বিশ্বে বিশেষত মুসলিম বিশ্বে, ভারতে এবং মিয়ানমারে ধর্মান্ধতা জেঁকে বসেছে বেশ প্রকটভাবে। প্রধান প্রধান ধর্মের অনুসারীরা আজ আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশী উগ্র এবং সহিংস মানসিকতা যে ভীষণভাবে ধরে রাখতে শুরু করেছে এটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। সবার মধ্যেই যেন এক “মাইর্যা ফেলামু, কাইট্যা ফালামু” টাইপের মনোভাব। কিন্তু তাতে যে এটাকে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর এক নির্মম দুরভিসন্ধিমূলক খেলা কাজ করছে সেটা কিন্তু এড়িয়ে গেলে চলবে না। আজ সেটাই লিখছি।
শুরু করা যাক ইসলাম নিয়েই। আমাদের মুসলিম বিশ্বে আজ এই যে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প কাজ করছে এটার শুরু কিন্তু হয়েছে কমিউনিজম বিরোধিতা করতে গিয়েই। কি করে? সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর পৃথিবী থেকেই শুরু করা যাক। আপনারা হয়তো খুব ভালো করেই জানেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর গোটা বিশ্ব মার্কিন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এর নেতৃত্বে দুটো শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ততদিনে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে কমিউনিজমের মতাদর্শ। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই। এখানে মধ্যপ্রাচ্যকে নিজের হাতে রাখার জন্য শুরু থেকেই তাগিদ ছিল মার্কিনীদের। মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার এক ব্যাপক অঞ্চল, বিশেষ করে তাদের লক্ষ্য ছিল সেদিনের পাকিস্তান থেকে শুরু করে একেবারে তুরস্ক পর্যন্ত একটা ইসলামিক দেয়াল তৈরি করা। যে দেয়াল ভেদ করে কমিউনিজম এর মতাদর্শ বিস্তার লাভ করতে পারবে না। এজন্য তারা বেছে নিয়েছিলো উগ্র ইসলামী মতাদর্শগুলোকেই। বিশেষত ওয়াহাবি এবং সালাফি মতাদর্শ ছিল এক্ষেত্রে তাদের রীতিমতো প্রিয় বস্তু। সেই লক্ষ্যে মুসলিম দেশগুলোর ভেতর সৌদি আরব ও পাকিস্তান ছিল তাদের সবচেয়ে বড় সহায়, সবচেয়ে বড় অস্ত্র। এই সবার ভেতর অবশ্য সৌদি আরব ছিল তাদের সবচেয়ে প্রিয়। ৬০ এর দশকে দ্বিতীয় আরব ইসরাইল যুদ্ধের পর যে পেট্রো ডলারের উত্থান এবং এর মাধ্যমে সৌদিকে দিয়ে উগ্র ওয়াহাবি মতাদর্শের প্রচারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রোল প্লে করেছিলো আমেরিকার সি আই এ। বছরের পর বছর আরব দেশগুলোতে স্বৈরশাসকদের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করা এবং তোয়াজ তোষণ করার কাজটি অত্যন্ত নিপুণভাবে করে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। এরই প্রতিক্রিয়ায় মধ্যপ্রাচ্য তো বটেই গোটা মুসলিম বিশ্বে সেই যে বিষের কার্যকারিতা শুরু হল আজ তা কতোটা ভয়ঙ্করভাবে কাজ করছে সেটা নতুন করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। এর মধ্যে আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন আগ্রাসন চালিয়ে বসলো আফগানিস্তানে। এক বিষ ছাড়াতে গিয়ে (অর্থাৎ সোভিয়েত দখলদারিত্ব দূর করতে গিয়ে) এবার পাকিস্তানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এমন বিষ ঢালল আফগানিস্তানে এই আফগান মুজাহিদিন তৈরি করে যে আজ গোটা উপমহাদেশ এর ভারে থরহরি