২০১২ সালের জুলাই মাসের ত্রিশ তারিখ।
এক শান্ত দুপুরে আনুমানিক দুপুর দু'টার দিকে রোজী তার চার বছরের মেয়ে রুহি কে নিয়ে হেন্নাদের বাসায় উপস্থিত হলো।বাসাটা বেশ বড়সড় ও খোলামেলা যার সামনে ও পিছনে বাগান রয়েছে ।
রোজীকে দেখে তার বান্ধবী বেশ খুশি হলো। তকে জড়িয়ে ধরে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গেলো।
রোজী দেখলো সেখানে অনেক লোক,অনেক বর্ণের যুবক যুবতী এলোপাথাড়ি ভাবে বসে খোশগল্পে মেতে আাছে। পাশের কোনটায় বিভিন্ন বর্ণের কয়েকটা শিশু ও খেলাধুলা করতেছে।
হেন্না,একে একে সব অতিথিদের সাথে রোজীকে পরিচয় করিয়ে দিলো।
--রোজী অর্ধনমিত নয়নে হাত তুলে সবাইকে "হাই" সম্বোধন করলো।
- বোনদের সাথে পরিচয় পর্ব সেরে উঠার পরপরই রোজী তার হাতের উপহার বক্সটি হেন্নার হতে দিয়ে বললো এই সামান্য উপহার তোর জন্যে।
উপহার টি পেয়ে হেন্না খুশিতে হা হা করে হেসে উঠে। বান্ধবীর খুশি দেখে তার মনটা যতটা না খুশি হলো তার চেয়ে বেশী কষ্ট তার বুকে তীরের মতো বিঁধে গেলো।
-বিষাদভরা হৃদয় নিয়ে রোজী ভাবতে থাকলে ---
হায় আল্লাহ!! এ কোন নরকে এলাম!!!
-বাঙালী অনেক পরিবারে সে এর আগে গেছে ও সবসময় যাওয়া আসা হয়--
-কিন্ত!! এ তো বাঙালি পরিবার নয়-ই বরং বাঙালী বললে লজ্জা হবে।
- এরা নিশ্চিন্তে যেকোন ইংলিশকে হার মানাবে -
-বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ছেলে মেয়েরা একসাথে এক সোফায় কোন ভেদাভেদ ছাড়া পাশাপাশি বসে আছে--
-- নারীদের মধ্যে কারো পড়নে,স্কার্ট,সর্ট কামিজ,টি সার্ট,কাউকে কাউকে দেখে আবার পুরুষ না মহিলা তা চেনা দুস্কর। মনে হয় যেন সরাইখানায় বেহায়াদের উদ্ভট আড্ডা চলছে ।
রোজীর কাছে অবাক করার মতো ব্যাপার হলো,
সব বোন যেভাবে আড্ডা দিতেছে,তা দেখে হলো
পারিবারিকভাবে বাঙালী শিষ্টাচারের সামান্যতম ছায়া আছে বলে মনে হয় না।
হেন্না যাকে তার সবচেয়ে ছোট বোন হিসাবে পরিচয় করে দিয়েছিল। রোজী দেখলো তার পরনে গ্রে রঙের টি শার্টে। যার মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট ভাবে তার নিটোল পাহাড়ের মতো উঁকি দেয়া মাংসালো বক্ষ দেখা যাচ্ছে।যাতে 'বব মারলের' হাসিমাখা ছবি আর তাতে জল রং দিয়ে লেখা
""আই এম এ হিউম্যান"'
রোজীর মন যেন খুব জোরে বলছে""দুর ছাই"" --
---হিউম্যান না এনিম্যাল--
রোজী খেয়াল করে দেখলো ছোট বোনের আর কারো দিকে লক্ষ্য করার বা কথা বলার আগ্রহ নেই। সে একটি ছেলের সাথে সোফার একপাশে বসে মুখ গুঁজে খুব অন্তরঙ্গ হয়ে কথা বলতেছে। মনে হচ্ছে যেন জলের সাথে সাঁতার কাটতে যাওয়া সাঁতারু যেমন মগ্ন হয়ে জলের পানে চেয়ে থাকে ঠিক তেমনি এই বুঝি ডুব দিবে এমন অবস্থা।
যার সাথে কথা বলতেছে তাকে দেখতেই রোজীর ভয় হচ্ছে।ছেলেটা এক দিকে দেখতে যেমন হেংলা,পাতলা তার উপর কুঁচকো চুল,ভয়ার্ত ইয়েলো দাঁত আর কয়লার মতো কালো গায়ের রঙ।
-আহ!! এমন ছেলে এই ঘরে এলো কিভাবে?
