার বলল-
-- আমিতো আরো ভাবছিলাম তোমাকে একটা সুখবর দেবো এখন দেখি, ---
"তোমার চাঁদ মুখ মলিন করে বসে আছো "
-রোজী কিছুটা স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলো কিন্ত স্বামীর চোখে চোখ পড়তেই সে অবুঝ শিশুর মতো কাঁদতে লাগলো---
তার স্বামী বুঝতে পারলো অবশ্যই কোন সমস্যা হয়েছে,তাই রোজীর মনের এই বেহাল অবস্থা।
যেকোন কারণে রোজী খুব বেশী কষ্ট পেলে অঝোরে কাঁদতে থাকে যতক্ষণ না আপনা আপনি কান্না বন্ধ হয়। স্বাভাবিক অবস্থা যা সাধারণত একটানা পঁচিশ মিনিট লাগে তার বাঁধ ভাঙা কান্না শেষ হতে।
তাই সোহেল রব তার স্ত্রী'কে বুকে জড়িয়ে ধরে অভয় দিয়ে বললো যাও রুমে গিয়ে শুয়ে বিশ্রাম নাও,
--আশাকরি সব ঠিক হয়ে যাবে!!
-সোহেল, স্ত্রীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আবারো টুকটাক গৃহস্থালি কাজে মন দিলো যা সাধারণত বন্ধের সময়টায় সে করে থাকে, যেমন ইস্ত্রী করা,মেয়ের খেলনা গোছানো,ঘরের মেঝে,বেলকনিসহ বিভিন্ন দিক পরিস্কার করা যাতে তার স্ত্রীর একটু সাহায্য হয় এবং এতে করে কায়িক পরিশ্রমের ফলে শরীরও কিছুটা হালকা বোধ করে।
-প্রায় ঘন্টা খানিক পর,সোহেল রবরুমে এসে দেখলো তার স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্ত তার চোখে এখনো ঘুম নেই। সে ভাবতে লাগলো তার স্ত্রী আসলেই একটা নিস্পাপ মেয়ে যে কিনা অতি সহজেই কাউকে বিশ্বাস করে,আবার একটু কষ্ট পেলে খুব সহজেই ভেঙে পড়ে।
আর বিয়ের পর তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করলো যেমনটা তার নিজের মধ্যেও এসেছে। এইতো মা-বাবার একমাত্র সন্তান হিসাবে সে কখনো রান্না করা তো দুরের কথা নিজের প্লেট ধৌত করে নি, নিজের জামা কাপড় মা আর বুয়া ধুয়ে দিতে আর ইস্ত্রী করার জন্যে সেই স্কুল জীবন ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সে কত টাকা গচ্চা দিয়েছে তার হিসাব করলে নিজের খারাপ লাগে।অথচ এদেশে নিজের কাজ সবাই নিজে করে নেই কোন বুয়া,নেই কোন সংকোচ,নেই কোন সংশয়। সে নিজে বাজার করে, ঘর পরিস্কার করে,নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করে। কাজে একদিন দেরী হলে পরেরদিন ডিসিপ্লিন মিটিং আর দেশে কত স্কুল আর কত ক্লাস ফাঁকি দিলো তার এসব ভাবলে নিজের কাছে খারাপ লাগা ছাড়া আর কিছু নেই।
আসলে পরিবেশ-ই বোধ হয় সম্পূর্ণরূপে মানুষকে তৈরি করে টিকে থাকার মতো মানানসই আর উপযোগী করে তোলে। মানুষ যে পরিবেশে বড় হয়, সে পরিবেশ থেকেই শিক্ষা গ্রহন করে। পরিবেশ-ই বড় শিক্ষক।এসব ভাবতে ভাবতে সেও চলে গেলো ঘুমের জগতে।
-এদিক বিছানায় শুয়ে পড়ে রোজী গভীর ঘুমে চলে গেলো যেমন করে বহুদিনের ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহ একটু আরাম পেলে হারিয়ে যায় ঠিক তেমনি।গভীর ঘুমের মধ্যে রোজী বাবাকে স্বপ্নে দেখলো, বাবা মারা যাওয়ার পর কখন সে বেশি কষ্ট পেলে বাবাকে স্বপ্নে দেখে আজও সেটাই হলো,
-------'বাবা তার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেছেন!!
''মাগো''তোর কি মনে আছে সেই একটি দিনই আমি তোর প্রতি খুব রাগ করেছিলাম?
মনে আছে সেই স্মৃতিকথা যেদিন জীবনের প্রথম ও শেষবারের মতো তুই আমার কথার উপর কথা বলেছিলে?
যখন তুই তোর কলেজ ফাইনাল ইয়ারে ছিলে, সেদিন রাতে আমি তোকে বলেছিলাম আমার জন্যে রুটি বানিয়ে আনতে। কারণ তখন ডায়বেটিসের জন্যে দু'বেলা রুটি খেতাম।
কি আশচর্য! সেদিন তুই বলেছিলে আব্বু আমি মা কে বলছি আপনাকে রুটি তৈরি করে দিতে কারণ কাল আমার ফাইনাল প্রজেক্ট জমা দিতে হবে।
-আর ঠিক তখনিই আমি রেগে গিয়ে বলেছিলাম ---
"তুমি আমার ছোট মেয়ে"
-- বড় মেয়েকে বিয়ে ---দেওয়ার পর এখন তোমার উপর মা-বাবাকে দেখাশোনা করার দায়িত্ব বেশী। আর সাথে সাথে তোমার একমাত্র ছোট ভাইকে ও তোমার শাসন,সোহাগ দিয়ে আমাদের মতো তোমারও সমান দায়িত্ব।
----আমার রাগ দেখে তোমার সে কি কান্না তার পরও আমি তোমাকে দিয়েই রুটি তৈরি করে তারপর খেয়েছিলাম।
--আজও হয়তো তুমি অনুধাবন করতে পারছো! কেন সেদিন তোমাকে এত কড়া শাসন করেছিলাম?
"তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে"
- সেদিন তোমাকে বলেছিলাম, জীবনে তিনটি জিনিস আজ থেকে মেনে চলবে এটা আমার আদেশ,
(১)জীবিত অবস্থায় সবসময় তোমার পিতামাতাকে দেখাশোনা করা,তাদের খেয়াল রাখা,তাদেরকে সদা সর্বদা খুশি রাখা
পিতামাতাই তোমার "বর্তমান"আর "প্রধান কর্তব্য" এতে কখন কোন পরিস্থিতিতে সামান্যতম গাফিলতি করো না।!
(২)তোমার আজকের এই লেখাপড়া হলো তোমার একান্ত "ব্যক্তিগত অর্জন"
যা তোমাকে আগামী দিনের জন্য মানুষ হয়ে সমাজে ভালোভাবে বসবাস করার জন্য উপাদেয় মাত্র। এই অর্জনের জন্য তোমাকে কষ্ট,যন্ত্রণা,ধ্যাণ,ধৈর্য প্রয়োজন তা সামর্থ্যনুযায়ী করো।
(৩)তোমার সন্তান হলো তোমার ভবিষ্যত। তুমি তাদেরকে যেমন দেখতে চাও তেমনইভাবে গড়ে তোল।আর সবসময় তাদের ও তোমার বর্তমানের উপর জোর দিও,বর্তমান ভালো তো ভবিষ্যত মসৃণ।
-----আমি আশাকরি আজ বুঝতো তোমার কোন দ্বিধাবোধ নেই,-------
------কেন আমি সেদিন তোমাকে এমন শাসন করেছিলাম?
------আশাকরি তুমি আমাকে কোন দোষারোপ করবে না?
------আমার জন্যে দোয়া করবে কারণ পিতামাতা তাদের মৃত্যুর পর আর কিছু নয় শুধু সন্তানের কাছে দোয়া চায়।
না'বাবা!! আমি কিছু মনে করিনি বাবা!!আমি তোমাকে ভালোবাসি বাবা!! "তুমি আমার আদর্শ বাবা----বাবা--"লাভ ইউ বাবা"-----
--- রোজীর মোবাইলে সেট করা নামাজের এলার্ম বেজে উঠলো "আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম"----
-----আর সাথে সাথে তার স্বপ্নের ঘোর কেটে গেলো।
------সে তার স্বামী'কে নামাজের জন্যে জাগাতে বললো।
------স্বামী স্ত্রী দুজন একসাথে ফজরের নামাজ শেষ করার পর,
---সোহেল খুব উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো কি এমন ব্যাপারে কাল পার্টিতে ঘটেছিল যে সে সারারাত এমন নির্জীব হয়ে শুয়ে পড়েছিলো।
রোজী তার স্বামীকে সবকিছু খুলে বললো কেমন করে একটা বাঙালি পরিবার আধুনিকতার নামে
উল্টাপাল্টা যা কিছু দেখেছে। সেই থেকে তার মনের সবকিছু যেন উল্টা দিকে ঘুরছে। সে কান্না বুকের মাঝে চেপে ধরে কোনভাবে সেই নরক থেকে বিদায় নিয়েছে।
---সোহেল বললো- সত্যি। বিশ্বাস করা যায় না দিনেে দিনে আমরা কিভাবে এতটা অমানুষ হয়ে চলছি!
- কী আজে বাজে ঘটনা অমাদের সমাজে ঘটছে? নিজের মা-বাবাকে অপমান,অবহেলা এই আধুনিক মানুষের!আমার একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না। এসব শোনার পর আমারো মন খারাপ হয়ে গেলো।
---রোজী বললো,আমি তোমার জন্যে 'চা'নিয়ে আসছি---
-- ঠিক আছে, তুৃমি 'চা'নিয়ে আসো আমি দেশে একটা ফোন দেই--
----রোজ খুব আগ্রহ নিয়ে বললো তুৃমি তো রাতে কি একটা সুখবর বলতে চেয়েছিলে!
----আমি ঘুমিয়ে পড়াতে জানতে পারিনি!
"এখন বলো"প্লিজ---
সোহেল রব মুচকি হেসে বলে,
--------তোমার তাহলে এখনো মনে আছে!--------
এটা মানুষের স্বভাবজাত বিষয়,যে যতই ঘোরে থাকুক আর যতই পাগল হোক বা মানসিকভাবে দূর্বল হোক সুখবর জানার জন্যে সব হৃদয়ে একটা ব্যাকুলতা কাজ করে ---------
(চলবে)
#কি সে সুখবর জানতে চোখ রাখুন আগামী রবিবার।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১:০৪