১)
সত্তর- আশির দশকেও ঢাকায় অনেক চাইনিজ দেখা যেত; চাইনিজ মানে চাইনিজ রেস্তোরাঁ না, আমি চীন দেশের মানুষকে চাইনিজ বলছি। তখন রাস্তায় বেরোলে প্রায়ই দেখা যেত কোন চাইনিজ হেঁটে বা রিকশায় করে কোথাও যাচ্ছেন, কখনো বা দেখা যেত পুরো পরিবারকে, বাচ্চা থেকে শুরু করে বুড়ো পর্যন্ত সবাই একসাথে। এদেশে প্রথম চাইনিজ রেস্তোরাঁ চালু করেন এরাই। এই রেস্তোরাঁগুলোতে ক্যাশে দেখা যেত কোন চাইনিজ বসে আছেন, সেখানে বাবুর্চিও হতেন চাইনিজ। ঢাকার প্রায় সবগুলো বিউটি পার্লার চালাতেন চাইনিজ মহিলারা। আজিমপুরে চায়না বিল্ডিঙ নামে একটা চারতালা বাড়ি ছিল, তার ভিতরে ছোট ছোট অনেক ফ্ল্যাট- সেগুলোতে থাকতেন অনেক চাইনিজ পরিবার। চায়না বিল্ডিঙের গলি তে গেলেই নানা বয়সী চাইনিজদের কিচিরমিচির করতে দেখা যেতো।
এই চাইনিজরা কবে, কেন, কিভাবে এসে আমাদের দেশে বসবাস শুরু করেছিলেন জানা ছিল না, কিন্তু আমার জানার আগ্রহ ছিল প্রবল। কোন ছুতা ধরে চাইনিজদের সাথে আলাপের সুযোগ খুঁজতাম, কিন্তু তারা মোটেও আলাপী ছিল না। রাস্তাঘাটে কোন চাইনিজ যেচে কথা বলতেন না। রেস্তোরাঁতে যতটুকু দরকার ততটুকুই কথা বলতেন, পার্লারেও তাই- বড়জোর জিজ্ঞেস করতেন, "আপনি কিভাবে চুল কাটতে চান?" জেনে নিয়ে চুপচাপ কাজ করে যেতেন। জানিনা বাঙালিদের সাথে না মিশে কিভাবে এরা বাংলা বলা শিখেছিলেন, কিন্তু তাদের পার্লার বা রেস্টুরেন্টের নাম তারা চীনা ভাষাতেই রাখতেন। তারা থাকতেন একেবারে তাদের নিজেদের সমস্ত বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে- পোশাক-আশাক, খাওয়া-দাওয়া, উৎসব-পার্বণ কোন কিছুতেই এদেশের মানুষের সাথে তারা মিলতেন না। হাঁস যেমন সারাদিন পুকুরের পানিতে কাটিয়ে সন্ধ্যাবেলায় শরীর থেকে পানি ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেয় নাই, চাইনিজরা তেমনি এদেশে থাকতেন- চলতেন- ফিরতেন, কিন্তু এদেশের কোন কিছুতেই প্রভাবিত হতেন না। পরিবারে একসাথে তিন প্রজন্মের সদস্য দেখা যেত, বিয়ে-শাদী করতেন তারা নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যেই। শুধু একবার, ঐ একবারই এক ছোট চায়নিজ ছেলেকে দেখেছিলাম বাংলাদেশকে তার নিজের দেশ বলে দাবি করছে। নব্বইয়ের দশকে নিউমার্কেটের এক খাতা পেন্সিল এর দোকানে গেছি, দেখি এক বছর দশেকের চাইনিজ ছেলে বাবার সাথে এসে পেনসিল বক্স কিনছে। দোকানি তাকে জিজ্ঞেস করল, "বাবু, তোমার নাম কি?" ছেলেটা কিছু একটা উত্তর দিল। এবার দোকানি তাকে জিজ্ঞেস করল, "তোমার দেশ কোথায় বাবু?" এবার দেখি ছেলেটা হাতের পেনসিল বক্স দোকানের কাউন্টারে ঠুকতে ঠুকতে তাল দিয়ে স্পষ্ট উচ্চারণে দোকানীকে বলছে, 'এই দেশ, আমার দেশ, বাংলাদেশ।"