কম্পমান। সেসময় হাজার হাজার মাদ্রাসা গড়ে ওঠে পাকিস্তানে আর সেখানে উগ্র ইসলামী মতাদর্শ তো নিয়মিত প্রচার হতোই, তার সাথে যে বর্ডার পেরিয়ে আসা আফগানদের জঙ্গি বানিয়ে আবার আফগানিস্তানেই ফেরত পাঠানো হতো সেকথাও মনে হয় নতুন করে বলার দরকার নেই। আর সি আই এর তত্বাবধানে সুনিপুণভাবে এই সমস্ত কাজ করে গেছে পাকিস্তানের আই এস আই এবং পাকিস্তানের মিলিটারি। দূর থেকে যুদ্ধাস্ত্রসহ সমস্ত লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র, সেই পাকিস্তানের মাধ্যমেই । আর সেই আফগান মুজাহিদিন থেকে তারা আজকের তালেবান। এসব ভয়ঙ্করের চক্করে পড়ে কমিউনিজম তো পগারপার হলই, আজ এটা এক সর্বগ্রাসী এক দানবে (অর্থাৎ সহিংস ইসলামী ধর্মান্ধতা) পরিণত হয়ে পড়েছে।
আমাদের দেশে যে শান্তির ইসলাম একসময় ঢুকেছিল সুফি ইসলামের বেশে আজ সেই সুফিবাদি ইসলাম কোণঠাসা হয়ে পড়েছে সহিংস ইসলামীজমের খপ্পরে পড়ে।
এদিকে ভারতে ক্ষমতায় এসেছে সাম্প্রদায়িক বিজেপি। উগ্র ইসলামী মতবাদের মতো তাদের হিন্দুত্ববাদও আরেক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক বিষ এর নাম। বলা যায় উগ্র জঙ্গিবাদি ইসলামের মতোই এই হিন্দুত্ববাদ আরেক জঙ্গিবাদী দানব। এবং খেয়াল করে দেখবেন এই দুই দানবই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কতো সুসম্পর্ক রেখে চলছে। অতি কঠোর রকমের বৈষম্যবাদী হিন্দুত্ববাদি আর এস এস তাণ্ডব চালাচ্ছে গোটা ভারত জুড়েই। সাধারণ গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে মুসলমান পিটিয়ে মারার রেকর্ড তো এদের আছেই, আছে খোদ স্বধর্মের নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায় এর মানুষজনকেও মন্দিরে প্রবেশ করতে চাওয়ার অপরাধে পিটিয়ে মারার মতো জঘন্যতম কাণ্ড। ভারতের এতো সমস্যার সব কারণ তারা চাপিয়ে দিয়েছে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর। এদের প্রচারণা ভারতীয় সংখ্যাগুরু হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা গিলছে দেদারসে। এসবের প্রতিক্রিয়া এমনই যে অনেক শিক্ষিত ভারতীয়র কমেন্ট বা বক্তব্য দেখে রীতিমতো আশ্চর্য হতে হয়।
আর এদিকে রইলো বাকি মিয়ানমারের কাহিনী। মিয়ানমারের বৌদ্ধরাও যে কতোটা নির্মম হতে পারে সেটা এই রোহিঙ্গা সঙ্কট থেকেই খুব পরিষ্কারভাবে দেখা গেছে। যে বৌদ্ধধর্মের কথা আমরা জানি পরম অহিংসার ধর্ম , সেই বৌদ্ধদের আমরা হতে দেখলাম চূড়ান্ত রকমের সহিংস, নির্দয়, নির্মম, পাশবিকরূপে।
কথা হচ্ছে এতে করে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের লাভ কি?
ইয়েস। গুড কোশ্চেন।
আমাদের এশিয়ান দেশগুলো এখন উন্নয়নশীল দেশ। অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা দীক্ষা সব দিক দিয়েই তারা এগিয়ে যাচ্ছে। এই এগিয়ে যাওয়ার পথে তৈরি করে নিতে শুরু করেছে যার যার নিজস্ব পরিচয়। আর তার সাথে অর্থনৈতিক সক্ষমতা। এসব যদি ধারবাহিকভাবে উন্নত হতে থাকে তাহলে তো বিপদ ঐ পশ্চিমা দেশগুলোরই। তাহলে তারা আর আমাদের নিজেদের খেয়াল খুশি মোতাবেক নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। দমিয়ে রাখতে পারবে না। আমাদের বাজার এর উপর তাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।
এখন এমতাবস্থায় তারা কি করতে পারে?
