রোজী বরাবরের মতোই কিছুটা লাজুক প্রকৃতির।
হেন্নার জন্মদিনে উপস্থিত বিভিন্ন বর্ণের লোকের আগমন এবং তাদের পাশাপাশি নৃত্য দেখে সে তার মেয়েকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ভিতরে চলে গেলো।
ড্রয়িং রুমে এসে দেখলো সেখানে হেন্নার মেজ বোন জেস একটা ইষ্টার্ন ইউরোপীয়ান ছেলের সাথে বসে কথা বলেতেছে।
--জেসী কি জিগ্যেস করলো টয়লেটে কোন দিক?
জেসী তাদের নিচের টয়লেটেটি দেখিয়ে দিলো এবং বললো যদি বড় টয়লেটের প্রয়োজন হয় তবে উপরে চলে যেতে।
রোজী সাথে সাথে বললো "উপরে কি আর কেউ আছেন?
"জি" মা বাবা দু'জনেই আছেন।
--উপরের টয়লেটেটা ব্যবহার করে সাথে তাহলে মায়ের সাথে তাহলে দেখা করে আসি! --
ওকে - চলেন তাহলে --
--এই বলে জেসী তাকে সাথে করে উপরে নিয়ে গেলো।
--আপনি তাহলে এই বাথরুমে যান আমি মাকে বলছি ---
---না আমি বরং মায়ের সাথে আগে দেখা করি পরে বাথরুম ব্যবহার করবো ---
ওকে এটা তাহলে মায়ের রুম!
আপনি ভিতরে চলে যান মা আছে।
আমি নিচে যাচ্ছি এই বলে জেসী চলে গেলো।
রোজী, আস্তে করে দরজায় কড়া নাড়ার সাথে সাথে বয়স আনুমানিক পঞ্চাশের উপরে,চেহারায় মায়া মাখানো,একজন সুশ্রী মহিলা দরজার সামনে এসে দাড়ালেন।
"আসসালামু আলাইকুম "কেমন আছেন?
আলাইকুম সালাম-- তুমিই রোজী'না মা'?!!
---আমি ভালো আছি
-----'আসো' ভেতরে আসো-
এবার বলো তুমি কেমন আছো?
--"আলহামদুলিল্লাহ"আমিও ভালো আছি।
--- এখানে আসো 'মা' এই বলে ভদ্র মহিলা চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন।
-- চেয়ার বসার আগে রোজী হাতের ব্যাগ থেকে শালটা বাহির করে উনার গায়ে জড়িয়ে দিলো।
- শালটা পড়ার সাথে সাথে হেন্নার মায়ের দুচোখ জুড়ে কলকল করে অশ্রু বন্যা বইতে শুরু হলো।
রোজী বললো! আপনি কাঁদছেন কেন?
--- এমনিতেই মাঝে মাঝে চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।
-- আমার নিজের স্বামী ও মেয়েরা আমার দিকে খোঁজ নেওয়ার কথা কিন্ত তারা সবাই সবাইকে নিয়ে এত ব্যস্ত যে আমার দিকে তাদের তাকানোর সময় নেই।
কথাটা শুনার সাথে সাথো রাজীর বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। মনে হলো কতটা দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে উনি কথাটা বলছেন।
--এক হতভাগ্য মাকে দেখে হতভম্ব রোজীর নিজের অজান্তেই দু চোখ দিয়ে অঝোর শ্রাবণ বারিধারা বইতে শুরু করলো।
আর ভাবতে থাকলো,
--- উপরে জলজ্যান্ত মানুষের বাস নিচ থেকে তা কল্পনাও করা যায় না -----
- এটাই লন্ডনের তথা আধুনিক নগর রাষ্ট্রের সবচেয়ে সস্তা অচিন্তনীয় বিলাস যা মানুষকে একে অন্যের থেকে আড়াল করে আন্যের কোন কিছু চোখে পড়ে না মনে হয় সবই যথাসম্ভব নিজের ভেতর নিজেকে নিয়ে নিরামিষ জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
- এটাই তথাকথিত শিক্ষিত সমাজে বহুল চর্চিত প্রথা যা মানুষকে করে তুলছে অমানবিক।
-হেন্নার মায়ের সাথে কথা বলা অবস্থায় রোজী রুমের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলো এ তো রুম নয় যেন জিনিসপত্র রাখার গোদাম ঘর!!
রুমে ছোট একটা শোবার খাঠ, একটা বসার চেয়ার,একটা ছোট্ট টি টেবিলের উপর কালো রঙের সেই মান্ধাতার আমলের এনালগ টেলিফোন সেট ও সাথে পানির জগ রাখা।
রুমের চারিদিকে বিভিন্ন রঙের পলিথিন ব্যাগ,রিসাইকেল ব্যাগ দিয়ে মোড়া সারি সারি বেঁধে রাখা মালপত্র!!