তাহলে কি চাইনিজদের নতুন প্রজন্ম এ দেশটাকে নিজেদের দেশ বলে ভাবতে শুরু করেছিল? অভিবাসী দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের মানুষেরা কি তারা যে দেশে বসবাস করে, সেই দেশটার সাথে ভালবাসার বাঁধনে জড়িয়ে যায়, পূর্বপুরুষের ফেলে আসা দেশকে তারা কি পুরোপুরি ভুলে যায়? ইদানিং এই প্রশ্ন বারবার মনে আসছে।
সেই চাইনিজদের আর দেখি না। এদেশ ছেড়ে তারা কোথাও চলে গেছেন! কোথায় গেছে জানিনা! তারা কি নিজেদের দেশ চীনে ফিরে গেছেন, নাকি ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া কিম্বা কানাডায় গিয়ে নতুন করে বসত গেড়েছে! সেই নতুন দেশেও কি তারা নিজেরা নিজেদের মধ্যে গুটলী পাকিয়ে থাকছেন, নাকি সে দেশের মানুষের সাথে মিশে গেছেন! শুনেছি বিলাত- আমেরিকায় থাকা চাইনিজরা এখন পাশ্চাত্যের ধ্যান ধারণা, আচার আচরণ, সবকিছু আত্মস্থ করে নিয়েই থাকছেন। সন্তানদের চাইনিজ নামের পাশাপাশি তারা স্কুল কলেজের জন্য একটা ইংরেজি নামও রাখছেন। চাইনিজরা এখন প্রচুর ভিনদেশী বিয়ে করছেন, এমনকি বিদেশে থাকা বাংলাদেশীদেরও। অনেক বাংলাদেশিদের দেখেছি চাইনিজ বিয়ে করেছেন এবং পরস্পরের সংস্কৃতি যোজন- বিয়োজন করে সুখে-শান্তিতে ঘরকন্যা করছেন। তার মানে এখনকার চাইনিজরা জীবনে নানা রকম অভিযোজন করে অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলা শিখেছেন।
অবশ্য এখনো বাংলাদেশে অনেক চাইনিজ দেখা যায়। এরা পদ্মা সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বড় পুকুরিয়া ধরনের বড় প্রজেক্টের কাজ নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। এদের চেহারা ঝকঝকে, তার চাইতে ঝকঝকে গাড়িতে চড়ে এরা ছুটে চলেন নিজেদের কাজ করত। এদের দেখে মনে পড়ে যায় মলিন চেহারার, বিষন্ন মুখের সেই নাপিতের কাজ করা, বাবুর্চির কাজ করা চাইনিজদের। কি দুঃখ ছিল তাদের! নিজ দেশ ছেড়ে কেন তারা আমাদের দেশে থাকতেন! তারপর কোথায় চলে গেলেন তারা! কেন মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যায়, তারপর সেখানেই থাকতে শুরু করে !
জানা হলো না। হায়!