এদিকে রোজীনার এমন চাওয়া আর চেহারার ভঙ্গি হেন্নার সন্দেহ হলো।
---সে তাড়াতাড়ি করে বোনের সাফাই গেয়ে শোনালো।
'দোলা' মিডলসেক্স ইউনিভার্সিটিতে মিউজিক নিয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছে -
আর তার বন্ধু "টিগরা" ও ভালো টিউন করে।
ও আজ আমাদের গান গেয়ে শুনাবে।
টিগরা বললো -- হ্যাঁই ROSE.
"সরি" -- মাই নেইম ইজ রোজী নট রউজ।
রোজীর শব্দগুলো গুলিয়ে গেলো তার দিকে তাকিয়ে।তার মনে হলো বাকরুদ্ধ হয়ে যাবে।
হায়!! রুচিশীলতা!!
টিগরা আরো অনেক কিছু বলতে লাগলো আর নীরবভাবে রোজী শুনতে থাকলো কোন উওর দিলো না।
--অদ্ভুত পৃথিবীতে কত অদ্ভুত মানুষ!!--
-- সে আরো কালো বা নিগ্রো দেখেছে কত শালীন,কত সুশ্রী,কালো হলেও তাদের নিজস্ব সৌন্দর্যে ভর্তি।
আর যদি কাছরা বা রুচিবোধ না থাকে তবে কালো আর সাদা হোক তাকে বিশ্রী দেখাবেই।
আসল সৌন্দর্য প্রকাশ পায় রুচিশীলতায়,গাঁয়ের রঙ বা পোষাক আশাকে নয়।
এদেশে অনেক বাঙালী মেয়েরা কালো ছেলেদের বয়ফ্রেন্ড হিসাবে গ্রহণ করা বেশ বাহাদুরির কাজ মনে করে।রোজী ভাবলো কালো ছেলেটার সাথে কি হেন্নার বোনের এরকম কিছু একটা সম্পর্ক আছে? এর ক্লু বাহির করতে হবে দরকার হলে এদের বাসায় দীর্ঘ ক্ষণ থাকবে। যদি বাসায় যেতে একটু দেরী হয় তা ম্যানেজ করে নিবে। রোজী আরো ভাবলো এ ঘরে মনে হয় কোন মুরব্বী লোক নেই থাকলে মায়ের এত অবাধ মেলামেশা করতে পারতো না। হেন্না এমনিতেই বলেছে তার মা স্পেশাল দাওয়াত দিয়েছে মনপ হয় উনি বাসাই নেই।
রোজী যখন এসব আজেবাজে চিন্তা করতেছে তখন হেন্নার মেজ বোন 'জেস' এসে তার কোল থেকে মেয়েকে নিয়ে গেলো এবং রুহী অন্য শিশুদের সাথে খেলায় যোগ দিলো।
সোফার জবুথুবু হয়ে বসে থাকা রোজীর মনে হলো
! নাহ! আর পারছি না এই পরিবেশে।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যাওয়াই শ্রেয়।
"সে হেন্নাকে এবার বলেই ফেললো-----
-----অনুষ্ঠান কখন শেষ হবে?
---সন্ধ্যার আগেই আমাকে বাসায় ফিরে যেতে হবে---
হেন্না বললো,
---অনুষ্ঠান তো এখনো শুরুই হয়নি!!!