---মনে হয় যেন এই বুঝি দম বন্ধ হয়ে আসবে।
-- একদিকে বাহিরের বাগানে মিউজিকের সুরের সাথে সিগারেট,পোড়া-মোরগ আর বিভিন্ন ধরনের পানীয়ের অসহ্য,বিদঘুটে গন্ধ আর এদিক এইরুমে বহুদিনের আলো বাতাসহীন,অন্ধকারের গুমোট গন্ধ ---
---রোজী আজ নরকের স্বাদ খুব কাছে থেকে দেখতে পেলো----
রোজী দেরী না করে জিজ্ঞেস করলো ---
---এই ব্যাগগুলোর মধ্যে কি আছে?
--- এগুলোর মধ্যে কাপড়-চোপড়,কিছু খেলনা,লেপ-তোষক আর কিছু রান্না করার বাসনপত্র।
-- এত কিসের কাপড়?
-- তোমার চাচার আগে ভেরাইটিজ স্টোেরের দোকান ছিল,আর উনার অসুস্থতার পর থেকে মালামাল এখানে রাখা আর আমার মেয়েদের কিছু পুরাতন কাপড় যেগুলো অনেক দামী সেগুলো রাখছি।
--- এগুলো তো বিক্রি করে দিতে পারেন নতুবা চ্যারিটি দিয়ে দিতে পারেন। এই মালগুলো রুমে রাখাতে তো আপনার ''অসুখ বিসুখ'' হয়ে যাবে।
রুমে আলো বাতাস দরকার।
--- কে সরাবে "মা " কে বিক্রি করবে?
--- আমার মেয়েরা তো শুধু অপচয় করতে চায়।
-- কেন চাচার অবস্থা কি খুব খারাপ!
---আপনার মেয়েরা আপনার কথা শুনে না? নাকি কখনো বলেন নি?
--- হেন্নাতো কখনো বলেনি চাচার অবস্থা খারাপ কিংবা উনি অসুস্থ!!
একটানা কথাগুলো রোজী বলতে থাকলো সে বুঝতে পারলো আসলেই এদের সমস্যা প্রকট।
-- হেন্নার মায়ের কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে রোজী বললো চাচা কোথায়?
--- পাশের রুমে!!!
---হ্যাঁ, মা পাশের রুমে ----
-- চলেন উনাকে একটা সালাম দিয়ে আসি ----
--- উনি তোমার সালামের উত্তর দিতে পারবেন না।
--- কেন!
--- এই তো কিছু দিন আগে প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন সেই থেকে কানে শুনা বন্ধ।
--- হায় আল্লাহ!! খুবই দুঃখজনক ---
--- ঠিক আছে তবে শুধু দেখা করে আসবো----
------ আসো তবে----
রোজীকে সাথে করে হেন্নার মা পাশের রুমে প্রবেশ করলেন। রুমে ঢুকে দেখলো একদিন কাত হয়ে নিস্ক্রিয় দেহ নিয়ে হেন্নার বাবা শুয়ে আছেন আর তার শিয়রের পাশে কচিমুখের এক নারী যার বয়স অনুমানিক বিশ বা বাইশের মতো হবে। রোজী দেখলো সেই নারী খুব নিস্পৃহতা নিয়ে বসে আছেন।
তাকে দেখে হাত তুলে সালাম দিলেন।
--রোজী সালামের উত্তর দিয়ে বললো,
---কেমন আছেন?
-- নারী খুব মৃদু গলায় বললেন জ্বী ভালো।
--- চাচা কি ঘুমাচ্ছেন?
--- জ্বী! উনি ঘুমাচ্ছেন। উনি তো প্রায় সবসময় ঘুমান কোনদিন দু থেকে চার ঘন্টা জেগে থাকেন।
-- আমি এই মেশিন দেখি কারণ এখানে উনার হার্টের মনিটরিং হয়।
--- রোজী দেখলো হার্টের আদলে তৈরি একটা মেশিন মেয়েটার পাশে।
-- চলো 'মা' আমার রুমে চলো।
এই বলে হেন্নার মা তাকে উনার রুমে নিয়ে গেলেন।
রোজী উনার সাথে উনার রুমে গেলো ঠিকই কিন্ত ভাবতে থাকলো কে সে নারী?
-- তার কথামতো দিনরাত সে কেনই বা মনিটার করবে একা উনার রুমে ?
সেই রহস্য উদঘাটনের জন্যে সে খুব সতর্কভাবে আবারো হেন্নার মায়ের সাথে কথাবলা শুরু করলো।
-- আপনি চাইলে আমি আপনার রুমটা পরিস্কারের দায়িত্ব নিতে চাই!