২)
আমাদের দেশের অনেক মানুষও এখন বিদেশে অভিবাসী হচ্ছেন, অনেকগুলো অদৃশ্য সুতোর বাঁধন ছিঁড়ে একদিন তারা উড়ে চলে যান বহু দূরের দেশে। আবার শীতকালে অতিথি পাখির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরে আসেন, একটু উষ্ণতা আহরণের জন্য। এদের বেশিরভাগই প্রথমে লেখা পড়ার জন্য বিদেশে যান। তারপর তারা সেখানেই থেকে যান অভিবাসী হয়ে। এই অভিবাসী জীবন বেছে নেবার কারণ যতটা প্রাচুর্যময় জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষায়, তারচেয়ে বেশি উন্নত দেশে নিয়ম নিষ্ঠা, মেধার মূল্যায়ন, আইনের শাসন এইসবের উপস্থিতির কারণে। আমি এমন অনেক মানুষকে অভিবাসী হতে দেখেছি, বিদেশের চাইতে নিজের দেশে যাদের জীবন অধিকতর আরামদায়ক ছিল, ছিল প্রাচুর্য এবং পারিবারিক সম্মান- প্রতিপত্তি, দেশের জন্য ছিল বুক ভরা ভালোবাসা। তবু তারা প্রবাস জীবন বেছে নিয়েছেন, অধিকাংশের ক্ষেত্রেই প্রথমত উপরে উল্লেখিত কারণে এবং দ্বিতীয়ত, পরবর্তীতে সে দেশে জন্ম নেয়া সন্তানের কথা ভেবে।
উন্নত দেশে চিকিৎসা, শিক্ষা, বাসস্থান- সবই আমাদের দেশের তুলনায় অনেক ভালো। তাই প্রবাসীদের সন্তান বড় হবার আগে পর্যন্ত দেশে ফিরে আসার সম্ভাবনা কিছুটা থাকলেও যখন তাদের সন্তানেরা, বিদেশের শিক্ষা ও জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে যায়, সেই দেশকেই নিজের দেশ মনে করে ভালবাসে, তখন অনিয়ম আর অনিশ্চয়তায় ভরা দেশের জীবনে ফিরে আসাটা কষ্টকর হয়ে যায়। সমান কষ্টকর হয় ফেলে আসা দেশকে ভুলে যাওয়া। হঠাৎ কখনো মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে আর ঘুম আসে না। কখনো খাবার টেবিলে নানা সুখাদ্যের ভীড়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকেন, কুঁচো চিংড়ি দিয়ে রাঁধা কলমি শাকের চচ্চড়ির জন্য মন কাঁদতে থাকে। এই মন কাঁদার কথা বলা আছে ঝুম্পা লাহিড়ির বইতে:
".....একটা বাটিতে রাইস ক্রিস্পি, প্ল্যান্টার্স বাদাম আর কুচোনো লাল পেয়াজ একসঙ্গে মাখছিল। তাতে নুন, লেবুর রস আর মিহি করে কাটা কাঁচালঙ্কা মেশাতেই একটু সরষের তেলের জন্য তার মনটা হাহাকার করে উঠল।"( সমনামী; ঝুম্পা লাহিড়ি)
এই অভিবাসীরা যখন দেশে বেড়াতে আসেন, কয়েকদিন পুরনো স্মৃতিকে হাতড়াতে থাকেন। অবশেষে একগাদা বাংলা বই, নাটক- সিনেমা- গান, শাড়ি- পাঞ্জাবি আর যাতে যাতে দেশের গন্ধ পাওয়া যায়, তার সবকিছু দিয়ে সুটকেস বোঝাই করে নিয়ে তারা ফিরতি প্লেনে চাপেন। দেশের মাটি, আত্মীয়- বন্ধু সবকিছুর জন্য মন উচাটন ভাবটা রয়েই যায়।
দেশের জন্য মন উচাটন এই ভাবটা প্রবাসী দ্বিতীয় প্রজন্মের হয় না, বিশেষত তারা যদি সেই দেশেই জন্মে। তখন সে দেশটাই হয় তাদের জন্মভূমি। এমনকি বাংলাদেশে জন্মেছে, কিন্তু ছোটবেলায় মা বাবার সাথে বিদেশে অভিবাসী হয়েছে, এমন সন্তানদেরও দেশ দেশ বলে খুব একটা উতলা হতে দেখিনি। হবার কথাও না, আমাদের দেশেই কি শহরে বড় হওয়া সন্তানেরা কখনো বাবার ফেলে আসা গ্রামে থাকার জন্য ফিরে যেতে চায়!!!
প্রবাসী দ্বিতীয় প্রজন্ম কখনো কখনো আত্মপরিচয় সংকটে (Identity crisis) ভোগে, ঝুম্পা লাহিড়ির Namesake এর গোগোলের মত। আমার আত্মীয়- বন্ধু অনেকের সন্তানদের মধ্যেও আমি গোগোলের ছায়া দেখতে পাই। এটা হয়, কারণ বাবা মা চান চেষ্টা করেন নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি সন্তানদের শেখাতে, মা বাবা চান সন্তানেরা উৎসব-পার্বণে দেশি পোশাক পড়ে, দেশি খাবার খেয়ে, নিজস্ব শেকড় চিনে রাখুক। সন্তানেরা কিছুদিন পর্যন্ত এই চাওয়া পূর্ণ করলেও সময়ের সাথে সাথে তারা অভিযোজিত হতে থাকে, যে পছন্দ- অপছন্দ, সংস্কার, সংস্কৃতি তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে তার সাথে তাদের বাবা-মায়ের তেমন সখ্যতা হয় না। এই দ্বিমুখী টানাপোড়েনে দ্বিতীয় প্রজন্ম কিছুকাল ভুগলেও, একসময় আত্মপরিচয় সংকট কেটে যায়। দেশের শেকড়ের যেটুকু ছায়া রয়ে গিয়েছিল, তা কাটিয়ে উঠে, অভিযোজন ভালোভাবে সম্পন্ন হয়। দেখা যায়, জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনী নির্বাচনে দ্বিতীয় প্রজন্মর কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে মনের মিল- দেশ, সংস্কৃতি, ধর্ম বা গায়ের চামড়া নয়!