গেস করুন তো!!
যাক আর বিশদ ব্যাখ্যায় নাই বা গেলাম।
একটা উদাহরণ দেই।
আপনারা খুব ভালোভাবেই জানেন যে আমদের ধর্মান্ধ মুসলিমরা কি চায়। ইয়েস, তারা চায় দেশে ইসলাম কায়েম হোক, ইসলামের জয় হোক, শরিয়া শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। সেটা তো আর আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো এর ভেতর এতো সহজে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, লড়াই ছাড়া। তা এরা যখন লড়াই করতেই চায় এদের জঙ্গি বানিয়েই লড়াই করতে তৈরি করাই হোক !! আর পশ্চিমের প্রতি অনুগত এসব দেশ এর সরকারকে ভীত সন্ত্রস্ত করার মতো সমস্ত আয়োজন এক্কেবারে পাকা করে রেখেছে পশ্চিমারা, বিশেষ করে তাদের পালের গোদা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরা অর্থাৎ মুসলমানরা যতোই লড়তে চাইবে তাদের ইসলামী রাষ্ট্রের লক্ষ্যে ততোই এদের দরকার হয়ে পড়বে অস্ত্রের।
তা এদের কে দেবে সেই অস্ত্রের সাপ্লাই? গেস করুন তো!!
এদের যদি এসব দেশ এর বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি খেপিয়ে তোলা যায়, হুমকি হিসেবে দাঁড় করানো যায় তাহলে সেইসব দেশ এর সরকারগুলোকে এদের বিরুদ্ধে পাল্টা অস্ত্র ধারণ করতে হবে। তো এসব সরকারদের কারা সাহায্য করবে এলিট ফোর্স তৈরি আর তাদের অত্যাধুনিক সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে? গেস করুন তো!!!
আরেকটা উদাহরণ দেই।
[মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে যুদ্ধ শিল্প বা সমর শিল্প বা সমর বাণিজ্য বা সমর সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে একটি পুরোদস্তুর যুদ্ধবাদী কাঠামো গড়ে উঠেছে যা সেদেশের শাসক, রাজনৈতিক দলগুলো এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতাকেন্দ্রের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বা সম্পর্কিত। সেটি শুধু অস্ত্র উৎপাদন, ব্যবহার ও বিক্রয়ের ওপরই নির্ভরশীল নয়।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন সমর শিল্পে বিনিয়োগ সর্বাধিক। যদিও অনেকে সমর শিল্প বলতে অস্ত্র উৎপাদন ও বিশ্বের বিভিন্ন ভূ-খণ্ডে প্রতিবেশীদের মধ্যে ক্রিত্রিম বিরোধ তৈরি করে ও সেটা জিইয়ে রেখে তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করাকেই বুঝে থাকেন। আসলে এটা হল অস্ত্র ব্যবসা থেকে মুনাফা আদায়ের একটি দিক মাত্র। কিন্তু কেবল অস্ত্র নির্মাণটাই এই শিল্পের সব কিছু নয়। এর সাথে জড়িত আছে তাদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রচার মাধ্যম, নির্মাণ শিল্প, তেল গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান, বৃহৎ ব্যাঙ্ক পুঁজি এবং ইউ এস এইড/ আই এম এফ / ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক এর মতো ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানসমূহ। ( সুত্র - সাম্রজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থা – আবিদুল ইসলাম)
বাংলায় একটা কথা আছে।
সর্প হইয়া দংশন করে, ওঝা হইয়া ঝাড়ে।
আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর প্রতি তেনাদের এতোটাই কৃপা!!!
লাভের গুড় শেষমেশ কার ভাঁড়ে যাবে?
ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে এজন্যই এতো কথা বলি। এতো এতো চিল্লাই!! এমনি এমনি না।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ১২:৪৫