-- আপনার ফোনের নাম্বারটা আমি নিয়ে নিচ্ছি আমি ফোন করে আপনাকে বলবো কী করা যায়। -- এই ফোনে তো আপনাকে পাবো?.
-- "হ্যাঁ " মা আমাকে পাবে--
-- মাঝে মাঝে আমার ভাই দুবাই থেকে ফোন করে আমার খবর নেয় এছাড়া কোন ফোন আসে না। তুমি ফোন করো মাঝে মাঝে তোমার সাথে কথা বলে মনটা হালকা করবো।
-- জ্বী আচ্ছা ---
-- আমি প্রায়দিনই আপনাকে ফোন দিবো।
-- ধন্যবাদ! " মা "
-- " মা" রোজী তোমাকে একটা কথা বলি যার জন্যে তোমাকে দেখা করতে বলছি ---
--- জ্বী, বলেন।
--- আচ্ছা আমার বড় মেয়ে কারো কথা শুনবে না তবে আমার মনে হয় সে তোমার কথা শুনবে।
-- তোমাকে সে খুব পছন্দ করে।
-- তুমি বুঝিয়ে ওকে একটা বিয়ের ব্যবস্থা করে দাও।
--- সেতো বৃটিশ ছেলে ছাড়া বিয়ে করবে না!-
--- যে কোন ছেলে হোক আমার কোন সমস্যা নেই। আর তার বাবার তো মুখ,কান,হৃৎপিন্ড সব বন্ধ উনার কিছু বলার নাই।
--- আচ্ছা মা আমি মনেপ্রাণে দেখবো।
--- চাচার শারীরিক অবস্থা কতদিন থেকে এই রকম?
--- সে আজ তিন বৎসর হতে চললো।
--- আচ্ছা মা উনার সাথে রুমে কে?
--- আপনি কেন উনার রুমে থাকেন না?
--- রোজীর প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই উনি আবারো কাঁদতে শুরু করলেন।
-- রোজী আলতো করে উনার কাঁধে হাত রেখে হাতের টিস্যু দিয়ে চোখের পানি মুছতে লাগলো।
-- রোজী বুঝতে পারলে কতটা দুঃখ নদী উথাল হয়ে আছে উনার মনে।
-- উনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগলেন। আজ থেকে প্রায় চার বছর আগে হেন্নার বাবা দেশে গিয়ে নিজের মেয়ের বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করে এদেশে নিয়ে আসেন। কারণ ছিলো কোনভাবে একটা ছেলে সন্তান পাওয়া। আমি সাতটা মেয়ে জন্ম দিলাম আমার ঘরে নাকি ছেলে হবে না আর এই শেষ বয়সে তার ছেলের দরকার হওয়াতেই নাকি সে বিয়ে করে। এই মেয়েকে ঘরে নিয়ে আসার পরই
যে আমি এত দিনের সংসারের আপন সে মুহূর্তে পর হয়ে গিয়ে সেই থেকে একা একা থাকতে হচ্ছে।
আর উনার এই বুড়ো বয়সে ভীমরতি উনার কোন মেয়ে ভালোভাবে নেয়নি বরং ভীষণ তিরস্কার করে যার ফলে তার হৃদপিণ্ডে আঘাত লাগে এবং তিনি বাকশক্তি ও শ্রবনশক্তি হারিয়ে ফেলেন।
এই কথাগুলো শুনার পর, রোজী উনাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোন ভাষা খুজে পেলো না। তার কণ্ঠনালী স্থবির আর হৃদয় বেদনাহত হয়ে গেলো। এত দুঃখী নারী সে তার কর্মজীবনে ও ব্যক্তিজীবনে এর আগে কখনো দেখেছে বলে মনে হলো না।
এত দুঃখ নিয়ে মানুষ পৃথিবীতে দিব্যি বেঁচে আছে। একদিন কণ্যাদায়গ্রস্ত মা অন্যদিকে স্বামীর অধিকার বঞ্চিত স্ত্রী।
সে নিজ চোখে যা দেখলো আর নিজ কানে যা শুনলো তাকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করবে তার কোন ভাষা খুজে পেলো না।
রোজী বললো মা আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে মেয়ের ঘুমের সময় হয়ে গেছে আমি আপনাকে ফোন দিয়ে কথা বলবো এবার আমাকে বাসায় ফিরে যেতে হবে।
রোজী উবার ট্যাক্সিক্যাব ডেকে পৃথিবীর বুকে একখণ্ড নরক থেকে তার ছবির মতো সাজানো স্বর্গের সংসারের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলো।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১:৩৭