---কোন চিন্তা করিস না,রাত হলেও সমস্যা নেই!!
--আমি নিজে তোমাকে বাসায় দিয়ে আসবো।
--শুধু স্যামের জন্যে অপেক্ষা করছি।সে আসলে অনুষ্ঠান শুরু করে দিবো---
রোজী বললো স্যাম কে রে? আমি কি চিনি ওকে?
না তুই চিনবি না! "আমার কাজিন" পাশেই থাকে
ওহ!
ও Barbeque ভালো করে তৈরি করতে জানে।
ওহ্ তাই---- ঠিক আছে!
দেখি স্যামকে ফোন দেই, যখনি ফোনটা হাতে নিয়ে হেন্না কল দিতে লাগলো তখনি মেইন ডোর থেকে একটা শব্দ ভেসে এলো!
--- আই এম হেয়ার ---- বলেই কিছুক্ষণ পরেই ড্রয়িং রুমে সাদা টি শার্ট ও ব্লু হাফপেন্ট পরহিত এক যুবক হাজির। সবার সাথে টাচ! টাচ বলে কোলাকুলি করতেছে।
রোজীর কাছে এসে হাত বাড়াতেই সে হাত না বাড়িয়ে মুখ দিয়ে বললো "হ্যালো"
এই প্রথম রুম ভর্তি লোকের মধ্যে কেউ একজন তার সাথে হাত মেলাতে অপারগতা প্রকাশ করায় সে লজ্জিত বোধ করলো।
একটু ইতস্ততা কাটাতে স্যাম নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে লাগলো "পপি"কে পিছনের গার্ডেনে রেখে আসছি।
তোমাদের "প্রেম" কোথায়? -হোয়ার ইজ প্রেম দোলা?
'দোলা' বললো প্রেম ইজ উপষ্টেয়ারস, ইন মাদার'স রুম।
উপর থেকে নিয়ে আসছি----
রোজী তাদের আলোচনার কিছুই বুঝলো না সে ভাবলো -পপি মনে হয় স্যামের স্ত্রী যাকে পিছনের বাগানে রেখে আসছে।
তাহলে প্রেম কে?
মায়ের রুম থেকে নিয়ে আসছে! তাহলে তো তার মা উপরে আছেন! এতক্ষণ তার মায়ের কথা জিগ্যেস করে নাই মনে মনে ভাবছিলো বাসায় কোন মুরব্বী নেই। তাহলে এবার হেন্নাকে বলে মায়ের কাছে চলে যাবো।
"দোলা" উপর থেকে নিচে এসে'
কোলে করে বেশ বড়সড়, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী একটি কালো রঙের বিড়াল নিয়ে দোলার কোল থেকে স্যামের কোলে তুলে দিয়ে বললো -- টেইক ইওর "প্রেম"
হায় খোদা ---
"তাহলে এটাই "প্রেম"!!!