বাঙালি চেহারা ছাড়া (যদি বাবা মা দুজনেই বাঙালি হয়ে থাকেন, তবেই) তৃতীয় প্রজন্মের মাঝে বাঙালিয়ানার তেমন কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না।
এটা একান্তই আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ। তিন প্রজন্ম ধরে বিলাত এবং উত্তর আমেরিকায় অভিবাসী হয়ে আছেন, এমন কিছু কাছের মানুষদের নিয়েই আমার পর্যবেক্ষণ। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও আছে- এমন ও পরিবার দেখেছি যারা তিন পুরুষ ধরে প্রবাসী, কিন্তু তিন প্রজন্মই ভাষা, খাদ্যাভাস, সংস্কৃতিতে বাঙালিয়ানা ধরে রাখার পাশাপাশি যে দেশে রয়েছেন সে দেশের আচার ব্যবহারের সাথেও পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়েছেন। সংখ্যায় অল্প হলেও এমন প্রবাসী ও দেখা যায়। এদের দেখলে আমার মনে পড়ে যায় এদেশে থাকা চাইনিজদের কথা, যারা পরদেশের ছোট্ট একটা গলিকে নিজের দেশ ভেবে থাকতো।
৩)
বিকেল গড়ানোর সাথে সাথে গাছের ছায়াগুলো লম্বা হতে থাকে, অন্ধকার ঘনায়। রাত্রি নামার প্রতীক্ষার বসে থাকা সেই আঁধার আঁধার বিকেলে মন চায় প্রিয় মুখগুলো দেখতে। দেখা না মিললে শুরু হয় মনের সাথে বোঝাপড়া। কোনটা ভালো- কাছে থাকা, নাকি দূরে যাওয়া; নিজ দেশ, নাকি পরবাস! নিজ দেশের নাগরিক হয়ে যদি থাকতে হয় হরেক রকম অন্যায়ের সাথে আপোষ করে, অনিরাপত্তার মাঝে, প্রবলের চাপে নিষ্পেষিত হয়ে, অধিকারবিহীনভাবে- তাকে কি তখন আর প্রথম শ্রেণীর নাগরিক বলা যায়!!
কতকাল আগে ঈশ্বর পাটনী তার সন্তানের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন, "আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।" এই যুগের মায়েরা এখন প্রার্থনা করেন, "আমার সন্তান যেন ফিরে আসে ঘরে।" কেউ কেউ ফিরে আসে, কেউ আর কখনোই আসে না.......
সুবোধ তবে পালিয়েই যাক! নিজ দেশে পরবাসী হয়ে থাকার চেয়ে সেই ভালো।
এলোমেলো ভাবনার এই লেখাটা শেষ করি জীবনানন্দের কবিতা দিয়ে।
...............
এখানে তোমরা তবু থাকিবে না? যাবে চলে তবে কোন পথে?
সেই পথে আরও শান্তি- আরও বুঝি সাধ?
আরো বুঝি জীবনের গভীর আস্বাদ?
তোমরা সেখানে গিয়ে তাই বুঝি বেঁধে রবে আকাঙ্ক্ষার ঘর!........
যেখানেই যাও চলে, হয় নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;
এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধূসর
ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই যাও বাঁধো আকাঙ্ক্ষার ঘর!
(বলিল অশ্বত্থ সেই: জীবনানন্দ দাশগুপ্ত)
ছবি: অন্তর্জাল থেকে নেয়া।