"স্যাম"প্রেম কে চুমু দিতে দিতে পিছনের বাগানে চলে গেলো -- আর বলতে লাগলো বারবিকিউ জ্বালাইতেছি। সবাই আসেন।
-- এভরিওয়ান প্লিজ কাম টু ব্যাক গার্ডেন-
রোজী ভাবলো উপরে গিয়ে হেন্নার মায়ের সাথে কথা বলে তার জন্যে আনা উপহার টি দিয়ে বিদায় নিবে এমন সময় দোলা এসে তাকে পিছনের বাগানে নিয়ে গেলো-
রোজী দেখলো সবাই যার যার মতো করে কথা বলতেছে এই যেন এক গল্পের বাগান -
কারো কোনদিকে কি ঘঠছে তার ভ্রুক্ষেপ নেই, যেন পৃথিবীর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে কিছু প্রাণী মেতে উঠেছে সাময়িক প্রীতির মেলায়।
রোজী বাগানের দক্ষিণ পূর্ব দিকে একটা চেয়ারে বসে উপভোগ করতে লাগলো কিছু উড়নচণ্ডী মানুষের কার্যকলাপ -
স্যাম কয়লার আগুনের একটি চুলার উপর শিকলে বেঁধে একে একে মোরগের টুকরো ও শিক কাবাব পোড়া করতেছে আর কেউ কেউ এসে তা ওলট পালট করে দিয়ে ইয়ামী ইয়ামী চিৎকার দিতেছে।
স্যামের দু'হাত দিয়ে দুটি প্রাণীকে আদর করছে এবং বলছে --
ওয়েট!! তোমদের খাবার আগে দেবো ডিয়ার 'প্রেম এন্ড পপি '
আহ! তাহলে এটাই পপি --
তার বা হাতের কব্জিতে বাঁধা ছোট্ট একটা কুকুর যাকে সে আদর করতেছে।
--এই লোকের হাতের খাবার খাওয়ার কোন রুচি নেই ---
কিছুক্ষণ পর দোলা একটি প্লেটে করে হাফ চিকেন,দূ টুকরো শিক কাবাব ও কমলার জুস নিয়ে এলো।
---এটা আপনার জন্য রোজী আপা
--ধন্যবাদ দোলা--
-- টেবিলে রেখে দাও প্লিজ --
জুসের গ্লাস টেবিলে রাখতে গিয়ে দোলার বক্ষযুগল যেন জুসের সাথে টেবিলে উপুড় হয়ে আসবে এই অবস্থা।
দোলার এই সল্প বসন দেখে রোজীর যারপরনাই লজ্জাবোধ হলো,কিন্ত দোলার বোধের দেয়ালে তো পেরেক ঠুকে গেছে তার এদিকে কোন সংকোচ নেই।
-সবাই তার দিকে কিভাবে তাকাচ্ছে তা এই মেয়েটা যদি জানতো!!
-অশালীনতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে এই বাংগালী পরিবার--
-- এখন তো সামার হলিডে আমাদের বাসায় একবার বেড়াতো আসো "দোলা"
-আপা আমি তো কালকে স্পেনের আভিফায় চলে যাচ্ছি তাই আমার হাতে এবার সময় নেই অন্য একবার বন্ধের সময় যাবো--
----"ঠিক আছে" তবে একবার সময় করে আসো
--- কার সাথে যাচ্ছে স্পেন? ---
-- আমরা ভার্সিটির চার বন্ধু --
আর কোন প্রশ্ন করার আগেই দোলা বললো-
আমি,টিগরা, রোনান ও কিটি আমরা ব্যাচমেট।
--- হায় এই মেয়ে তাহলে এই নিগ্রো ছেলের সাথে হলিডেতে যাবে তাতে পরিবারের কেউ কিছু বলবে না।
যেমন করে আমাকে বললো তাতে তো পরিবারের সবাই জানার কথা ---
--নিজের মেয়ের জন্য রোজীর নিজের প্রতি লজ্জা এলো।
---কোথায় নিয়ে এলাম মেয়েকে?
--- এমন পরিবেশ জানলে মেয়েটি তো দূরের কথা সে নিজেও আসতো না।
দিনের আলো নিভে গুধুলীর লগ্নে 'টিগরা' গিটার হাতে গান শুরু করলো---
When the night has come
And the land is dark
And the moon is the only light we'll see
No I won't be afraid, no I won't be afraid
Just as long as you stand, stand by me
So darlin', darlin', stand by me, oh stand by me
Oh stand by me, stand by me
সব যুবক যুবতীরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে সুর মিলিয়ে গাইতে থাকলো ------
আর রোজী বোকার মতো এই বেমানান পরিবেশে নিজেকে একজন অতি সাধারণ ও ব্যাকডেটেড নারী হিসাবে আবিস্কার করলো তাতেই তার তৃপ্তিবোধ হলো---
(চলবে)
পর্বটি বেশ লম্বা হওয়াতে দুটি পর্বে দিতে হলো
পর্ব---১
পর্ব---2
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:৩৯